চলে গেলেন তিনি পরপারে। পেছনে রেখে গেছেন কীর্তিময় জীবনকর্ম। দেশে দেশে যুদ্ধ, হানাহানি, সংঘাত, অমানবিকতার বিপরীতে ছিলেন তিনি শান্তি, সম্প্রীতি, মানবতা ও অহিংসার প্রতীক। শান্তিতে নোবেল পুরস্কারটি হয়েছিল তাই তার করতলগত। শান্তির অন্বেষণে তিনি বিশ্বের নানা প্রান্তে গিয়েছেন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে গঠন করেন ‘কোফি’ আনান ফাউন্ডেশন, নিজের নামেই। এই অলাভজনক স্বাধীন প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের শাসন ব্যবস্থা আরও কল্যাণমূলক করতে এবং সুন্দরতর ও শান্তিপূর্ণ একটি পৃথিবী গড়তে মানুষ ও দেশগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করে আসছে। প্রতিষ্ঠানটির মূলনীতিতে আছে অন্যায়হীন এবং শান্তিপূর্ণ সমাজ নির্ভর করে শান্তি ও নিরাপত্তা, টেকসই উন্নয়ন, মানবাধিকার ও আইনের শাসন- এই তিনটি স্তম্ভের ওপর। আর এর লক্ষ্য হচ্ছে কার্যকরী নেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক মধ্যস্থতার মাধ্যমে এই তিনটি স্তম্ভের বিপরীতে যেসব প্রতিবন্ধকতা আসতে পারে, যুদ্ধ সহিংসতা থেকে শুরু করে পাতানো নির্বাচন কিংবা জলবায়ু পরিবর্তন এসবকে প্রতিহত করে সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলতে এগিয়ে যাওয়া। কোফি আনান সম্পন্ন মানব বলেই এমন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পেরেছেন, যা বিশ্ব মানবের জন্য সর্বতোভাবে প্রয়োজন। গণহত্যা, যুদ্ধ ও ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যেও তিনি বিশ্বকে এক অবিস্মরণীয় ক্যারিশমাটিক নেতৃত্ব উপহার দিতে পেরেছিলেন। আজীবন মানবতার পক্ষে থাকা জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিবকে বলা যায় বিশ্ব নাগরিক। বর্ণাঢ্য ও চ্যালেঞ্জপূর্ণ কর্মজীবন তাকে উল্লেখযোগ্যভাবে বিবেক ও মানবতাবাদের সপক্ষে এক হিরণ¥য় কণ্ঠস্বরে পরিণত করেছিল। রুয়ান্ডা ও বসনিয়ায় গণহত্যা সংঘটনকালে তিনি জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীর প্রধান ছিলেন। জাতিসংঘের মহাসচিব থাকাকালে চেয়েছিলেন ইরাক যুদ্ধ থামাতে। মার্কিনী কৌশলের কারণে তা সম্ভব না হলেও এই যুদ্ধকে ‘অবৈধ যুদ্ধ’ হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে পেরেছিলেন। জাতিসংঘের ইতিহাসে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মহাসচিব হিসেবে তিনি শান্তি, টেকসই উন্নয়ন, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের চেতনার প্রদীপ শিখা সব সময় জ্বেলে রেখেছেন। নেলসন ম্যান্ডেলা প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সংগঠন দা এ্যান্ডারসের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনে উজ্জ্বলতার নিদর্শন রেখেছেন। ঘানার কোম্পানি শহরে জন্মগ্রহণ করা আনান অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার জেনেভা কার্যালয়ে কাজ করার মাধ্যমে জাতিসংঘে যোগদান করেন। পরবর্তীকালে তিনি জাতিসংঘ সচিবালয়ের আরও কিছু পদে কাজ করেছেন। ১৯৯৬ সালে নিরাপত্তা পরিষদ তাকে মহাসচিব নিযুক্ত করে। তিনিই প্রথম জাতিসংঘের নিজস্ব কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে মহাসচিব হন। ২০০১ সালে দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হন। ২০০৭ সালে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। মহাসচিব হিসেবে আনান জাতিসংঘের আমলাতন্ত্র সংস্কার করেন। এইচআইভি প্রতিরোধে কাজ করেন এবং জাতিসংঘ বৈশ্বিক চুক্তি সম্পাদন করেন। অবশ্য নিরাপত্তা পরিষদ সম্প্রসারণ না করায় তিনি সমালোচিত হন এবং জাতিসংঘের তেলের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচী নিয়ে তদন্তের পর তার পদত্যাগেরও দাবি উঠেছিল। সিরিয়া যুদ্ধের শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজতে জাতিসংঘের বিশেষ দূত হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু সঙ্কট সমাধানে জাতিসংঘের কাজে কোন অগ্রগতি না দেখে তিনি অব্যাহতি নিয়েছিলেন। ২০০১ সালে জাতিসংঘ এবং কোফি আনান যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করে। তিনি জাতিসংঘকে এমনভাবে গড়তে চেয়েছিলেন যে, এ সংস্থাটি যেন শুধু সদস্য রাষ্ট্রগুলো নয়, জনগণের স্বার্থ দেখবে। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি মানুষ তাকে নামে চেনে। বাঙালী তাকে আপনজন হিসেবেই বরণ করে নিয়েছিল। ২০০১ সালে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত জাতিসংঘ রিপোর্ট প্রকাশের পরপরই বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন তিনি। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে তাকে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থী সঙ্কট তদন্তে গঠিত একটি জাতিসংঘ কমিশনের প্রধান নিযুক্ত করা হয়। এই সঙ্কট নিরসনে আনান কমিশনের সুপারিশ সার্বিক বিচারে বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সমাদৃত এখনও। গত ১৮ আগস্ট সুইজারল্যান্ডের বার্নের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি। জন্মেছিলেন ১৯৩৮ সালের ৮ এপ্রিল। ৮০ বছরের সুদীর্ঘ জীবনে মানুষের সুখে-দুঃখে পাশে থেকেছেন। বিশ্ববাসীর জন্য তিনি প্রেরণা হয়ে থাকবেন। তার স্মৃতির প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা। তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবার ও স্বজনদের প্রতি সমবেদনা জানাই।
শীর্ষ সংবাদ: