ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

জাতির দাবি উচ্চ পর্যায়ের ইনকোয়ারি কমিশন গঠন

প্রকাশিত: ০৬:৫৭, ২৫ আগস্ট ২০১৮

জাতির দাবি উচ্চ পর্যায়ের ইনকোয়ারি কমিশন গঠন

দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় আমার সাপ্তাহিক কলাম ছাপা হবে শনিবার ২৫ আগস্ট। জাতির পিতা হত্যাকান্ডের ১০ দিন পর এবং ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও হত্যাকান্ডের ৪ দিন পর। যেহেতু এই রক্তঝরা কলঙ্কময় হত্যাকান্ডের দিনগুলোর একটিও আমার লেখার সিডিউলে পড়ছে না, তার পরও বিষয়বস্তু ঠিক রেখে প্রথমেই একটি দাবি উত্থাপন করতে চাই- একটি ‘হাই লেভেল ইনকোয়ারি কমিশন’ গঠন করা একান্তভাবেই জরুরী হয়ে পড়েছে। অবশ্য এসব হত্যাকান্ডের অনেক কিছুই ইতোমধ্যে জাতির সামনে চলে এসেছে। যেমন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মিলিটারি জিয়াউর রহমান জড়িতই কেবল ছিলেন না, মূল পরিকল্পনাকারীই এই মিলিটারি ছিলেন তৎকালীন ডেপুটি চীফ অব আর্মি স্টাফ। এ কথা আজ সর্বজনবিদিত যে- এই লোকটি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় থেকে পাকিস্তানী আইএসআই বা পাকিস্তান আর্মির গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট হিসেবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চক্রান্তে জড়িত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পূর্ব মুহূর্তে খুনী ফারুক রশীদ যখন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে দেখা করে হত্যা-পরিকল্পনার কথা জানায় তখন জিয়া তাদের নিবৃত্ত না করে বরং go ahead বলে এগিয়ে যেতে বলেন। কর্নেল জামিল ছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার অন্যতম সাক্ষী। তিনি বলেছেন, ‘খবর পেয়ে তিনি মেজর হাফিজকে সঙ্গে নিয়ে ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারের দিকে রওনা দেন। পথিমধ্যে জিয়ার বাসায় গেলে তিনি তাদের বলেন, ‘So what? President is killed, vice president is there. He will uphold the constitution. (অবশ্য মেজর হাফিজ এখন আর এই সত্য স্বীকার করবেন বলে মনে হয় না। তিনি জিয়া-খালেদার ট্যাবলেট খেয়ে বিভোর) কর্নেল জামিল তার পক্ষে আরও উল্লেখ করেন ১৫ আগস্ট ভোরে জিয়াকে Clean shave এবং Uniform পরা অবস্থায় দেখেন।’ অথচ জেনারেল খালেদ মোশাররফকে দেখেন তখনও রাতের পোশাকে। তার মানে জিয়াউর রহমান খবরটি শোনার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত এবং অপেক্ষায় ছিলেন। এমনি ভূরি ভূরি প্রমাণ আছে জিয়ার ইনভলমেন্টের। বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের (সাবেক) বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক খুনীদের জবান, circumstantial evidence বিশ্লেষণ করে মিলিটারি জিয়াই যে ছিলেন জাতির পিতা-হত্যার মূল হোতা তা দেখিয়ে দিয়েছেন। ‘জিয়াই ছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল হোতা’ শিরোনামে জনকণ্ঠের ১৫ আগস্ট শোক দিবস সংখ্যায় বিচারপতি মানিক একটি সুচিন্তিত কলামে তা পরিষ্কার করে দিয়েছেন। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা এক বক্তৃতায় আক্ষেপ করেছেন- ‘জিয়ার বিচার করা গেল না মৃত বলে।’ মনে হয় প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য এটাই বলে দেয় যে, জিয়ার বিচার করা গেলে এই হত্যাকা-ের মূল পরিকল্পনাকারীদের মুখোশ উন্মোচিত হতো! আর তাই আজ High power enquiry commission গঠনের তাগিদ অনুভব করছে জাতি। যদিও দেখা যায় বাংলাদেশে কোন তদন্ত কমিশনই তাদের রিপোর্ট দেন না বা তাদের ঋরহফরহমং দিনের আলো দেখতে পায় না অথবা বিকৃতভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে। তাছাড়া আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। ২১ আগস্ট ‘গ্রেনেড হামলা ও হত্যার তদন্তে বিচারপতি জয়নুল আবেদীনকে দিয়ে একটি One man Commission গঠন করা হয়েছিল। তিনি একটি রিপোর্টও দিয়েছিলেন। তাতে তিনি বলেছেন একটি বিদেশী শক্তি এই ঘটনা ঘটিয়েছে। এই ‘বিদেশী’ ইঙ্গিতটি ছিল ভারত। ধন্যবাদ বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে। তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল চক্রান্তকারী মূল পরিকল্পনাকারীকে তার বিচারকের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করে দিনের আলোয় নিয়ে এসেছেন। আর তাই আমাদের দাবি একটি ‘উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিশন’ গঠন করা হলে জিয়ার চক্রান্ত সামনে চলে আসবে। আগেই বলেছি, এটি আজ সময়ের দাবি। কারণ বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল চক্রান্ত, পরিকল্পনা এবং মূল চক্রান্তকারী ও পরিকল্পনাকারীর কুৎসিত চেহারা উন্মোচন করা না গেলে তাদের সহচররা অন্ধকারে থেকে বাংলাদেশ, স্বাধীনতা, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীতের বিরুদ্ধে সহজেই তাদের চক্রান্ত চালিয়ে যেতে পারবে। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা ১৫ আগস্ট ৩ নবেম্বরের হত্যাকান্ডের বিচারের ব্যবস্থা করেছেন, রায় হয়েছে, অনেক কিছু উন্মোচিত হয়েছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও হত্যাকা-ের বিচারিক আদালতের রায়ও আগামী মাসে প্রকাশ পাবে বলে আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক মিডিয়ায় বলেছেন। বিচার চলছে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের। এ সবের সঙ্গে যদি চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের বিচার করা যায় তাহলে জিয়া, মোশতাক এবং তাদের সাঙ্গোপাঙ্গদের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে যাবে। এখানেই হাই পাওয়ার ইনকোয়ারি কমিশন গঠনের যৌক্তিকতা। High power enquairy commission হলে বা কমিশনের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ পেলে শঙ্কিত হবেন জিয়াপত্নী খালেদা জিয়া। কেন না, ওই খুনীদের রাজনীতি বাংলাদেশে আনেন তার স্বামী মিলিটারি জিয়া এবং তিনি সেই রাজনীতিই লালন-পালন করে চলেছেন বলে রাষ্ট্রের স্বাভাবিক অবস্থা, অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল রাজনীতি তথা স্বাধীনতার মূলধারা তার ভাল লাগে না। তিনিও স্বামীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে স্বাধীনতার মূলধারার পরিপন্থী রাজনীতি করছেন। যে কারণে একাত্তরের পাকিস্তানী হানাদার মিলিটারি জান্তার প্রধান খুনী-সহযোগী জামায়াত-শিবির-রাজাকার-আলবদর মুসলিম লীগের ফসিলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে নিতে তার বাধেনি অবশ্য। তাতে বিএনপির কোন লাভ হয়নি, বরং ক্ষতিই হয়েছে। লাভ হয়েছে ওই ফসিলগুলোর। তাদের কঙ্কালে নতুন করে মাংস গজাতে শুরু করেছে। যার প্রতিফলন বা আলামত সাম্প্রতিক কয়েকটি সহজ-সরল আন্দোলনে দেখা গেছে, দেখা গেছে ফু-ঁদিতে। প্রথমত আন্দোলনটি ছিল তথাকথিত কোটা সংস্করণ আন্দোলন। বেশ কিছু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী বর্তমান কোটাকে সঙ্কোচন করে ১০% নামিয়ে আনার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। প্রথম দিকে তাদের আন্দোলন ছিল অহিংস। আমি এই কোটা সঙ্কোচন আন্দোলন সমর্থন করিনি। একাধিক টক শোতে আমার মতামত দিয়েছি। কারণ আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি দেখে মনে হয়েছে ছাত্রদের অন্য কোন কোটায় আপত্তি নেই, আপত্তি মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কোটায়। এতে তারা সফল হতে পারলে ঢ্যাড়া পেটাতে পারত মুক্তিযোদ্ধা সন্তানরা হেরেছে, অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধ হেরেছে। একাত্তরে যা পারেনি, এবারে তা পারল। এর কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধা-সন্তান তথা মূলধারার সংগঠনগুলো। তবে সিপিবির মতো মূলধারার সংগঠনগুলো। তবে সিপিবির মতো মূলধারার খাল কাটা রামসহ কয়েকটি বামও ছাত্রদের সমর্থন করে। আমরা মনে করি, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেকে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার ক্ষমতায় আসা এবং ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল চরম আওয়ামী লীগ বিরোধী দল। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল হোতা মিলিটারি জিয়া, মিলিটারি এরশাদ ও খালেদার মিলিটারি উর্দির নিচে আশ্রয় পাওয়া বর্বর সাম্প্রদায়িক জামায়াত-শিবিরের দল। তখন তারা দেদার আওয়ামী লীগ বিরোধীদের সরকারী চাকরিতে নিয়োগ দিয়েছে। আগে এটাকে ব্যালান্স করতে হবে। তার আগে মুক্তিযোদ্ধা কোটা কমানো যাবে না। বরং আন্দোলনকারীদের উচিত (যারা মুক্তিযোদ্ধা সন্তান নয়) তাদের বাবা-মা বড় ভাই-ভাবিদের প্রশ্ন করা হোক- কেন তারা মুক্তিযুদ্ধে যায়নি? তাদের পায়ে তো কেউ শেকল দিয়ে রাখেনি। তা না করে তারা ভিসির বাড়ি আক্রমণ করেছে, ভিসি ও তার পরিবার লুকিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছেন। অথচ ভিসি কোটা সংরক্ষণ বা সংস্করণের ব্যাপারে কোন ক্ষমতা রাখেন কী, এর কোন পর্যায়ে কি তার কোন দায়িত্ব আছে? কাগজে দেখলাম এক ছাত্র বুকে-পিঠে ‘আমি রাজাকার’ লিখে আন্দোলনকারীদের মধ্যে ঘুরে বেড়িয়েছে- এই ধৃষ্টতা কেন? এ প্রশ্নও নিশ্চয়ই করা যায়? এভাবে আন্দোলনটি শেষের দিকে সহিংস হয়ে ওঠে। এর পেছনে রয়েছে শিবির ও ছাত্রদলের ইন্ধন। দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে বিদেশে পলাতক তারেক রহমান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষক-নেতার মধ্যকার টেলিফোনিক কথোপকথনে প্রশ্নের জবাব বেরিয়ে আসে। অবশ্য এ আন্দোলনে সিপিবিপন্থী ছাত্রকর্মীরাও পেছন থেকে ইন্ধন যুগিয়েছে। সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম কয়েকদিন আগে প্রথম আলোতে দেয়া এক ইন্টারভিউতে বলেছেন তারা এখন সরকারবিরোধী রাজনীতি করছেন। তা ভাল, খাল কাটা ছেড়ে যখন উঠে এসেছেন তখন প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালানো উচিত নয় কী? পেছন থেকে ‘ফুঁ’ দেয়া কেন? তারপর এর স্পর্শকাতর একটি আগ্রাসন। সড়ক দুর্ঘটনায় দুজন ছাত্রের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে প্রাথমিক-মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্রছাত্রীরা ইউনিফরম পরে রাজপথে নেমে আসা এবং বিভিন্ন যানবাহনের বৈধতা তল্লাশি করে। অপরাধীদের ধরে পুলিশে দেয়। প্রধানত শিশু-কিশোরদের আন্দোলন এবং অহিংস। একে সহিংস করার জন্য কোটা আন্দোলনের পেছনের শক্তি আবার মাঠে নামে। এবার তারা স্ট্র্যাটেজি বেঞ্চ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজবের আশ্রয় নেয়। মাঠে নামায় অভিনেত্রী নওশাবাকে। এমন খবরও পরিবেশন করে যে, আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানম-ির ৩ নম্বরের অফিস ৩-৪টি মেয়ের ওপর গণর‌্যাপ হচ্ছে, এরই মধ্যে কয়েকটি ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে! আন্দোলন এতে সহিংস হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ অফিস থেকে আন্দোলনকারীদের ভেতরে আহ্বান করা হয় তল্লাশি করতে, আদৌ ওই ধরনের কোন ঘটনা ঘটেছে কী-না? ছাত্ররা দেখাতে পারেনি। যা মিথ্যা তার অস্তিত্ব কোত্থেকে আসবে? এখানে কিছুটা সংঘর্ষও হয়। আরেকটি বিষয় দেখা দরকার। আন্দোলনকারীদের সবাই ছিল শিশু-কিশোর। শেষের দিকে হঠাৎ দেখা গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিণত বয়সী ছাত্ররা মাঠে নেমেছে। এমন খবরও রয়েছে, বিভিন্ন কম্পিউটার দোকানে তখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আইডি কার্ড বানানোর এবং টেইলারিং দোকানে ইউনিফরম বানানোর ধুম পড়ে যায়। কারা এরা? এরাই ষড়যন্ত্রকারী? এরাই একটি অহিংস আন্দোলনকে সহিংসতার পথে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। পেট্রোলবোমা মেরে, রাস্তা-গাছ কেটে দেশ অচল করতে চেয়েছিল, হেফাজতের শাপলা চত্বরের আন্দোলনে খালেদার ‘সব রকম সহিযোগিতার নির্দেশ’ বা আড়াই হাজার লোক মারার খবর ছড়িয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর নতুন পথ ধরেছিল। তাও ব্যর্থ হলো? এখানেই দেশপ্রেমিক জনগণ এবং স্বাধীনতার মূলধারার শক্তির দাবি- উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিশন করে ’৭১, ’৭৫, ২০০৪, ২০১৩, ২০১৪, ২০১৫ এবং সর্বশেষ ২০১৮-এর চক্রান্তের কালো পর্দা উন্মোচন করা জরুরী হয়ে পড়েছে। ঢাকা ॥ ২৩ আগস্ট লেখক : সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব ও সিনেট সদস্য, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় [email protected]
×