ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মধ্যপাড়া খনির কঠিন শিলা উধাওয়ের ঘটনায় তুলকালাম

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ১৯ আগস্ট ২০১৮

মধ্যপাড়া খনির কঠিন শিলা উধাওয়ের ঘটনায় তুলকালাম

শ.আ.ম হায়দার, পার্বতীপুর। বড়পুকুরিয়া খনির কয়লা কেলেঙ্কারির অল্প কিছুদিন পরেই মধ্যপাড়ার কঠিন শিলা পাচারের ঘটনায় তুলকালাম শুরু হয়। দেশের একমাত্র গ্রানাইট শিলাখনি মধ্যপাড়া থেকে ৫৫ কোটি ২৩ লাখ টাকার ৩ লাখ ৬০ হাজার মে. টন কঠিন শিলা ঘাটতির ঘটনা কতটা বাস্তব আর কতটা কাল্পনিক? এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে অনেক প্রশ্ন। তবে প্রকৃত এই খনিতে কি এত বড় বিশাল ধরনের ঘাপলা হয়েছে, নাকি অন্য কিছু? এ বিষয়ে সঠিক তথ্য জানতেই সরেজমিন এ প্রতিবেদন। সূত্রমতে, নানা কারণে এই খনির উৎপাদন দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। কর্তৃপক্ষ অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করারও চিন্তাভাবনা করেছিল। বলা হয়েছিল ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগে দেশে অনেক পাথরের উৎস আছে, রাষ্ট্রের এই বিপুল অর্থ অপচয় করে ভূগর্ভের ১২শ’ মিটার গভীর থেকে কঠিন শিলা উত্তোলনের প্রয়োজন কি? তবে শেষ পর্যন্ত বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে খনি ঘুরে দাঁড়িয়ে উৎপাদনমুখী হয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জিটিসির (জার্মানিয়া ট্রেস্ট্র কনসোর্টিয়াম) সার্বিক তত্ত্বাবধানে বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নানাবিধ কর্মকৌশলের মাধ্যমে খনির উন্নয়ন ও বিপণন বৃদ্ধির ব্যবস্থা নেয়ায় খনি গতি ফিরে পেয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে এখন কয়লার চেয়ে মধ্যপাড়ার গ্রানাইট শিলার কদর অনেক বেশি । আগের মতো খনি চত্বরে শিলার স্তূপ পড়ে থাকা চোখে পড়ে না। শিলা সংগ্রহ করতে দেশের সব প্রান্ত থেকে ভারি ট্রাকের বহর ছুটছে মধ্যপাড়ার দিকে। ইতোমধ্যে মধ্যপাড়ার গ্রানাইট শিলা দেশের অন্যতম মেগা প্রকল্প রূপপুর তাপবিদ্যুত কেন্দ্রে সরবরাহ করা হচ্ছে। এছাড়া ৪ লেন প্রকল্প, যমুনা নদী রক্ষা প্রকল্প কাজসহ অন্যান্য কাজে এই শিলা ব্যবহৃত হচ্ছে। সরকারের গৃহীত বিভিন্ন বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্পে, যেমন পদ্মা বহুমুখী উন্নয়ন প্রকল্প, সিরাজগঞ্জ হার্ড পয়েন্ট, পাওয়ার প্লান্টসমূহ, বিভিন্ন বিদ্যুত প্রকল্পে ভবিষ্যতে বিপুল পরিমাণ কঠিন শিলার প্রয়োজন হবে। এসব প্রকল্পে গুণগতভাবে উৎকৃষ্ট মধ্যপাড়ার গ্রানাইট শিলার ব্যবহার নিশ্চিতকরণের যখন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, ঠিক সে সময় শিলা লোপাটের ঘটনাটি প্রচারিত হয়। উৎপাদনমুখী খনির সর্বনাশ তথা সরকারের ব্যর্থতা তুলে ধরতে ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে এ ধরনের প্রচার চালানো হচ্ছে বলে ধারণা সচেতন নাগরিক সমাজের। এ ঘটনার তাৎক্ষণিক তদন্তের জন্য ২৯ জুলাই এমজিএমসিএলের বোর্ড মিটিংয়ে পেট্রোবাংলার মহাব্যবস্থাপক ও মধ্যপাড়া খনির ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাবেদ চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অপর সদস্যরা হলেন, পেট্রোবাংলার ব্যবস্থাপক বেলায়েত হোসেন, আনোয়ার হোসেন ও মধ্যপাড়া কঠিন শিলা খনির উপমহাব্যবস্থাপক রাজেউন নবী। বৃহস্পতিবার সরেজমিন খনি পরিদর্শনে গেলে খনির মুখপাত্র হিসেবে মহাব্যবস্থাপক (খনিজ) আসাদুজ্জামান খনির চলমান কার্যক্রম তুলে ধরে বলেন, বর্তমানে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জিটিসির ব্যবস্থাপনায় খনিতে ৩ শিফটে পুরোমাত্রায় উৎপাদন অব্যাহত আছে। গতকাল শুক্রবারের উৎপাদন সাড়ে ৪ হাজার ও গত জুলাই মাসে ১ লাখ ১২ হাজার মে. টন কঠিন শিলা উৎপাদন হয়েছে। শিলার ওজনে পদ্ধতিগত গরমিল হয়েছে, তবে তাকে লোপাট বলা যাবে না। ভুলভ্রান্তি সংশোধন করে সঠিক সিদ্ধান্ত দেয়ার জন্য খনিতে উৎপাদনের শুরু থেকেই কর্তৃপক্ষের নিকটে চিঠিপত্র আদানপ্রদান অব্যাহত আছে। সঠিক তথ্য না জেনে এভাবে অপপ্রচার চালিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা দুঃখজনক। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জিটিসির (জার্মানীয়া ট্রেস্ট্র কনসোর্টিয়াম) নির্বাহী পরিচালক জাবেদ সিদ্দিকী জানান, খনিতে এখন ৩ শিফটে উৎপাদন হচ্ছে। খনিসূত্র মতে, উত্তোলিত শিলার রেকর্ড, বিক্রি,সরবরাহ ও বাস্তব মজুদের হিসাব বহিতে গরমিলের সম্ভাব্য কারণ নিরূপণের জন্য বিভিন্ন সময়ে একাধিক কমিটি কাজ করেছে। প্রতিবেদনও দাখিল করেছেন। শেষে কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারদের সিদ্ধান্তের আলোকে এবং ৬.৩.২০১৮ তারিখে অনুষ্ঠিত এমজিএমসিএলের ১৭তম সমন্বয় সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হিসাব বইয়ের তথ্য-উপাত্ত মিল রাখার জন্য খনি হতে শিলা উৎপাদন ও বিপণন পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে যে পরিমাপগত ত্রুটি, অপচয় ও সিস্টেম লস হয়েছে তা পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জন্য এমজিএমসিএলের মহাব্যবস্থাপক (মার্কেটিং) আবু তালেব ফরাজীকে আহ্বায়ক করে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি নামনাম কর্তৃক পরীক্ষামূলক উৎপাদনের রিপোর্ট, এমজিএমসিএলের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ২৫.৫.২০০৭ হতে ১৯.২.২০১৩ পর্যন্ত বাণিজ্যিক ভিত্তিতে শিলা উৎপাদন ও বিক্রীত শিলার রেকর্ড, জিটিসি কর্তৃক ২৪.২.২০০৭ হতে ১৯.২.২০১৭ পর্যন্ত শিলা উৎপাদন ও বিক্রীত শিলার রেকর্ড, হিসাববহির রেকর্ড, শিলার ঘাটতি নিরূপণের জন্য বিভিন্ন সময়ে গঠিত কমিটির প্রতিবেদন ২.৭.১৮ তারিখে দাখিল করে। বাংলাদেশ ভূতাত্বিক জরিপ বিভাগের প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত কমিটি ৪.১০.২০১৬ তারিখে দাখিলকৃত প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৩-২০১৪ হতে ২০১৬-২০১৭ অর্থবছর পর্যন্ত মোট উৎপাদিত ১২,৭২,৫৩৭.৩২ মে. টন গ্রানাইট শিলার ২.০৫% হ্যান্ডেলিং ও পদ্ধতিগত লোকসানের পরিমাণ প্রায় ২৬,০৮৭.০২ মে.টন। পরিমাপগত ত্রুটি ও পদ্ধতিগত লোকসান, মাটির নিচে দেবে যাওয়া এবং হ্যান্ডেলিং ও পদ্ধতিগত লোকসান হিসেবে মোট কঠিন শিলার পরিমাণ ৩,৫৯,৮১৬.৮৯ মে. টন। যা ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরের হিসাব বইয়ের সমাপনী শিলা মজুদের প্রায় সমান। হিসাব বইয়ে উল্লেখিত পরিমাণ শিলার বাজার মূল্য ৫৫,২৩,৪৮,৪৪৮.০০ টাকা। এ ক্ষেত্রে উৎপাদন হিসাবের সঙ্গে হিসাব বইয়ের তথ্য উপাত্ত মিল রাখার প্রয়োজনে ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরের হিসাব বইয়ের সমাপনী মজুদ শিলা ৩,৫৯,৮১৬.৮৯ মে. টন ও মূল্য ৫৫,২৩,৪৮,৪৪৮.০০ টাকা যা অবলোপনযোগ্য। ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ জানান, পূর্বে পাথর ভাঙ্গা ও ওজন করার যন্ত্রের বিভিন্ন অংশে যথাযথ ওয়েয়িং স্কেল না থাকায় উত্তোলিত শিলার সঠিক ওজন করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া উত্তোলিত শিলার মধ্যে বিক্রি অযোগ্য শিলার পরিমাণ, নিখুঁত উৎপাদনের অপচয় ও হ্যান্ডেলিং লসের যে হিসাব পরিমাপ করা হয়েছে, তা অনুমাননির্ভর। সে কারণে জরুরী ভিত্তিতে বিশেষ পরিমাপ যন্ত্র স্থাপনের সুপারিশ করা হলেও তখন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন খনির কতিপয় কর্মকর্তা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী এ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমানের নির্বাচনী এলাকা হওয়ায় তিনি খনির মনিটরিংয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, দেশের উন্নয়নের রূপকার প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি হস্তক্ষেপে বন্ধ খনি চালু হয়ে উৎপাদনমুখী হয়েছে, এটাই বাস্তবতা। আর খনির শিলা লোপাটের বিষয়ে যে কথা উঠেছে তার জন্য তো তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। তদন্ত শেষ হয়ে রিপোর্ট প্রকাশ পর্যন্ত তো অপেক্ষা করতেই হবে। তার আগে কোন মন্তব্য করা ঠিক হবে? স্থানীয় হরিরামপুর ইউনিয়নের বর্তমান চেয়্যারম্যান মাসুদুর রহমান জানান, এই খনিটি একটি জাতীয় প্রকল্প। খনির কারণেই অজপাড়াগাঁ, গভীর বনাঞ্চল মধ্যপাড়ায় উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে, এলাকা আলোকিত হয়েছে। প্রচার, অপপ্রচারে এ প্রকল্পের ক্ষতি হোক এমনটা আমরা চাই না। তবে বাস্তবতা হলো খনি একটি কেপিআই এলাকা। অভ্যন্তরীণ বিষয় ও কর্মকা- বাইরে থেকে জানার সুযোগ নেই। স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু তদন্তেই কেবল প্রকৃত সত্য উদঘাটিত হবে। অনুরূপ কথা বলেছেন এলাকার সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মোজাহিদুল ইসলাম সোহাগ ও বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা শাহাবুদ্দিন শাহ।
×