ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

গ্রেনেড হামলা বার্ষিকীর সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী

২১ আগস্টের হত্যাযজ্ঞে খালেদা তারেক সরাসরি জড়িত

প্রকাশিত: ০৬:০২, ২৫ আগস্ট ২০১৮

 ২১ আগস্টের হত্যাযজ্ঞে খালেদা তারেক সরাসরি জড়িত

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলার ঘটনায় আবারও তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারকে অভিযুক্ত করে বলেছেন, এ হত্যাযজ্ঞে খালেদা জিয়া এবং তার ছেলে তারেক রহমান সরাসরি জড়িত, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। আওয়ামী লীগকে গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করাই ছিল তাদের পূর্বপরিকল্পনা। এরা (বিএনপি-জামায়াত) শুধু রক্ত নিতেই জানে। এদের উত্থানই হচ্ছে হত্যা, ক্যু, ষড়যন্ত্রের রাজনীতির মধ্যদিয়ে। এদের চরিত্র কখনও বদলাবে না। তারা কেবল সন্ত্রাস, দুর্নীতি, জঙ্গীবাদ, মানি লন্ডারিং, এতিমের অর্থ আত্মসাৎই করতে জানে, নিজেরা কেবল ভোগ করতে জানে। মানুষকে দিতে জানে না। কাজেই তাদের সম্পর্কে দেশবাসীকে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় নিহতদের স্মরণে মঙ্গলবার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আয়োজিত এক সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। এর আগে তিনি সেদিনের ঘটনাস্থল ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউর আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের নিচে শহীদদের স্মরণে নির্মিত অস্থায়ী বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগের যে কোন সমাবেশের নিরাপত্তা বজায় রাখতে স্বেচ্ছাসেবক এবং ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সমন্বয়ে গঠিত একটি স্বেচ্ছাসেবক গ্রুপ দায়িত্ব পালন করে থাকেন। তারা সাধারণত পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন ভবনের ছাদ থেকে এ দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু ওইদিন তাদের (স্বেচ্ছাসেবকদের) সমাবেশের আশপাশের কোন ভবনের ছাদে থাকার অনুমতি দেয়া হয়নি। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, কারা এ হামলায় জড়িত। তিনি বলেন, হামলার সময় সেখানে উপস্থিত সেনা গোয়েন্দা সংস্থার এক সদস্য তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ হেড কোয়ার্টারে ফোন করে এখানে কি হচ্ছে জানতে চাইলে তাকে ধমক দিয়ে সেখান থেকে সরে যেতে বলা হয়। যেসব পুলিশ কর্মকর্তা একটু সাহায্য করতে চেয়েছে তাদের তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকার ও বিএনপির পক্ষ থেকে তিরস্কার করে সেখান থেকে সরে যেতে বলা হয়। হতাহতদের সাহায্যে এগিয়ে না এসে পুলিশ বরং যারা সাহায্য করতে এসেছিল তাদের ওপর বেধড়ক লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে খুনীদের নির্বিঘেœ পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এদিন সমাবেশস্থলে এসেই প্রথমে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শহীদদের স্মরণে নির্মিত অস্থায়ী বেদিতে পুুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ দলের সিনিয়র নেতাদের নিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শহীদদের বেদিতে শ্রদ্ধা জানান। মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, জ্যেষ্ঠ আওয়ামী লীগ এবং ১৪ দলীয় জোট নেতৃবৃন্দ, ২১ আগস্টে নিহতদের পরিবার ও আত্মীয়-স্বজন এবং সেদিন যারা আহত হন তারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। এ সময় ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় নিহতদের রুহের মাগফিরাত ও আহতদের দ্রুত আরোগ্য এবং ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের শহীদদের স্মরণে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। পরে প্রধানমন্ত্রী নিহতদের পরিবার-পরিজন এবং আহতদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের এত মানুষ হতাহত হলো কিন্তু সেটা নিয়ে সংসদে সে সময় কোন কথা বলতে দেয়া হয়নি। কেউ কথা বলতে গেলেই মাইক বন্ধ করে দেয় আর সেটা নিয়ে নির্মম ব্যঙ্গোক্তি এবং হাসি-তামাশা-ঠাট্টা করা হয়। কোন শোক প্রস্তাবও আনতে দেয়া হয়নি। তিনি বলেন এমনও অপপ্রচার চালানো হয় এমনকি সংসদেও বলা হয়েছে, আমি নাকি ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড এনে এই হামলা চালিয়েছি। তিনি এ সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং বিএনপি নেতাদের দেয়া বক্তব্যগুলো স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, হামলার কয়দিন আগেই খালেদা জিয়া এবং বিএনপি নেতারা বলেছিলেন, ‘হাসিনা প্রধানমন্ত্রী তো দূরের কথা বিরোধী দলের নেতাও হতে পারবে না। আর আওয়ামী লীগ আগামী এক শ’ বছরেও ক্ষমতায় যেতে পারবে না।’ তিনি বলেন, এসব কথা বলার কারণ আওয়ামী লীগকে গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করাই ছিল তাদের পূর্বপরিকল্পনা। প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোটালিপাড়ায় আমার সমাবেশে ৭৬ কেজি এবং ৮৪ কেজি ওজনের দুটি বোমা পুঁতে রাখার আগেও বিএনপি এবং তাদের নেত্রী খালেদা জিয়া বলেছিলেন- আমাকে নাকি ১৫ আগস্টের ভাগ্যই বরণ করতে হবে! তিনি বলেন বাংলাদেশে এ ধরনের একটি নৃশংস ঘটনা ক্ষমতায় থেকে বিএনপি-জামায়াত জোটই ঘটিয়েছিল এতে কোন সন্দেহ নাই। ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর থেকেই এর আলামত সংরক্ষণ না করে আলামত ধ্বংসের চেষ্টা ছিল বিএনপি-জামায়াতের। যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত যে আর্জেস গ্রেনেড সেদিন ছোড়া হয়েছিল তার মধ্যে একটি গ্রেনেড ফোটেনি, সেটিও কিন্তু সংরক্ষণ করা হয়নি। সিটি কর্পোরেশন থেকে পানির গাড়ি এনে তরিৎ ঘটনাস্থল ধোয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায় এবং গ্রামের এক লোককে ধরে এনে তাকে দোষী সাজিয়ে ‘জজ মিয়া নাটক’ মঞ্চস্থ করা হয়। এর বিচার কাজ পরবর্তীতে তার সরকার শুরু করে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গ্রেনেড হামলা মামলার বিচার চলছে। আশা করি সেই বিচারের রায় বের হবে। তবে, আইভি রহমানসহ যারা মারা গেছেন তাদের আর কোন দিন ফিরে পাব না। আমি তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। এ সময় তিনি বলেন, ২১ আগস্টের ঘটনায় আহতদের চিকিৎসায় সম্ভব সবকিছুই করেছেন এবং যতদিন বেঁচে থাকবেন, করে যাবেন বলেও তাদের আশ্বস্ত করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এদেশের ১৫ আগস্টের খুনীদের মতো ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় জড়িতদেরও তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সরকার পুরস্কৃত করে এবং তাদের বাহবা দেয়। আর তাদের দুঃখ ছিল আমি কেন মরলাম না, আর এটারই তারা বার বার খবর নেয়ার চেষ্টা করে। ’৭৫ এ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ৬ বছর তাকে দেশে ফিরতে দেয়া হয়নি। দেশে ফিরে আসার পর হত্যার জন্য বার বার তার ওপর আঘাত এসেছে উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধুর কন্যা বলেন, বাংলাদেশের যেখানে গিয়েছি সেখানেই এই ধরনের পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছে। আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়েছেন। আর আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতাকর্মী জীবন বাজি রেখে আমাকে রক্ষা করেছেন। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা থেকেও নিজেদের জীবন বাজি রেখে তারা আমার জীবন রক্ষা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী পঁচাত্তরের পর থেকে বাংলাদেশে ১৯টি ক্যু সংঘটিত হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে বলেন, তখন বাংলাদেশ একটা রক্তাক্ত জনপদ ছিল। তারপর জঙ্গী-সন্ত্রাসবাদের অভয়ারণ্য ছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরই আমরা চষ্টা করেছি এই জঙ্গী-সন্ত্রাসবাদ বন্ধের। এখনও আমাদের বহু নেতাকর্মী হত্যা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াতের ঘাপটি মেরে থাকা সন্ত্রাসীরা দলে ঢুকে যায় এবং দলে ঢুকেই সেখানে গোলমাল করে আমাদেরই নেতাকর্মীকে হত্যা করে আমাদের ওপরই দোষ চাপায়। সে কারণে আমার একটা অনুরোধ থাকবে- যারা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মানুষ মারতে পারে, জাতির পিতাকে হত্যা করতে পারে, নারী ও শিশু হত্যা করতে পারে, যারা বিরোধী দলের সমাবেশে প্রকাশ্যে দিবালোকে গ্রেনেড হামলা চালাতে পারে- তারা (বিএনপি-জামায়াত জোট) কখনও দেশের কোন কল্যাণ করতে পারে না। দেশের কোন মঙ্গল করতে পারে না। দলের নেতাকর্মীদেরও বলব- এদের যেন দলে টেনে না আনে। আল্লাহর অশেষ কৃপায় বেঁচে গিয়ে তৃতীয়বারের মতো রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকতে পারায় দেশের মানুষের জন্য কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন উল্লেখ করে দেশবাসী এবং আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমার একটাই চেষ্টা যতক্ষণ বেঁচে আছি ততক্ষণ যেন এ দেশের দুঃখি মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা এবং ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়তে পারি। তার সরকারের সময়ে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠে আসার প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার পথেই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে, সেটাই আমি চাই। প্রধানমন্ত্রী এ সময় দেশবাসীকে ঈদ-উল-আযহার শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, এই ঈদও আত্মত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত একটি ঈদ। গ্রেনেড হামলার ১৪তম বার্ষিকী পালন ॥ এদিকে ইতিহাসের ঘৃণ্যতম গ্রেনেড হামলার ১৪তম বার্ষিকী মঙ্গলবার নানা কর্মসূচীর মধ্যদিয়ে পালিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠন, ১৪ দলভুক্ত অন্যান্য রাজনৈতিক দল এবং বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের উদ্যোগে নানা কর্মসূচীর মাধ্যমে এ দিবস পালিত হয়। ২০০৪ সালের পর থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত জনগণ প্রতিবছর ২১ আগস্টকে গ্রেনেড হামলা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। সোমবার দিবাগত মধ্যরাত ১২টা ১ মিনিটে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে মোমবাতি প্রজ্বলন করে গ্রেনেড হামলা দিবসের কর্মসূচী শুরু হয়। এ সময় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা গ্রেনেড হামলায় নিহত ২৪ জনের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নীরবতা পালন করেন। দিবসটি উপলক্ষে মঙ্গলবার সকাল ১০টায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউর আওয়ামী লীগের নবনির্মিত কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সেদিনের ঘটনাস্থলে শহীদদের স্মরণে নির্মিত অস্থায়ী বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধা জানান। এ সময় আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাংগঠনিক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, শ্রম বিষয়ক সম্পাদক হাবিবুর রহমান সিরাজ, দফতর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, উপ-দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। পরে প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় নিহতদের স্মরণে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আয়োজিত এক সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। এ সময় ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় নিহতদের রুহের মাগফিরাত ও আহতদের দ্রুত আরোগ্য এবং ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের শহীদদের স্মরণে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করার পর ১৪ দলীয় জোট, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তর ও দক্ষিণ, আওয়ামী যুবলীগ, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগ, যুব মহিলা লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, তাঁতীলীগ, ২১ আগস্টে নিহতদের পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনরা শহীদদের স্মরণে বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
×