ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কালিম পাখি

মহাধরিবাজ- আবাস পরিবর্তনে ঠিকানা খুঁজে ফেরা...

প্রকাশিত: ০৪:৩৫, ২১ আগস্ট ২০১৮

মহাধরিবাজ- আবাস পরিবর্তনে ঠিকানা খুঁজে ফেরা...

সমুদ্র হক ॥ মহাধরিবাজ। আত্মরক্ষায় ওদের আছে তীক্ষè ও ধারালো ঠোঁট। বিপদে পড়লে কামড় দিতে বড় ওস্তাদ। কোন কারণে জলের ফাঁদে পড়লে সুযোগ খোঁজে পালানোর। ফাঁদের পেশাদার শিকারিরা খুব সাবধানে থাকে এদের ছাড়িয়ে নিতে। একটু খেয়ালি হলেই কামড় বসিয়ে উড়ে পালায়। তবে শিকারি না হলে এরা কারও কোন ক্ষতি করে না। দুঃসাহসী ও লড়াকু জলাভূমির এই পাখির নাম কালিম। ইংরেজি নাম পার্পেল সওনফেন। বিজ্ঞান নাম, পোরফাইরিও। দেশের হাওড়-বাঁওড় এলাকা, পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলের জলাশয়গুলোতে এই কালিম পাখির অবাধ বিচরণ। বর্তমানে এই পাখি অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়েছে। হালে জলবায়ুর পরিবর্তনের সঙ্গে পাখিদের আবাসের পরিবর্তন হচ্ছে। এরা ঠিকানা খুঁজে ফিরছে। অনেক সময় পথ হারিয়ে আরেক অঞ্চলে ঢুকে পড়ছে। হাওড়-বাঁওড় ও জলাশয়ে এরা যত স্বাচ্ছন্দ্যে বিচরণ করে শুকনো ভূমিতে তা পারে না। তখনই মহাবিপদে পড়ছে এই কালিম পাখি। যেমন কিছুদিন আগে খোঁজ পাওয়া যায় বগুড়ার শিবগঞ্জের বুড়িগঞ্জে বেদের বস্তিতে অচেনা কয়েকটি পাখি দেখা যাচ্ছে। বেদেরা এদের ধরে হাটে নিয়ে যাচ্ছে বিক্রির জন্য। ঘটনাটি জানতে পারে বগুড়া সরকারী আজিজুল হক কলেজের শিক্ষার্থীদের পরিবেশবাদী সংগঠন টিম ফর এনার্জি এ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্স (তীর)। সংগঠনের সভাপতি মোঃ আরাফাত রহমান তৎকালীন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোল্লা মিজানুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বন বিভাগ তীরের সদস্য ও সামজিক বন কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে বেদের বস্তিতে গিয়ে বেগুনী রঙের দুই কালিম পাখিকে উদ্ধার করে। এরপর পাখি দুইটিকে ঢাকার জাতীয় উদ্যানে অবমুক্ত করা হয়। বাংলাদেশ জীববৈচিত্র সংরক্ষণ ফেডারেশনের (বিবিসিএফ) সভাপতি ড. এসএম ইকবাল জানান, দেশে অন্তত ৬শ’ ৫০ প্রজাতির পাখির বাস। এর মধ্যে পরিযায়ী ৩শ’ ৫০ প্রজাতি। কালিম পাখি দেখতে নীলচে-বেগুনী। দৈর্ঘ্য ৪৫ থেকে ৬০ সেন্টিমিটার। ওজন ৬শ’ ৫০ থেকে ৮শ’ গ্রাম। পাখির মাথায় কপালের কাছে রোমান সৈন্যের মতো জোড়া বর্ম থাকে। এই বর্মই এদের প্রধান শক্তি। লালচে রঙের পা, আঙুল লম্বাটে। চোখের পাশে বৃত্তকায় সাদাটে ছোপ। মনে হবে সতর্ক দৃষ্টিতে এরা রেগে আছে। এদের মূল খাবার জলজ উদ্ভিদ, গুল্মের কচি নরম পাতা-ডগাসহ পদ্ম ফুলের ভেতরের অংশ। ব্যাঙের বাচ্চা (ব্যাঙাচি) ও ছোট মাছও এরা খায়। শরত হেমন্তে কচুরিপানা ঝোপ-ঝারের তলায় ডাল লতাপাতা দিয়ে বাসা বানিয়ে ডিম দেয় ৩ থেকে ৭টি করে। পাখি ছানার রং হয় ধূসরের আভায় হালকা কালো। মুরগির ছানার মতো কালিম ছানাও মা পাখির পিঠে বসে। নিরাপত্তার জন্য কখনও পালকের নিচে থাকে। প্রজনন মৌসুমে দুই পুরুষ কালিম যখন লড়াই করে তখন কপালের বর্মে এক ধরনের শব্দ হয়। এরা এতটাই যোদ্ধা যে বন্দুকের গুলির ছররায় যদি এক পা আঘাত প্রাপ্ত হয় আরেক পা মুখে কামড়ে ধরে উড়ে পালায়। নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার পর তখন আরেক কালিম পাখি ডাক্তার হয়। আহত কালিমের ক্ষত স্থানে কামড় দিয়ে ছররা বের করে। নাদুস নুদুস স্বাস্থ্যবান এই পাখির আচরণ অনেকটা মোরগের মতো। নব্বইয়ের দশক প্রথমার্ধ পর্যন্ত এই পাখিদের দেখা যেত বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলে। হাটে বাজারে প্রকাশ্যে এই পাখি বিক্রি হতো। ক্রেতারা মুরগির মতো পা ওপরের দিকে ধরে ঝুলিয়ে নিয়ে বাড়িতে যেত। দূর অতীতে ঢাকা মহানগরীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার বিল-ঝিল হাওড়-বাঁওড়ে ভর বছর এদের দেখা মিলত। মাংসমূল্যের কারণে পাখিটি আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে।
×