ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

খুব মনে পড়ে আইভি রহমানকে

প্রকাশিত: ০৪:৩৩, ২৬ আগস্ট ২০১৮

 খুব মনে পড়ে আইভি রহমানকে

বাংলার বুকে নরপশুরা যেসব তান্ডব ঘটিয়েছে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের হত্যাযজ্ঞ সবচেয়ে ভয়াল ও মর্মান্তিক। ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্টের খুনীগংরা অতৃপ্ত হয়ে হায়েনার মতো বিচরণ করেছে রাষ্ট্রযন্ত্র দখলে নিয়ে। মধ্য আগস্টের হত্যাযজ্ঞে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে সম্পূর্ণ নিঃশেষ করতে পারেনি বলে বাঙালির জাতিসত্তার চিরশত্রু নরপশুর উত্তরসূরিরা টার্গেট করে বিদেশে থাকায় মধ্য আগস্টের হত্যাযজ্ঞ থেকে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধু কন্যাকে নিঃশেষ করতে। কয়েক বছর ধরে কয়েকবার হামলা করে শেখ হাসিনাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে। সেসব হামলা থেকে বেঁচে গেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। কিন্তু ওরা ক্ষান্ত হয়নি। পরাজিত শক্তি ও দেশ বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে মিলে রাষ্ট্রযন্ত্রের অঘোষিত অধিপতিগং ২০০৪ এ পূর্ব ঘোষিত আওয়ামী লীগের সভায় হত্যাযজ্ঞ চালানোর পরিকল্পনা করে। হাইকমান্ডের নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউর সভাস্থলকে ঘিরে অবস্থান নেয় ঘাতকরা। বাঙালি জাতিসত্তার চির শত্রুরা সেখানে মদদ জোগায়। ৩টায় জনসভা শুরু হয়। প্রায় দুঘণ্টা নেতাদের বক্তৃতা চলার পর খোলা ট্রাকের ওপর নির্মিত মঞ্চে প্রধান অতিথি শেখ হাসিনার বক্তৃতা দিতে দাঁড়ান। ঘাতকরা এই দীর্ঘসময় অপেক্ষা করেছে দুটি কারণে এক. তাদের মূল টার্গেটকে আলাদা পাওয়া দুই. শেখ হাসিনার বক্তৃতার সময় পুরো জনতার উপস্থিতি পাওয়া যাতে অধিক প্রাণহানি ঘটানো যায়। শেখ হাসিনার বক্তৃতা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছাদের ওপর থেকে প্রথম বোমাটা ঘাতকরা ছুড়ে দেয় শেখ হাসিনাকে টার্গেট করেই। মাথার পেছন ঘেঁষে বোমাটি ট্রাকের নিচে পড়ে বিস্ফোরিত হয়ে প্রাণহানি ঘটায় নেতাকর্মীদের। বোমার প্রচ- ঝাঁকুনিতে কেঁপে ওঠে ট্রাক। ট্রাকের উপরের নেতাকর্মীরা মানব ঢাল তৈরি করে ফেলেন। আরও অমনি চারপাশে একের পর এক বোমা বিস্ফোরিত হতে থাকে। ভয়াল মৃত্যু আর্তনাদ আতঙ্কের মধ্যে উপায় না দেখে নেতাকর্মীরা তাকে ট্রাক থেকে নামিয়ে বুলেটপ্রুফ গাড়িতে তুলে নেয়। এরই মধ্যে আরও ১৩ বোমা বিস্ফোরণে রঙা গঙ্গা বয়ে যায় নেতাকর্মীদের দেহ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। শেখ হাসিনার গাড়িকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয় তিনি কোন রকমে প্রাণে বেঁচে যান। প্রাণপ্রিয় নেত্রীকে বাঁচাতে বোমার স্পিন্টারে ক্ষত হয়েছেন নেতাকর্মীরা। জীবন মরণ তোয়াক্কা করেননি। চারপাশে সবাই ক্ষত বিক্ষত। কে কাকে টেনে তুলবে, কে কাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে? অমন মরণ আতঙ্কের মধ্যে রাস্তায় পড়ে প্রাণ হারালেন কত মানুষ। কেউ কি আর অক্ষত আছে যে টেনে তুলবে মুমূর্ষুকে। যারা বোমার আঘাত থেকে বেঁচেছে দৌড়ে প্রাণ বাঁচিয়েছে। মঞ্চের সামনেই মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রীদের নিয়ে বসেছিলেন মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আইভি রহমান। বোমার আঘাতে আইভি রহমানের দুপা উড়ে যায়। রক্তে ভেসে যায় রাস্তা। গুরুতর আহতদের ভিড় থেকে আইভি রহমানকে তুলে যখন নেয়া হলো তখন রক্ত ক্ষরণে তার শরীর অসার হয়ে পড়েছে। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের সামরিক হাসপাতালে নেয়া হলো ততক্ষণে জ্ঞান হারিয়েছেন। আর জ্ঞান ফিরে পাননি। সেখানে তাকে কয়েক ব্যাগ রক্ত দেয়া হলো। ক্ষত বিক্ষত দেহ আর রক্ত নেয়নি। কৃত্রিমভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস চালিয়ে রাখা হলো। প্রায় ৫৫ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে পরাস্ত হলেন আইভি রহমান। ২১ আগস্ট এলেই আমার খুব মনে পড়ে আইভি রহমানকে। স্বৈরদশকে আমরা ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র। স্বৈরশাসকের অনুচরদের কবল থেকে বৃহত্তর ময়মনসিংহ ছাত্র সমিতির নেতৃত্ব হাতে নিয়েছি আমরা ছাত্রলীগ কর্মীরা। ১৯৮৮-এর বন্যা চরম অবস্থায় পৌঁছালে আমরা বন্যাত্রাণ কার্যক্রম চালাতে সিদ্ধান্ত নিই। ত্রাণ সংগ্রহের একপর্যায়ে আমরা ধানমন্ডিতে আমাদের বৃহত্তর ময়মনসিংহের ধনকুবের জহিরুল ইসলামের বাসায় যাই। আলোচনা সুবিধে হলো না। রাগারাগি করে আমরা চলে আসি। তার পরদিন আইভি রহমানের বাসায় যাই আমরা তিনজন। সেসব কথা উনাকে বলি। আমাদের কথা শুনে তিনি চারজনের কাছে ফোন করলেন। আরও কয়েকজনের তালিকা দিলেন। কীভাবে কি করব পরামর্শ দিলেন। মাতৃ স্নেহে পায়েশ খাইয়ে তবে ছাড়লেন সেরাতে। আমাদের বের হবার মুখে বললেন, কতটা কি করতে পারলে আমাকে জানিয়ে যেও। তারপর আরও দুদিন আইভি আন্টির কাছে গেছি। সেই সুশ্রীবদনে সেই হাসিতে বরণ করেছেন আমাদের। ডিমের হালুয়া সামনে দিয়ে বলেছেন, হলে থাক কি খাও তোমরাÑ তা তো জানি, এগুলো যা দিলাম সব খাবে। কত কথা হতো তার সঙ্গে। পিতা ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর জালাল উদ্দিন চেয়েছিলেন মেধাবী কন্যা বড় চাকুরে হবেন। সব পিতা যেমন চান। কোন বেকার রাজনৈতিক কর্মীর সঙ্গে কন্যার বিয়ে দিতে চান নি তিনি। শেষে ভালবেসে আওয়ামী লীগ নেতা সরলপ্রাণ জিল্লুর রহমানকে বিয়ে করেন নিজেই। যোগ দেন সক্রিয় রাজনীতিতে। অমন স্নেহময়ী নিটোল সৌন্দর্যময়ী আইভি রহমানের অমন মৃত্যুটি আমি কখনই মেনে নিতে পারিনি। একুশ আগস্ট এলেই আমার স্মৃতিপটে ভেসে ওঠেন সেই অপরূপা স্নেহময়ী আইভি রহমান। আজ খুব মিস করি আইভি রহমানকে যখন নতুন প্রজন্ম মানসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রোথিতকরণ কর্মসূচী চালু করতে দশ বছর ধরে আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর নানা জনের কাছে, মুক্তিযুদ্ধের সরকারের আমলাগণের কাছে ধন্না দিয়ে হয়রান হয়েছি। তখন খুব মনে হয় আইভি রহমান বেঁচে থাকলে এ কর্মসূচীর জাতীয় গুরুত্ব বুঝতেন তিনি। আইভি রহমান আমাকে নিয়ে গিয়ে এই কাজটি করবার সুযোগ করে দিতেন। বন্যার ত্রাণ কর্মসূচী চালানোর জন্য যেমনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন আজও তিনি আমাকে ফেরাতেন না। আজ গত দশ বছরে তিন লাখ নতুন ভোটার যোগ হয়েছে। এই কর্মসূচীটি চালাতে পারলে এই নতুন প্রজন্ম ভোটার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাপুষ্ট থাকত। মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রজন্ম মানসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রোথিতকরণ কর্মসূচিটিই যে মুক্তিযুদ্ধের সরকারের জন্য সবচেয়ে জরুরী বিষয় সেটা বুঝাতে আজ আমাকে দ্বারে দ্বারে হন্নে হতে হতো না। বড় অসময়ে হারিয়ে গেলেন আইভি রহমান। স্বাধীনতাবিরোধী ধর্মান্ধ অপশক্তি দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরা মারণাস্ত্র হাতে দিয়ে ঘাতকদের নিয়োজিত করেছিল বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরি শেখ হাসিনাকে নিঃশেষ করতে। সেদিন নিরাপদ অবস্থানে থেকে ভয়াল হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল ঘাতকরা। দলীয় নেতাদের প্রাণবাজি প্রচেষ্টায় বঙ্গবন্ধুকন্যা ঘাতকদের মারণাক্রোশ থেকে কোন রকমে প্রাণে বেঁচে গেছেন সেদিন। মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারিয়েছেন আইভি রহমানের মতো মহীয়সী রমণীরা, ত্যাগী নেতাকর্মীরা। আজ তাদের রক্তঋণ নিয়ে আমরা বেঁচে আছি। আজ আমার মনে নানা প্রশ্ন জাগে। এই বেঁচে থাকায় কতটা আমরা আপোষ করব আইভি রহমানের জীবনবাজি রাজনীতির সঙ্গে, বঙ্গবন্ধুর জীবনাকাক্সক্ষার সঙ্গে, বৃহত্তর গণমানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উন্নত স্বদেশ নির্মাণে? লেখক : অধ্যাপক ও গবেষক
×