ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নিরাপদ সড়ক চাই কিন্তু কিভাবে-

প্রকাশিত: ০৬:৫৯, ২৫ আগস্ট ২০১৮

 নিরাপদ সড়ক চাই  কিন্তু কিভাবে-

নিরাপদ সড়ক বাংলাদেশের সকল স্তরের জনসাধারণের একটি প্রাণের দাবি। এই দাবিতে কারও দ্বিমত নেই। শুধু নতুন আইন করে তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। আমি মনে করি, গাড়ি চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে শিক্ষাগত যোগ্যতা ৮ম শ্রেণী পাস এবং দুর্ঘটনায় কেউ মৃত্যুবরণ করলে চালকের ৫ বছর মেয়াদী জেল ও জরিমানা করে নিরাপদ সড়কের নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে না। আমি কিছু ধারণা সরকারের নীতি নির্ধারকদের বিবেচনার জন্য নিম্নে উল্লেখ করছি- নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে হলে তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠান, কেন্দ্রীয় ও জেলাভিত্তিক অফিস, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, বিআরটিএ অফিস, ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়ার পদ্ধতি, ড্রাইভিং ইন্সপেকশন পদ্ধতি, আবেদন ফরম, গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা করার পদ্ধতি, ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব, ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ কোর্স ও মেয়াদকাল, ড্রাইভারদের মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা, ড্রাইভারদের শ্রেণীবিন্যাস, একই রাস্তায় বিভিন্ন যান চলাচলের জন্য সৃষ্ট যানজট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে যানবাহনের গতি, রেললাইন ডবল লাইনে রূপান্তর, সড়ক পরিবহন সংস্থার কাজ, সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের ভূমিকা, তাদের রেজিস্ট্রেশনের নিয়মাবলী নিশ্চিত করতে হলে তাদের আরও কিভাবে কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে হবে। যে সংস্থায় আর্থিক নিয়ন্ত্রণ ও আর্থিক স্বচ্ছতা নেই, সেই সংস্থা সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। পদে পদে লাঞ্ছিত হতে হয়। তাই প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে আর্থিক শৃঙ্খলা আনতে হবে। উপরোক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সার্বিক কার্যক্রমের দুর্বলতাসহ মূল্যায়ন করে সকলে যাতে তাদের দায়িত্ব স্বচ্ছতার সঙ্গে পালন করতে পারে তার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে হলে আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত পরিবহন সেক্টরের দুর্নীতি বন্ধ করতে পারলে কর্মসূচীর অগ্রগতি হবে। সড়ক নিরাপত্তার জন্য পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বেসরকারী সংস্থা ব্র্যাক কয়েক বছর যাবত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা ভারতের একটি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের সহায়তায় এ পর্যন্ত কয়েকশ’ মহিলাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে এদের চাকরির নিশ্চয়তা দিয়েছে। শুধু প্রশাসনিক উদ্যোগের মাধ্যমে এ কর্মসূচী ১০০ ভাগ নিশ্চিত হওয়া যাবে না। কেবল গাড়ির চালককে দায়ী করলে চলবে না। আমরা সাধারণ মানুষও দুর্ঘটনার জন্য অনেক সময় দায়ী। ঢাকা-সিলেট লাইনে বাসে গেলে দেখতে পাবেন মহাসড়কের বিভিন্ন জায়গায় রাস্তার ওপর ঘাস খাওয়ানোর জন্য রাস্তার পাশে বেঁধে দিয়ে মালিক চলে যায়। গরু কি রাস্তার কিনারে শুধু ভদ্রলোকের মতো ঘাস খাবে- সে একসময় রাস্তার ওপর এসে পড়ে। দূরপাল্লার বাস বা ট্রাক যার গতি যদি ৫০-৬০ কিমি থাকে, তখন যদি হঠাৎ করে একটি গরু বাসের সামনে এসে পড়ে যায়, তখন ড্রাইভার গাড়ি বাঁচাবে, না গরু বাঁচাবে, না যাত্রী বাঁচাবে- তা তাৎক্ষণিকভাবে তার মাথায় আসে না। তখনই দুর্ঘটনা ঘটে। এখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ড্রাইভারের কোন দোষ থাকে না। কিন্তু সবার চোখে ড্রাইভার দোষী হয়ে যায়। কথায় বলে ‘যত দোষ-নন্দ ঘোষ।’ তাই, বলছিলাম জনসাধারণকে ট্রাফিক আইনসহ নিরাপদ সড়ক চাই বিষয়টি বুঝিয়ে দেয়ার জন্য ব্র্যাককে সম্পূর্ণ দায়িত্ব দিলে তার সঠিক বাস্তবায়ন হবে। ব্র্যাককে যদি সরকার এ ব্যাপারে অর্থায়ন করে এবং নিরাপদ সড়ক চাই- কর্মসূচীর খুঁটিনাটি বিষয় যাচাই করে একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে ব্র্যাককে সহায়তা করতে বলা হয় এবং ব্র্যাক ও সরকারের যৌথ উদ্যোগে যদি এ কর্মসূচী চালানো হয়, তবে হয়ত একটি দৃষ্টান্তমূলক সফল কর্মসূচী হয়ে দেশের জনসাধারণকে নিরাপদ সড়কের নিশ্চয়তা দিতে পারবে। শুধু বিচ্ছিন্নভাবে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে এতবড় একটি জটিল সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা প্রয়োজন যা প্রণয়ন করার দক্ষতা, সদিচ্ছা ব্র্যাক সংস্থার আছে, যে সংস্থাটি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জাতীয় অনেক সমস্যার সমাধান করে দিচ্ছে কিন্তু আমাদের দেশে গড়া একটি মানব উন্নয়ন সংস্থাকে কাজে লাগাতে না পারা আমাদের ব্যর্থতা। নিউইয়র্কে যত বাস/ট্যাক্সি চলাচল করে তার মধ্যে মাইক থেকে একটি ঘোষণা কতক্ষণ পর পর শোনা যায় তা হলো : নিউইয়র্ক শহরের ড্রাইভারদের নিউইয়র্ক সিটির আইনে সুরক্ষা দেয়া আছে, ড্রাইভারের সঙ্গে কেউ কোন রকম অন্যায় আচরণ করলে তাকে ফেলানী আইনে বিচার করা হবে। এতে ড্রাইভারদের মনের মধ্যে এক ধরনের নিরাপত্তাবোধ আসে এবং কাজের প্রতি দায়িত্ববোধ আসে। একজন বাস ড্রাইভার ঘণ্টায় প্রায় ২২ ডলার হিসেবে ৮ ঘণ্টায় ১৭৬ ডলার করে নিম্নতম প্রতিদিন আয় করেন। যা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ১৪ হাজার টাকা। একটি বাস দুর্ঘটনায় পড়লে বা বাসের ক্ষতি হলে ইন্স্যুরেন্স সেই ক্ষতিপূরণ দেয়, অন্যদিকে ড্রাইভারের হাত-পা ভেঙ্গে গেলেও তার কোন ইন্স্যুরেন্স ব্যবস্থা নেই। গাড়ি চালকদের সামাজিক নিরাপত্তা ও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করলেই পরিস্থিতির উন্নতি হবে। যখনই কোন এলাকায় ছোট বা বড় রকমের দুর্ঘটনা ঘটুক, আশপাশের লোকজন দৌড়ে এসে কিছু বুঝে না বুঝে ড্রাইভারের ওপর চড়াও হয় এবং ড্রাইভার কোন কোন সময় গণপিটুনির শিকার হয়, তা কোনভাবেই কারও কাম্য নয়। এ ব্যাপারে কেউ সরকার বা বিরোধী কাউকে ড্রাইভারের পক্ষে কোন কথা বলতে শোন যায়নি। ড্রাইভারের কি জীবন নাই, সেকি ইচ্ছা করে দুর্ঘটনা ঘটায়- নিশ্চয় নয়। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ২০১৭ সালে মোট ৪ হাজার ২৮৪ জন মৃত্যুবরণ করেছেন (ঢাকা ট্রিবিউন) এবং ৯ হাজার ১১২ জন আহত হয়েছেন। ২ হাজার ০১৭ সালে মোট দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ৩৪৭২টি। ২০১৬ সালে ৬ হাজার ৮২৩ জন রোড এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছে এবং ৪ হাজার ৫৯২টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এই সংখ্যা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। ঢাকাসহ সকল বড় বড় শহরের রিপোর্ট পত্রপত্রিকায় আসে কিন্তু মফস্বল এলাকার অনেক দুর্ঘটনার খবর পত্র-পত্রিকায় আসে না। একজন ড্রাইভারের শিক্ষাগত যোগ্যতার চেয়ে বেশি প্রয়োজন প্রশিক্ষণ, তার মানসিক স্বাস্থ্য এবং তার ব্যক্তিগত চরিত্র। বহু ড্রাইভার বিশেষত যারা রাতে বাস চালান তারা অনেক সময় তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটান। কেউ কেউ মদ্যপান করে গাড়ি চালান। আন্তঃডিস্ট্রিক্ট বাসে কমপক্ষে দু’জন চালক নিয়োগ করতে হবে, যেটা প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন। সময় ফেরিতে নামার সময় প্রায়শই বাস কর্তৃপক্ষ/ড্রাইভার যাত্রীদের নামার সুযোগ দেন না। ব্রেক ফেল করে অনেক বাস নদীতে পড়ে গিয়ে দুর্ঘটনায় পতিত হয়। তাই গাড়ি/বাস যাত্রার সময় ব্রেকের অবস্থা, গাড়ির চাকার অবস্থা, বাতাস আছে কি-না, চাকা ঠিকমতো লাগানো আছে কি-না তা পরীক্ষা করে বাস ছাড়ার অনুমতি দিন। সবসময় মনে রাখবেন আপনার বাসে প্রায় ৭০-৮০ পরিবারের প্রধান ও ছেলেমেয়েদের জীবন বহন করছেন, এরচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পৃথিবীতে আর কিছু নেই। কয়েক কিলোমিটার চলার পর একটি গাড়ি সার্ভিসিং করা বাধ্যতামূলক করতে হবে। তা নির্ধারণ করে দিতে হবে। দ্রুতগামী গাড়ির রাস্তার ধীরগতিসম্পন্ন যানবাহন চলাচলের জন্য রাস্তায় সীমানা চিহ্নিত করে তা আলাদা করে দিতে হবে। দেশের রেললাইনের রাস্তা এবং ফুটপাথের ওপর সকল ধরনের পণ্য বিক্রি বন্ধ করে দিতে হবে। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে কিছু কিছু কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ঢাকা শহরে রেলক্রসিং এবং মফস্বল এলাকার রেলক্রসিংয়ের স্থাপিত অকেজো রেলগেটগুলোকে মেরামত করে অথবা নতুন রেলগেট স্থাপন করে একজন পুলিশ পাহারা ২৪ ঘণ্টার জন্য রাখতে হবে। তাছাড়া সারাদেশে বনবিভাগের চেক পোস্টেও পাহারাদার রাখতে হবে। সারাদেশে রেললাইন ডবল লাইনে পরিণত করতে হবে। গাড়ি/বাস/ইত্যাদি চালকের জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে এবং সারাজীবন ঝুঁকি নিয়ে বাড়িতে ছেলেমেয়েদের, স্ত্রীদের টেনশনের মধ্যে রেখে দূরপাল্লার যাত্রীদের বহন করে নিয়ে যায়- এর মতো গুরু দায়িত্ব আর কি হতে পারে। তার পরিপ্রেক্ষিতে তাহারা যে বেতন-ভাতা পান তা একেবারে নগণ্য। মাসের ২য় সপ্তাহের মধ্যে সব খরচ হয়ে যায়। তাই বর্তমান বাজারমূল্য এবং ঘর ভাড়া, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ ইত্যাদির কথা বিবেচনায় এনে তাদের একটি সন্তোষজনক বেতন নির্ধারণ করে দিতে হবে এবং সকল বাস মালিককে সরকারী সিদ্ধান্ত মোতাবেক তাদের বেতন মাসের ১ তারিখে পরিশোধ করতে হবে। সরকারকে শুধু জনগণের কথা চিন্তা করলেই চলবে না, যারা এই এক শ’ভাগ জনগণের. সকলকে রাস্তায় নিরাপত্তা দিচ্ছে। তাদেরও গুরুত্ব খাটো করে দেখা যাবে না। নিরাপদ সড়ক সংশ্লিষ্ট সকল ডিপার্টমেন্ট, আইন রক্ষাকারী বাহিনী, বিআরটিএসহ সকল সংস্থার কার্যক্রম পর্যায়ক্রমে মূল্যায়ন করতে হবে এবং সব সংস্থায় প্রধান হিসেবে সৎ এবং দুর্নীতিমুক্ত কর্মকর্তাকে নিয়োগ দিতে হবে। সরকার যদি সড়কের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয় তাহা হলে সকল উন্নয়নসূচক যতই উর্ধমুখী হোক না কেন তা জন সাধারণের কাছে ম্লান হয়ে যাবে। তাই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ সমস্যার সমাধান করার জন্য জরুরীভিত্তিক সকল ব্যবস্থা গ্রহণ ককে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিতে হবে। নিরাপদ সড়কে নিরাপদ থাকুন এবং অপরকে নিরাপদ থাকতে দিন- এই হোক আজকের সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতিজ্ঞা। লেখক : আমেরিকা প্রবাসী
×