ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

দেশজুড়ে এবার জাতীয় নির্বাচনের হাওয়া, বাড়ছে ভোটের উত্তাপ

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২৫ আগস্ট ২০১৮

 দেশজুড়ে এবার জাতীয় নির্বাচনের হাওয়া, বাড়ছে ভোটের উত্তাপ

শাহীন রহমান ॥ সিটি নির্বাচনের পর এবার বইছে একাদশ জাতীয় নির্বাচনের হাওয়া। নির্বাচন কমিশনের মনোযোগ এখন একাদশ জাতীয় নির্বাচন ঘিরে। নির্বাচন নিয়ে পুরো প্রস্তুতি রয়েছে ইসির। রাজনৈতিক অঙ্গনেও মূল আলোচনার বিষয় জাতীয় নির্বাচন। সময় যত এগিয়ে আসছে নির্বাচনী উত্তাপ ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভেতরে ভেতরে সব দলের মধ্যে নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। সম্ভাব্য প্রার্থীরা মাঠে নেমে পড়েছেন। বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে পরিষ্কার কিছু না বললেও তৃণমূলে দলের নেতাকর্মীরাও নির্বাচনী মাঠে নেমে পড়েছে। নির্বাচন ঘিরে বিভিন্ন দলের প্রার্থী মনোনয়ন, প্রার্থী বাছাই ও তৃণমূলের গণসংযোগও ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। আগামী ৩০ অক্টোবর থেকেই একাদশ জাতীয় নির্বাচনের কাউন্টডাউন শুরু হয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদ নির্বাচন করতে হবে। বর্তমান সংসদের যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালের ২৯ জানুয়ারি। সেই হিসেবে দিন গণনা শুরু হবে ৩০ অক্টোবর থেকে। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন কমিশনের সব কর্মকান্ড এখন জাতীয় নির্বাচন ঘিরে। সামনে আর কোন বড় নির্বাচন না থাকায় জাতীয় নির্বাচনের দিকেই ইসির একমাত্র মনোনিবেশ। তারা জানায় জাতীয় নির্বাচনের প্রাথমিক প্রস্তুতি সেপ্টেম্বরের মধ্যে শেষ করতে চায় ইসি। এরপর তফসিল ঘোষণা থেকে শুরু করে নির্বাচন পরিচালনা সংক্রান্ত বিষয় কমিশনের বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শেষ করবে তারা। কমিশন সচিব হেলালুদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন ইতোমধ্যে প্রস্তুতির ৮০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি কাজ কমিশনের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাস্তবায়ন করা হবে। ইসির রোডম্যাপ অনুযায়ী সংসদীয় ৩শ’ আসনের সীমানা গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। চূড়ান্ত করা হয়েছে ভোটার তালিকাও। তারা জানিয়েছেন, এ বছর নতুন করে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা হচ্ছে না। বিদ্যমান ভোটার তালিকা দিয়েই একাদশ জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা করা হবে। এছাড়াও সারাদেশে ভোট কেন্দ্রের চূড়ান্ত তালিকাও ইতোমধ্যে প্রকাশ করা হয়েছে। নির্বাচনের জন্য ৪০ হাজার ভোট কেন্দ্রে চূড়ান্ত করেছে। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেবেন প্রায় ১০ কোটি ৪২ লাখ ভোটার। নির্বাচন সুষ্ঠ এবং অংশগ্রহণমূলক করতেও ইসির পক্ষ থেকে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানা গেছে। ইসির রোডম্যাপ অনুযায়ী এবার নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন দেয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত যোগ্যতা প্রমাণ না করায় কোন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন পায়নি। যদিও নিবন্ধনের জন্য আবেদন ছিল ৭৫ রাজনৈতিক দলের। এবার ৩৯ রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। ইসির নিবন্ধিত দলের সংখ্য ৪০ হলেও এবার একটি রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল করে দিয়েছে ইসি। এছাড়াও আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকায় জামায়াত রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না। আগামী একাদশ জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদা বলেন, নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হলে অনিয়ম করার সুযোগও পায় না কেউ। সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আইনশৃৃঙ্খলা বাহিনী থাকবে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হবে। কমিশনের পক্ষ থেকে যা যা ব্যবস্থা নেয়ার নেয়া হবে। তিনি বলেন, নির্বাচনকালীন সরকারের সময় শুরুর পর সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে কমিশন ভোটের তারিখ চূড়ান্ত করবে। অক্টোবর থেকে সময় শুরু হবে। নবেম্বরের শুরুতে তফসিল ঘোষণা হতে পারে। শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষা, বিশ্ব ইজতেমাসহ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে এ বিষয়ে বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তিনি বলেন, প্রতিদ্বন্দ্বীরা মাঠে থাকলে যে কোন অনিয়ম প্রতিরোধ হবে। আশা করি সংসদ নির্বাচন প্রতিযোগতামূলক হবে। কেউ যদি মাঠেই না থাকে তাহলে তো যারা মাঠে থাকে তাদের অবস্থান বেশি দেখা যায়। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা যত বেশি শক্তভাবে মাঠে থাকবেন, উপস্থিতি থাকবে অনিয়ম প্রতিরোধ করবে তারাই। ইসি কর্মকর্তারা জানান, জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি সামনে রেখে সব ধরনের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যেই প্রাথমিক প্রস্তুতি তারা সম্পন্ন করতে চায়। নির্বাচনী মালামাল তথা স্ট্যাম্প প্যাড, অফিসিয়াল সিল, মার্কিং সিল, অমোচনীয় কালি ইত্যাদি কেনাকাটা ও ব্যালট পেপার, নির্দেশিকা, ম্যানুয়াল ছাপানোর কাগজ ক্রয়সহ অন্যান্য কাজ এগিয়ে চলেছে। সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণের জন্য ৩৪ লাখ ৪০ হাজার স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স কেনা হবে। প্রয়োজন হবে প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার রিম কাগজ। এদিকে ভোটের মালপত্র কেনার পাশাপাশি নির্বাচনী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন। শেষ সময়ে এসে আরপিও সংশোধনের বিষয় নিয়ে ভাবছে ইসি। ইসির কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী এই বছর ফেব্রুয়ারির মধ্যেই আরপিওসহ প্রয়োজনী নির্বাচনী আইন প্রণয়ন ও সংশোধনের উদ্যোগ থাকলে তা করা হয়নি। শেষ সময়ে এখন ইভিএম (ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন) আরপিওতে অন্তর্ভুক্ত করতে সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম বলেন, আরপিও পর্যালোচনার মধ্যে রয়েছে। এতে কমিশনের কিছু পরামর্শ ও পর্যবেক্ষণ ছিল। তারা এ বিষয়ে কাজ করছেন। দশম জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশনে সেটা তুলে ধরার চেষ্টা করবেন। তিনি বলেন, জাতীয় সংসদের সব কেন্দ্রে ইভিএম করতে হলে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। ইভিএম ব্যবহারের বিষয়টি আরপিওতে অন্তর্র্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত কমিশনের রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। এবারের জাতীয় নির্বাচনে প্রায় ১০ কোটি ৪২ লাখ ভোটারের ভোটগ্রহণের জন্য আনুমানিক ৪০ হাজার ভোট কেন্দ্রের তিন লাখ বুথে ভোট নেয়ার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। ইতোমধ্যে এসব ভোট কেন্দ্রের খসড়া প্রকাশ করা হয়েছে। ৬ সেপ্টেম্বর চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হচ্ছে। ইসি কর্মকর্তারা বলেন, নবম সংসদে ৮ কোটি ১০ লাখের বেশি ভোটারের জন্য ভোটকেন্দ্র ছিল ৩৫ হাজার ২৬৩। দশম সংসদ নির্বাচনে ৯ কোটি ১৯ লাখ ভোটারের বিপরীতে ভোটকেন্দ্র ছিল ৩৭ হাজার ৭০৭। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ৩শ’ আসনের সীমানা পুনঃনির্ধারণ সম্পন্ন হয়েছে। এতে ২৫ সংসদীয় আসনে পরিবর্তন আনা হয়েছে। ইসি কর্মকর্তারা জানান, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও নির্বাচন পরিচালনার জন্য ৬শ’ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। দশম সংসদ নির্বাচনে ২৫০ কোটি টাকার মতো খরচ হয়েছিল ইসির। সূত্র জানায়, যেহেতু অর্ধেকেরও বেশি আসনে ভোট হয়নি, তাই গতবার খরচ কম হয়েছে। নির্বাচনের জন্য তারা এবার বাজেটে ১ হাজার ২শ’ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছে ইসি। এর মধ্যে সংসদ নির্বাচনের জন্য ৬৭৫ কোটি টাকা, উপজেলা পরিষদের জন্য ৫৭৫ কোটি টাকা, পৌরসভার জন্য ৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা এবং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের জন্য ১১ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। এছাড়া অবশিষ্টাংশ অন্য নির্বাচন/উপনির্বাচনের জন্য বরাদ্দ পেয়েছে। তবে জানা গেছে, জাতীয় নির্বাচনে ব্যাপকভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েনের চিন্তাভাবনা থাকলেও সেনাবাহিনী মোতায়েন বিষয়ে এখনও কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। তফসিল ঘোষণার পরই কেবল এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে সেনা মোতায়েনে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া না হলেও আগামী নির্বাচনে সেনাবাহিনী থাকছে এ বিষয়ে মোটামুটি নিশ্চিত। এর আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার একাধিকবার বলেন, আগের সব নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। আগামী নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় আসেনি। সময় হলেই এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে যথারীতি র‌্যাব, বিজিবি, পুলিশ ও আনসার জাতীয় নির্বাচনে মোতায়েন থাকছে। নির্বাচন ব্যবস্থাপনা ও সমন্বয় শাখার কর্মকর্তারা জানান, জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর কর্মকর্তা নিয়োগ, মন্ত্রিপরিষদসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা, রিটার্নিং কর্মকর্তার জন্য পরিপত্র জারি, আচরণবিধি প্রতিপালন, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগ, নির্বাচনী তদন্ত কমিটি গঠন, নির্বাহী ও বিচারিক হাকিম নিয়োগের ব্যবস্থা, ভোটকেন্দ্রের গেজেট প্রকাশ, সাংবাদিক-পর্যবেক্ষকদের অনুমতি, মাঠ পর্যায়ে সামগ্রী বিতরণ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করা হবে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা পাওয়ার পর ব্যালট পেপার মুদ্রণের ব্যবস্থা নেয়া হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা, রিটার্নিং কর্মকর্তা, মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে সভা এবং আইনশৃঙ্খলা প্রধানদের সঙ্গে ‘বিশেষ পর্যালোচনা বৈঠক’ কমিশন নির্ধারণ করবে। বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে। দায়িত্ব নেয়ার পর কুমিল্লা ও রংপুর সিটি কর্পোরেশনের ভোট করে প্রশংসিত হয় নূরুল হুদার কমিশন। তবে এরপর খুলনা, গাজীপুর, রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট সিটির ভোটে অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় সমালোচনার মুখে পড়তে হয় বর্তমান ইসিকে। অবশ্য জানা গেছে, আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে খুলনা, গাজীপুর ও সর্বশেষ তিন সিটি (বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেট) নির্বাচনে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনার অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চায় কমিশন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রস্তুতির নিচ্ছে কমিশন। আগামী ৩১ অক্টোবর থেকে ২৮ জানুয়ারির মধ্যে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেই অনুযায়ী জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি রয়েছে নির্বাচন কমিশন।
×