ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শেখ হাসিনা বেঁচে যাওয়ায় জঙ্গীদের নীলনক্সা ভেস্তে যায়

প্রকাশিত: ০৪:৫৬, ২১ আগস্ট ২০১৮

  শেখ হাসিনা বেঁচে যাওয়ায় জঙ্গীদের নীলনক্সা ভেস্তে যায়

গাফফার খান চৌধুরী ॥ একুশে আগস্ট শেখ হাসিনাকে হত্যা করা সম্ভব হলে বাংলাদেশের সব জঙ্গী সংগঠনের এককাতারে চলে আসার কথা ছিল। তাদের পরবর্তী টার্গেট ছিল দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা। তারই অংশ হিসেবে জেএমবি ইতোপূর্বে সিরিজ বোমা হামলা করেছিল। পুরো এই প্রক্রিয়াটির সঙ্গে জড়িত ছিল স্বাধীনতা বিরোধীরা। স্বাধীনতা বিরোধীদের গঠিত ইসলামী দলটি থাকত মূল নেতৃত্বে। আর মাঠ পর্যায়ে নেতৃত্ব দেয়ার কথা ছিল হুজি ও জেএমবির। এই দুইটি জঙ্গী সংগঠনের পুরো দেশের সবকটি জঙ্গী সংগঠনকে নিয়ন্ত্রণ করার কথা ছিল। পুরো পরিকল্পনা ভেস্তে যায় শেখ হাসিনা বেঁচে যাওয়ায়। এরপর একের পর এক সাঁড়াশি অভিযানের মুখে রীতিমতো অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে এক সময়ের দুনিয়া কাঁপানো নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন হুজি (হরকত-উল জিহাদ)। তবে এখনও হুজির বেশ কিছু সদস্য পলাতক রয়েছে। এরমধ্যে কক্সবাজারের উখিয়ার একটি জঙ্গী প্রশিক্ষণ ক্যাম্প থেকে গ্রেফতার হওয়ার পর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে জামিনে ছাড়া পাওয়াদের মধ্যে অন্তত ১১ জন রয়েছে। বাকি ৩০ জন বিভিন্ন সময় র‌্যাব ও পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি সূত্রে আরও জানা গেছে, শুধু শেখ হাসিনা নয়, আওয়ামী লীগের শীর্ষ সব নেতাই ছিলেন হুজির টার্গেটে। একুশে আগস্ট শেখ হাসিনাসহ তার সঙ্গে থাকা শীর্ষ নেতারা মারা গেলে টার্গেটকৃত অন্য নেতাদের পর্যায়ক্রমে হত্যার টার্গেট ছিল হুজির। হত্যার টার্গেটে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা থাকলেও, জামায়াতের কোন নেতাই হুজির হত্যার টার্গেটে ছিল না। তবে জামায়াত বিদ্বেষী কয়েকজন বিএনপি নেতাও হুজির হত্যার টার্গেটে ছিল। সূত্রটি বলছে, দেশে জঙ্গীবাদের গোড়াপত্তন হয় মূলত আফগান যুদ্ধের সূত্রধরে। মুফতি হান্নানের বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়ায়। তিনি গোপালগঞ্জের গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসা ও বরিশালের শর্ষিনা আলিয়া মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেন। পরে ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে দাওরা হাদিস পড়াকালে ১৯৮৭ সালে ওই দেশের আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক শিক্ষায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৮৮ সালে তিনি পাকিস্তানের করাচির জামিয়া ইউসুফ বিন নুরিয়া মাদ্রাসায় ফিকাহশাস্ত্রে পড়াশোনা করেন। পড়াশোনার মধ্যেই আফগানিস্তানের খোস্ত শহরে একটি জঙ্গী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে ভারি অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নেন। এরপর যোগ দেন যুদ্ধে। এদিকে ১৯৮৯ সালে আফগান যুদ্ধ করে যশোরের বাসিন্দা আব্দুর রহমান ফারুকী দেশে ফেরেন। তিনি হরকত-উল জিহাদী ইসলামী নামের একটি দল গঠন করেন। পরে সেটি হরকত-উল-জিহাদ অব বাংলাদেশ সংক্ষেপে হুজিবি হয়। পরে হুজিবিই হুজি হয়। আব্দুর রহমান ফারুকী হুজিবির আমীর নিযুক্ত হন। আমীর থাকা অবস্থায়ই তিনি ১৯৮৯ সালে আবার আফগানিস্তানে চলে যান। ১৯৯০ সালে আফগানিস্তানের নজীবুল্লাহ সরকারের সঙ্গে আফগান মুজাহিদদের এক যুদ্ধে তার মৃত্যু হয়। ওদিকে আফগান যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও মুফতি হান্নান আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের বিভিন্ন জঙ্গী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে গ্রেনেডসহ শক্তিশালী বিস্ফোরক তৈরি ও পরিচালনা, ভারি আগ্নেয়াস্ত্র চালনা, তৈরি ও মজুদসহ সমরাস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষিত হন। সেখানে তার সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আল কায়েদা, লস্কর-ই-তৈয়েবা, পাকিস্তানভিত্তিক বিভিন্ন আত্মঘাতী জঙ্গী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ১৯৯৩ সালে তিনি দেশে ফেরেন। প্রথমে তিনি শীর্ষ ছয় জঙ্গীর মধ্যে শায়খ আব্দুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাইসহ অনেক আফগান ফেরত যোদ্ধা আহলে হাদিস আন্দোলনের তাত্ত্বিক নেতা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের অধ্যাপক ড. আসাদুল্লাহ আল গালিবের সঙ্গে যোগ দেন। গালিব মানুষ বুঝিয়ে ইসলামের পথে আনার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু শায়খ রহমান, বাংলা ভাই ও মুফতি হান্নানের বক্তব্য বুঝিয়ে মানুষকে ইসলামের পথে আনা সম্ভব নয়। বাংলাদেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে জিহাদের কোন বিকল্প নেই। এরপর আহলে হাদিস আন্দোলন থেকে এ তিন জন তাওহীদি ট্রাস্টের একটি বড় অঙ্কের টাকা নিয়ে আসেন। পরে শায়খ আব্দুর রহমান ও বাংলা ভাই জেএমজেবি পরবর্তীতে জেএমবি গঠন করেন। আর মুফতি হান্নান রাজধানী তালতলায় জাগো মুজাহিদ নামে একটি অফিস খুলে বসেন। পরে তিনি হুজিবিতে যোগ দেন। হুজিবিই পরবর্তীতে হুজি নাম ধারণ করে। মুফতি হান্নান হুজিবির কোটালীপাড়া উপজেলার থানা প্রচার সম্পাদক ছিলেন। সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে স্বল্প সময়ের মধ্যেই তিনি হুজিবির শীর্ষ নেতৃত্বে চলে আসেন। দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে একের পর এক বোমা হামলা চালিয়ে আলোচনায় আসে হুজি। ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে ১০ জনকে হত্যা ও দেড়শ’ জনকে আহত করে আলোচনায় চলে আসে হুজি। একই বছরের ৮ অক্টোবর খুলনা শহরের আহমদিয়া মসজিদে বোমা হামলা করে আট জনকে হতা করে হুজি। ২০০০ সালে জুলাইয়ে কোটালীপাড়ায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভাস্থলের কাছাকাছি ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রেখে রীতিমত হৈচৈ ফেলে দেয় মুফতি হান্নান ও তার দল হুজি। এরপর থেকেই আত্মগোপনে থেকে তৎপরতা চালাতে থাকেন। ২০০১ সালে ঢাকায় সিপিবির সমাবেশে, রমনার বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানসহ ছয়টি বোমা হামলার ঘটনা ঘটায় জঙ্গীরা। এরপর শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালায় হুজি। ওই বছরের ২১ মে সিলেটে হজরত শাহজালাল (র.) মাজারে বাংলাদেশে তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর এবং ৭ আগস্ট সিলেটের তৎকালীন মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের ওপর গ্রেনেড হামলা চালায় হুজি। সর্বশেষ ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জে এক সমাবেশে গ্রেনেড হামলা করে আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়াসহ পাঁচজনকে হত্যা করে হুজি। এ ব্যাপারে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির সাবেক জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল কবীর জনকণ্ঠকে বলেন, ২০০৫ সালের ১ অক্টোবর রাজধানীর বাড্ডার বাসা থেকে র‌্যাব মুফতি হান্নানকে গ্রেফতার করে। হান্নানের তথ্য মোতাবেক, শুধু শেখ হাসিনা নয়, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারাও ইসলামের শত্রু। শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে পারলেই দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা সম্ভব। এ জন্য শুধু শেখ হাসিনা নয়, আওয়ামী লীগের সব শীর্ষ নেতা হুজির হত্যার টার্গেটে ছিলেন। এ জন্য হামলার টার্গেট হিসেবে একুশে আগস্টকে বেছে নিয়েছিল হুজি। যাতে ওই হামলায় শেখ হাসিনাসহ সঙ্গে থাকা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের মৃত্যু হয়। যেসব নেতারা বেঁচে যেতেন বা যারা সমাবেশের বাইরে থাকতেন, পরবর্তীতে তাদের পর্যায়ক্রমে হত্যার টার্গেট ছিল হুজির। এককথায় পুরোপুরি আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার টার্গেট ছিল জঙ্গী সংগঠনটির। সিআইডির এই সাবেক কর্মকর্তা বলছেন, তবে জামায়াত বা বিএনপির নেতারা হুজির হত্যা টার্গেটে ছিল বলে আমার জানা নেই। পারস্পরিক যোগাযোগ বা সহযোগিতাসহ নানা কারণেই জামায়াত বা বিএনপির কোন নেতাই হুজির হত্যার টার্গেটে ছিল না। তবে বিষয়টি একেবারেই স্পষ্ট নয়। জানা গেছে, হুজিতে ছাত্র শিবির থেকে আফগান যুদ্ধে অংশ নেয়া অনেক যোদ্ধা ছিল। এ জন্যই জামায়াতের কোন নেতা হুজির টার্গেটে ছিল না। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, হুজি জঙ্গীরা অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়াকে হত্যার পর রীতিমত আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যায়। এরপর হাল ধরে জেএমবি। তারা ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সিরিজ বোমা হামলা করে সারাদেশে তাদের শক্তিমত্তার জানান দেয়। এমন হামলার পর জেএমবি সারাদেশে ইসলামী হুকুমত কায়েমের ঘোষণা দেয়। সিআইডির একজন উর্ধতন কর্মকর্তা মুফতি হান্নানের বরাত দিয়েছে জানিয়েছেন, হুজির মামলায় শেখ হাসিনা মারা গেলে দেশের দৃশ্যপট পাল্টে যেত। জেএমবি পুরো দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে মরিয়া হয়ে পড়ত। তাতে মদদ জোগাত বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধীরা এবং আন্তর্জাতিক চক্র ও জঙ্গী সংগঠনগুলো। এমনই ছক ছিল। হুজি এবং জেএমবি পুরো দেশের জঙ্গী সংগঠনের নেতৃত্বে চলে আসত। তাদের নিয়ন্ত্রণ করত স্বাধীনতা বিরোধীদের গঠিত ইসলামী দলটি। হুজির আর সে ক্ষমতা নেই। তবে জঙ্গী সংগঠনটির কিছু প্রশিক্ষিত সদস্য এখনও পলাতক আছে। যারা পলাতক রয়েছেন তাদের অধিকাংশই ১৯৯৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারের উখিয়া থেকে জঙ্গী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে ট্রেনিংরত অবস্থায় গ্রেফতার হয়েছিলেন। ওইদিন পুলিশের সাঁড়াশি অভিযানে হুজির ৪০ সদস্যকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। আদালত গ্রেফতারকৃত হুজি সদস্যদের যাবজ্জীবন সাজা মঞ্জুর করেন। র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জানান, সাঁড়াশি অভিযানের মুখে হুজি এখন বিলুপ্তির পথে। তাদের অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে। হুজির আর বড় ধরনের কোন নাশকতা চালানোর ক্ষমতা নেই। তাদের সে রকম কোন জনবল নেই। তবে মাঝে মধ্যেই চলমান সাঁড়াশি অভিযানে দু’একজন গ্রেফতার হয়। গ্রেফতারকৃতরা হুজির আদর্শিক সদস্য। তারা বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত নয়। হুজিতে এখন আর প্রশিক্ষিত সদস্য নেই বললেই চলে।
×