ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

শোকের মাস আগস্ট

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ২১ আগস্ট ২০১৮

 শোকের মাস আগস্ট

বাঙালী জাতির অবিস্মরণীয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৫ আগস্টে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করা হয়। সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন দুই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকার কারণে। এই আগস্ট মাসেই আমরা স্মরণ করি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। এ মাসেই বিশ্বকবিরও অনন্ত যাত্রা। বাংলা সাহিত্যের আর এক দিকপাল কাজী নজরুল ইসলামও চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছিলেন ২৯ আগস্ট। বাংলা ও বাঙালীর এই তিন অবিচ্ছিন্ন প্রাণপুরুষের প্রয়াণ মাসই শুধু আগস্ট মাসকে শোকাভিভূত করেনি, আবহমান বাংলার সামগ্রিক ব্যবস্থার সঙ্গেও একাত্ম করে রেখেছে। বঙ্গবন্ধু কিংবা রবীন্দ্রনাথ কেউ কাউকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। কিন্তু বাঙালীর চিরায়ত সাংস্কৃতিক ভুবনে দু’জনের অভিযাত্রা ছিল এক ও অভিন্ন। দু’জনই যুগ যুগ ধরে গড়ে ওঠা বাঙালীর জাতিসত্তায় এতটাই নিমগ্ন ছিলেন যে, কোনভাবেই নিজস্ব ঐতিহ্য থেকে তাদের আলাদা করে ভাবার কোন সুযোগ, থাকে না। আর ৩৪ বছর নীরব, নিথর থাকা বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বঙ্গবন্ধু জীবদ্দশায় তাঁর সংগ্রামী পথপরিক্রমায় দেখেছেন, অনুপ্রাণিতও হয়েছেন বিদ্রোহী কবির সৃষ্টিশীল উন্মাদনায়। শুধু তাই নয়, স্বাধীনতার পরেই কবিকে তিনি নিয়ে আসেন বাংলাদেশে। কিশোর বয়স থেকেই লড়াকু কবির দাপট দেখেছেন অন্যায়, অত্যাচার আর অবিচারের বিরুদ্ধে। শুনেছেন বজ্রকণ্ঠের আওয়াজ যা বঙ্গবন্ধুকে নানামাত্রিকে আন্দোলিত করেছে। যার ছাপ রেখে গেছেন আমাদের সমর সঙ্গীত নির্বাচনে। স্বাধীন দেশে নজরুলকে নিয়ে এসে স্বমর্যাদায় অধিষ্ঠিত করার যে যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, সেখান থেকেও অনুমেয় বিদ্রোহী কবির প্রতি বঙ্গবন্ধুর শ্রদ্ধা আর ভালবাসা। বিস্ময়করভাবে পরবর্তী বছর অর্থাৎ ১৯৭৬ সালের এই আগস্ট মাসেই নজরুলের মহাপ্রয়াণ। রবীন্দ্রভক্ত বঙ্গবন্ধু সারা জীবনই রবীন্দ্রনাথের গান আর কবিতায় নিজেকে শাণিত করেছেন, সংগ্রামী চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়েছেন। মনেপ্রাণে রবীন্দ্র মননকে ধারণ করেছেন। বিভিন্ন বক্তৃতায়, আলাপ-আলোচনায় রবীন্দ্রনাথের গান কিংবা কবিতা থেকে উদ্ধৃতও করতেন। শেখ রেহানার লেখায় আছে রবীন্দ্রনাথের নিজের হাতের লেখা একটা গানের কপি ছিল বঙ্গবন্ধুর কাছে, যা মৈত্রীয় দেবী বঙ্গবন্ধুকে উপহার দিয়েছিলেন। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট কিছু বিপথগামী দুষ্টচক্রের হাতে নৃশংসভাবে খুন হওয়ার পর সেটা দুমড়ে-মুচড়ে তাঁর বাসভবনে মাটিতেই পড়েছিল। সেটি এখন বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে সসম্মানে রক্ষিত আছে। ‘ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো’ যে আগুনের দীপ্ত শিখায় সারাজীবন প্রজ্বলিত হয়েছেন বঙ্গবন্ধু নিজেই। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিশাল সৃষ্টি আর কর্মযজ্ঞে যা কিছু দিয়েছেন, যেভাবে বাংলা সাহিত্যের ভা-ারকে পরিপূর্ণ করেছেন তার থেকে বঙ্গবন্ধু মূল সারটুকু নিতে কার্পণ্য করেননি। বাঙালির জাতীয় জীবনে বঙ্গবন্ধুর নিঃশর্ত আর নিঃশেষ আত্মদান আজও বিপন্ন আর পথভ্রষ্ট মানুষদের যথার্থ দিকনির্দেশনা। নিজেকে নিজেই গড়ে তুলেছিলেন তেজদীপ্ত উন্মাদনা, অমিত সাহস আর দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচনের এক লড়াকু সৈনিকের আসনে। যা রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের জীবনের পথপরিক্রমায়ও উজ্জ্বলভাবে প্রতীয়মান হয়। তাই মাঝে মাঝে মনে হয় বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর কাজী নজরুল ইসলাম যেন এক ও অবিচ্ছিন্ন সুতায় গাঁথা এক বরণমালা। যাঁদের মুহূর্তকালও বাদ দিলে আমরা রিক্ত, নিঃস্ব আর অসহায় হয়ে যাব। দেশ, জাতি, রাষ্ট্র, নিজস্ব সাংস্কৃতিক সম্পদ নিয়ে তিনজনকেই লড়াই করতে হয়েছে কিছুটা ভিন্নমাত্রায়। তাঁরা সাধারণ মানুষেরই ছিলেন এই কথা বলার যেমন সঙ্গতকারণ আছে, একইভাবে তাঁদের দুঃসহ অভিযাত্রার অভিগমনকেও আদর্শ আর বৈশিষ্ট্যের নিরিখে বিবেচনায় আনা যুক্তিসঙ্গত। চিন্তার সঙ্গে, বিদ্যমান সমাজের চিরাচরিত প্রথার আলোকে, দেশ ও জাতির মুক্তির সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণে সর্বোপরি প্রতিপক্ষ আর শাসকগোষ্ঠীর জ্বলন্ত রোষানলকে পাশ কাটিয়ে নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কারও পক্ষে অত সহজ ব্যাপার ছিল না। নোবেল পুরস্কার পাবার আগ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথকেও অনেক লড়াই করতে হয়েছিল অবিভক্ত ভারতের বিশেষ করে বাংলার অনেক জ্ঞানী-গুণী আর পন্ডিতদের সঙ্গে। আর ছন্নছাড়া, বেপরোয়া নজরুলের জীবনও কেটেছে হরেক রকম সংগ্রামের বৈতরণী পার হতে হতে। বঙ্গবন্ধু তো সাধারণ মানুষের জীবন লড়াইয়ের প্রত্যক্ষ অংশীদার, তাদের অধিকার আর স্বাধীনতা আদায়ের নির্ভীক এক সৈনিক। শুধু তাই নয়, ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে বাঙালীরা যখন পাকিস্তানী সামরিক জান্তার তীব্র কষাঘাতের নির্মম শিকারে পরিণত হয়, সেখান থেকে বের হয়ে আসাটা ছিল আরও কঠিন আর অলঙ্ঘনীয়। কিশোর বয়স থেকে বঙ্গবন্ধুর যে দেশত্ববোধের আদর্শিক চেতনা, সে দায়বদ্ধতাই তাঁকে অবিভক্ত বাংলার উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নিজেকে সম্পৃক্ত করার বলিষ্ঠ প্রত্যয়ে উজ্জীবিত করে। ইংরেজরা স্বাধীনতার নামে ’৪৭-এর যে দেশভাগ সাধারণ মানুষের কাঁধে চাপিয়ে দেয়, যার প্রাথমিক ঘা এসে লাগে পাকিস্তানের ওপর, আরও তীব্রভাবে আমাদের বাংলাদেশের ওপর। আমরা উপনিবেশিত শৃঙ্খল থেকে ছাড়া পেয়ে আরও কট্টরভাবে নিপতিত হলাম পাকিস্তানী সামরিক জান্তার নব্য ঔপনিবেশিক নিগড়ে। আর সেখান থেকেই শুরু বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ঐতিহাসিক কালপর্ব। সেই থেকে বঙ্গবন্ধুরও লড়াকু অভিযাত্রায় নিজেকে পরিপূর্ণভাবে সমর্পণ করা। এই দুঃসাহসিক যাত্রাপথে আর্থ- সামাজিক রাজনৈতিক আর সাংস্কৃতিক বলয়ের চাপিয়ে দেয়া সমস্ত আবর্জনাকে নির্মূল করার যে যুদ্ধে বঙ্গবন্ধুকে নামতে হয়েছিল, তা যেমন দুর্গম, বন্ধুর আর অভেদ্য ছিল, একইভাবে শাসক গোষ্ঠীর নিষ্ঠুর আক্রমণও ছিল অসহনীয়। অনেক কঠিন আর পর্বত প্রমাণ অলঙ্ঘনীয় প্রাচীরকে দীপ্ত চেতনায় অতিক্রম করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে যে কতভাবে প্রতিরোধ আর বাধা বিপত্তিকে সামাল দিতে হয়েছে, বাংলাদেশের সংগ্রামী ইতিহাস তার সাক্ষী হয়ে আছে। ’৪৭-এর দেশ বিভাগের সূচনাকাল থেকেই ইংরেজ আর পাকিস্তানী শাসন-শোষণে জর্জরিত বাংলাদেশের পক্ষে বঙ্গবন্ধুকে তাঁর সমস্ত শক্তি আর প্রজ্ঞা দিয়ে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতে হয়েছিল। যেভাবে অস্থিতিশীল, অবিভক্ত ভারতের উত্তপ্ত রাজনৈতিক অঙ্গনকে সৃষ্টিশীল দ্যোতনা আর শৈল্পিক আঁচড়ে রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলকে জনগণের দ্বারে পৌঁছে দিতে হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে জনগণের সমান অংশীদার হয়ে সামরিক শাসকের প্রাচীর ভাঙ্গার যে অপ্রতিরোধ্য লড়াইয়ে নামতে হয়, সেখানে তিনি একেবারে সাধারণ মানুষের কাতারে গিয়ে দাঁড়ান। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথও জমিদারি তদারকি করতে এসে গ্রামবাংলার খেটে খাওয়া অসহায় প্রজাদের একান্ত সান্নিধ্যে শুধু নিজেকেই পূর্ণ করেননি, বাংলা সাহিত্যেকেও তার সমান অংশীদার করেছেন। আর বিদ্রোহী কবি তো পথে-প্রান্তরে, নির্বিত্ত, বঞ্চিত, অত্যাচারিত জনগোষ্ঠীর হাহাকারে এতই বিচলিত আর উদ্বিগ্ন ছিলেন যে, সৃষ্টিশীল উদ্যোগ তাঁকে সর্বক্ষণই তাড়িত করে। ঠান্ডা মাথায় কিংবা নিরবচ্ছিন্ন অবকাশে সুচিন্তিতভাবে লেখার কোন সুযোগই তাঁর ছিল না। যেখানে যেমন সেখানে তেমনভাবেই সৃষ্টির উন্মাদনায় নিমগ্ন হতেন। শেষমেশ অসাধারণ সৃজনশক্তির অমূল্য সম্পদও বের হয়ে আসত। বাংলা ও বাঙালীর এই তিন দিকপালের জীবনদর্শন, মননশীল প্রজ্ঞা, আদর্শিক চেতনা, দেশাত্ববোধের অকৃত্রিম শক্তি যেভাবে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য আর ঐতিহ্যিক বলয়কে লালন করে তা যুগের অগ্রগামী চিন্তাকেও ধারণ করা এক অবিস্মরণীয় বলিষ্ঠ প্রত্যয়। ’৪৭-এর দেশ বিভাগের পরিণতি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কোন ধারণা না থাকলেও বিশিষ্টজনদের কাছে তা কখনও আকাক্সিক্ষত বা প্রত্যাশিত ছিল না। রবীন্দ্রনাথ বেঁচে ছিলেন না। নজরুল বেঁচে থেকেও অসাড়, নির্বাক। আর ’৪৭-এর পরবর্তী পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর লড়াকু প্রত্যয় বলে দেয় এই দেশ বিভাগ তাঁকেও আশাহত এবং স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় জর্জরিত করেছিল। ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গকে মানতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর সিংহভাগ দেশাত্মবোধক গান রচিত হয় ১৯০৫ সাল থেকেই। বিশেষ করে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি তখন বঙ্গভঙ্গের প্রতিপক্ষ হিসেবে কলকাতার মিছিল আর সমাবেশ গাওয়া হতো। শুধু তাই নয়, সেভাবে জনপ্রিয়তাও পেয়েছিল এই স্বদেশ প্রেমের গানটি, যা বঙ্গবন্ধুকেও সমানভাবে উদ্দীপ্ত করেছিল। পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর কঠিন বলয়েও বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে এই গানটি সাহসের সঙ্গে গাওয়া হতো। এক সময় তা আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা পায় বঙ্গবন্ধুর আন্তরিক ইচ্ছায়। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের সিদ্ধান্তে উৎকণ্ঠিত নজরুল পাকিস্তানকে বলেছিলেন ‘ফাঁকিস্তান’। সুতরাং বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলকে এক ও অভিন্ন বাঙালীর মূল শেকড়ের একনিষ্ঠ এবং নিবেদিত সাধক হিসেবে ভাবাই যায়। কাকতলীয়ভাবে এই তিনজনের চিরদিনের মতো চলে যাওয়াটাও এই আগস্ট মাসেই। লেখক : সাংবাদিক
×