ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন

শোকাবহ ও ষড়যন্ত্রময় আগস্ট

প্রকাশিত: ০৪:৪১, ২১ আগস্ট ২০১৮

 শোকাবহ ও ষড়যন্ত্রময় আগস্ট

রাজনীতিতে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ,সহমর্মিতা ও পরমত সহিষ্ণুতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে শুধুমাত্র ‘আগস্ট’ মাস কেন্দ্রিক রাজনীতির অপচর্চা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থানকে হেয় করে দিয়েছে। আগস্ট মাসের ইতিহাস বাঙালী জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কময়, নারকীয় হত্যাকান্ড,স্বাধীনতার অপশক্তিদের বুনো উল্লাসে মেতে ওঠার ইতিহাস। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের চেহারা বদলে যাওয়ার যাত্রা শুরু হয়েছিল। ঠিক তখনি লুকিয়ে বিচরণ করা পাকিস্তানী প্রেতাত্মারা নারকীয় হত্যাকান্ড সংঘটিত করে বাংলাদেশের বুকে কালিমা লেপন করে। একই সঙ্গে থামিয়ে দেয়া হয় বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সকল সরকারী চাকরিতে দুটি পক্ষের জন্ম হয়। এদের একটি স্বাধীনতার পক্ষে ছিল (বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা), আরেকটি পক্ষ মনেপ্রাণে পাকিস্তানী শাসন চেয়েছিল এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব স্বীকার করতে কষ্ট পেত (অমুক্তিযোদ্ধা)। সামরিক বাহিনীতেও এ রকম একটি স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ছিল যারা সব সময় বিশৃঙ্খলতা সৃষ্টি করার অপচেষ্টা চালিয়ে যেত। তাদের এই অপচেষ্টা সফল হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে। ১৯৭২-৭৫ সালের মাঝে বামপন্থী দলগুলোর আত্মপ্রকাশ,তাদের সশস্ত্র শাখাগুলোর অপতৎপরতা,সামরিক বাহিনীতে ঘাপটি মেরে বসে থাকা স্বাধীনতার বিপক্ষীয় সেনা কর্মকর্তা ও বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত লোকদের বিশ্বাসঘাতকতা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক রক্তাক্ত ও কলঙ্কময় অধ্যায়ের সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। রাজনীতি হোক বা সামাজিক ক্ষেত্র হোক, এসবে সবসময় আপন মানুষগুলোই ক্ষতি করে থাকে। কেননা তারা আপনার সবলতা বা দুর্বলতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সবচেয়ে বিশ্বস্ত ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ এবং তিনিই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছিলেন। সৈয়দ ফারুক আহমেদ, শরীফুল হক ডালিম, খন্দকার আব্দুর রশীদ, মহিউদ্দিন আহমেদ, একেএম মহিউদ্দিন আহমেদ, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা, নূর চৌধুরীসহ কতিপয় উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তার নেতৃত্বে একদল বিপথগামী সেনাসদস্যের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড সংঘটিত করার অন্যতম কারিগর ছিলেন এই মোশতাক। এছাড়া কিছু সংখ্যক বিদেশী গোয়েন্দা, সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি, সেনা প্রধান একেএম শফিউল্লাহ,উপপ্রধান মেজর জিয়া, এয়ার ভাইস মার্শাল আমিনুল ইসলাম খানও এই হত্যাকান্ড সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোররাতে এই নারকীয় হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বেগম মুজিব, ছোট ভাই শেখ নাসের, তিন পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, ১০ বছরের শিশুপুত্র শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধূ, দুই কাজের লোক ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি ও স্ত্রী,শ্যালক আব্দুর রব সেরনিয়াবাতসহ কেউই রক্ষা পাননি সেই রাতের হত্যাকা- থেকে। বঙ্গবন্ধু কন্যা আজকের প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করায় সেদিন প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। সেদিন কড়া নিরাপত্তায় হেলিকপ্টারে বঙ্গবন্ধুর নিজ গ্রামে লাশ পৌঁছায় কিন্তু বঙ্গবন্ধুর লাশও সকলকে দেখতে দেয়া হয়নি। এমনকি লাশ গোসল না করিয়েই দাফনের নির্দেশ দিয়েছিলেন সেনা কর্মকর্তারা। যদিও শেষ পর্যন্ত গোসল করিয়েই কড়া নিরাপত্তায় দাফন করা হয়েছিল। লাশ দাফনের পর কবর পাহারা দেয়ার জন্য নিয়োগ করা হয়েছিল ১৫-২০ সেনাসদস্য, বঙ্গবন্ধুর মৃতুুর পর সেখানকার মসজিদে মিলাদ আয়োজন করতেও দেয়া হয়নি। ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে টানা ২১ বছর বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ প্রচার করতেও দেয়া হয়নি। সেদিনকার খবরের কাগজগুলোতেও গুরুত্ব পায়নি এই মহানায়কের নির্মমভাবে প্রস্থানের সংবাদ। বিশ্বাসঘাতকার ফলে রাষ্ট্রপতির পদে আসীন হয়েছিলেন মীরজাফর খ্যাত মোশতাক। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচারকার্য। বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের জন্ম, শুরু হয় সামরিক শাসন। চলে টানা ১৫ বছর। বিচারপতি আবু সাদাত মোঃ সায়েম দেশ পুনর্গঠনের চেষ্টাকালে ১৯৭৭ সালে আবু সায়েমকে পদত্যাগে বাধ্য করে ক্ষমতা দখল করেন মেজর জিয়া। তিনিই সেই মেজর জিয়া, যিনি আজকের জনসমর্থনহীন দল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা। মুজিব হত্যাকা-ের পর সেনাকর্মকর্তা শাফায়াত জামিলের কাছে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর খবর শুনে বিস্মিত না হয়ে বলেছিল, ‘সো হোয়াট? লেট ভাইস প্রেসিডেন্ট টেক ওভার। উই হ্যাভ নাথিং টু ডু উইথ পলিটিক্স’। মেজর জিয়া ক্ষমতা লোভ ও হত্যাযজ্ঞের ওপর ভিত্তি করে যেই বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিল জনমনের বিপরীত ধারায় অবস্থান করেও সেই দলটি আজও ক্ষমতা দখল ও নোংরা রাজনীতির খেলায় মেতে রয়েছে। দলটি যতবারই ক্ষমতায় এসেছে ততবারই স্বাধীনতার স্বপক্ষীয় শক্তিকে গুঁড়িয়ে দিতে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করেছে। আর বেশিরভাগ ক্ষেতে এই অপকৌশল প্রয়োগের সময় হিসেবে বারবার বেছে নিয়েছে আগস্ট মাসকে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে সিলেটে বোমা হামলার প্রতিবাদে চলমান সমাবেশে গ্রেনেড হামলা করা হয়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বিস্ফোরিত হয় ১১টি শক্তিশালী গ্রেনেড। এতে মারা যান আইভি রহমানসহ ২৪ নেতাকর্মী এবং আহত হন ৫ শতাধিক নেতাকর্মী। মানববর্ম তৈরি করে শেখ হাসিনাকে রক্ষা করা হয়। এই হামলার উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যার মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিলুপ্ত করে। বাংলাদেশকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্রে পরিণত করা। যার নমুনা নিজামী, মুজাহিদকে মন্ত্রী বানিয়ে দেখিয়েছিল বেগম জিয়া। বাংলাদেশের পতাকা রাজাকারদের হাতে তুলে দিয়েছিল, এর চেয়ে ন্যক্কারজনক আর কিছু হতে পারে না। পাকিস্তানী প্রেতাত্মাদের মদদেই গ্রেনেড হামলা করা হয়েছিল ২১ আগস্ট ২০০৪ সালে। বেগম জিয়ার কুপুত্র তারেক রহমান (হাওয়া-ভবন), ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাকারবারি লুৎফুজ্জামান বাবর, মুজাহিদ,আব্দুস সালাম পিন্টু, হারিছ চোধুরীর নেতৃত্বে মোট ১০টি গোপন বৈঠক সম্পন্ন হয়েছিল ২১ আগস্টের কিলিং মিশন সফল করার জন্য। পাকিস্তানী জঙ্গী সংগঠন হিজবুল মুজাহিদিনের আব্দুল মজিদ বাট এই লক্ষ্যে বাংলাদেশে অবস্থান করেছিল। অগ্নিসন্ত্রাস, পেট্রোলবোমা হামলায় মানুষ পোড়ানোর ঘটনার পরেও ক্ষমতা পুঞ্জীভূত করতে না পেরে ওরা কোটা আন্দোলনে সুযোগ নিতে চেয়েছিল।কিন্তু সরকার তা মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়। ১৯৭৫ পরবর্তীতে আগস্ট মাসকে কেন্দ্র করেই ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রগুলো। যার প্রমাণ এদেশের স্বাধীনতার স্বপক্ষীয় রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন ও নেতৃত্বশূন্য করার জন্য নোংরা রাজনীতির জন্ম দেয়া হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় আমাদের নাক-কান বন্ধ করে আয়েশ করে বসে থাকার সুযোগ নেই। আগস্ট মাসকে সামনে পেয়ে আবারও তারা বুনো উল্লাসে মাতোয়ারা হতে পারে নিরাপদ সড়কের আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে। রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের প্রাণপণ চেষ্টা করেছে জনবিচ্ছিন্ন স্বাধীনতাবিরোধী দল বিএনপি। জনগণের জানমালের ক্ষতি সাধন করে নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে বিএনপি-জামায়াত জোট সক্রিয়তা বাড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আর সুযোগ দেয়া যাবে না। ওরা যে কোন সুযোগ লুফে নেয়ার অপেক্ষায়। গুজব ছড়িয়ে দেশের পরিবেশ অস্থিতিশীল করার সুযোগ আর দেয়া যাবে না। কঞ্চি বড় হওয়ার আগেই কেটে ফেলতে হবে। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য এবং বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় যেন এমন কলঙ্কময় আগস্ট আর ফিরে না আসে, সেজন্য সকল নাগরিককে সজাগ থাকার পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করতে হবে একযোগে। লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
×