ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রুপিং, লবিং বাড়ছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১৯ আগস্ট ২০১৮

  গ্রুপিং, লবিং বাড়ছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে

রফিকুল ইসলাম আধার, শেরপুর ॥ ‘পর্যটনের আনন্দে, তুলসীমালার সুগন্ধে’ জেলা ব্র্যান্ড ধারণকারী কৃষি-খাদ্যসমৃদ্ধ ও সীমান্তবর্তী জেলা শেরপুর। দীর্ঘদিন ধরেই জেলাটি আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে তিনটি আসনই রয়েছে আওয়ামী লীগের দখলে। একাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে জেলার তিনটি আসনেই বইছে নির্বাচনী হাওয়া। দলীয় মনোনয়ন পেতে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ছাড়াও বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের পদচারণায় জমে উঠেছে জেলার নির্বাচনী রাজনীতি। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই যেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে গ্রুপিং, লবিং ও মেরুকরণ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। সঙ্গে বাড়ছে মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যাও। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকার কারণে ক্ষমতাসীন দলটিতেও কোন্দল ও গ্রুপিং বৃদ্ধি পেয়েছে। তারপরও দিন যতই ঘনিয়ে আসছে আলোচনায় উঠে আসছে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের কার কি অবস্থান। তবে ৩টি আসনেই আওয়ামী লীগে যতটা গৃহবিবাদ কাজ করছে, ঠিক ততটা বিবাদ-দ্বন্দ্ব নেই বিএনপিতে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক তৎপরতা ও অবস্থান তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত যতটা মজবুত রয়েছে, ততটা তৎপরতা-অবস্থান নেই বিএনপিতে। এরপরও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ চাচ্ছে জেলার ৩টি আসনই আবারও নিজেদের দখলে রাখতে। আর বিএনপি চাচ্ছে ৩টি আসনই আওয়ামী লীগের দখল ছুটিয়ে নিজেদের দখলে নিতে। এছাড়া জাতীয় পার্টি ও জামায়াতসহ অন্য একাধিক রাজনৈতিক দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা জোটগত নির্বাচন প্রশ্নে জোটের প্রার্থী হতেও তৎপরতায় রয়েছেন। তবে বিএনপি বা ২০ দলীয় জোট নির্বাচনে না এলে জাতীয় পার্টি, জাকের পার্টি ও জাসদসহ অন্যান্য দলের প্রার্থীরাও এককভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। শেরপুর-১ (সদর) ॥ বৃহত্তর ময়মনসিংহের প্রাচীনতম প্রথম শ্রেণীর পৌরসভাসহ সদর উপজেলার ১৪টি ইউনিয়ন নিয়ে এ আসন বিস্তৃত। আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে খ্যাত এ আসনে দলীয় কোন্দল প্রকাশ্য রূপ ধারণ করলেও এ আসনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থীর সংখ্যা সীমিত। ১৯৭০ এর নির্বাচন থেকে শুরু করে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত একবার বিএনপি দলীয় প্রার্থী প্রয়াত খন্দকার আব্দুল হামিদ এবং তিনবার জাতীয় পার্টির প্রার্থী শাহ রফিকুল বারী চৌধুরী বিজয়ী হলেও প্রতিবারই তারা জিতেছেন আওয়ামী লীগের কোন্দল ও বিদ্রোহী প্রার্থীর কারণে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেত্রী মতিয়া চৌধুরীর আশীর্বাদ নিয়ে জেলা সদরের তৎকালীন সিনিয়র তিন নেতা সাবেক গবর্নর এ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান, সাবেক এমপি নিজাম উদ্দিন আহম্মদ ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ্যাডভোকেট আব্দুছ ছামাদকে পেছনে ফেলে দলীয় মনোনয়ন বাগিয়ে নেন তৎকালীন তরুণ নেতা, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আতিউর রহমান আতিক। ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি দ্বিতীয় দফায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং ২০০৩ সালে মতিয়া চৌধুরীর আশীর্বাদ নিয়েই জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। টানা চারবারের এমপি আতিউর রহমান আতিক বর্তমানে জাতীয় সংসদের হুইপের দায়িত্ব পালন করছেন। জেলার সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে দলে তরুণ ও গতিশীল নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় এমপি নির্বাচিত হওয়ার শেষ দিকে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের অপ্রকাশ্য মতিয়া চৌধুরী বিরোধী বলয়ের সঙ্গে আতিউর রহমান আতিকের সম্পর্ক ও উঠা-বসা এবং বিশেষ করে ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেনের সময়কালে দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে তিনি দলের দায়িত্ব এড়িয়ে এলাকা ছেড়ে ঢাকায় অবস্থান করতে থাকায় কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর দূরত্ব সৃষ্টি হয়। সেই রেশ থেকেই দলের স্থানীয় রাজনীতিতে আতিক ও আতিকবিরোধী বলয় গড়ে উঠে। বিশেষ করে গত পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ ও সর্বশেষ জেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে জেলা সদরে আওয়ামী লীগ দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। যে কারণে দলীয় কর্মসূচীও এখন পৃথকভাবে পালিত হচ্ছে। প্রকাশ্য মিটিংয়ে এক গ্রুপ অন্য গ্রুপ সম্পর্কে অশালীন ভাষায় বক্তব্য দিতেও দ্বিধা করছে না। আর এর মধ্য দিয়েই চলছে এ আসনে দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের তৎপরতা-গণসংযোগ। এ আসনে একবার জাতীয় পার্টির প্রার্থী বেগম রওশন এরশাদ ও টানা তিনবার যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসি হওয়া জামায়াতে ইসলামের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে হারানোসহ টানা চারবারের সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের বর্তমান হুইপ আতিউর রহমান আতিক এবারও দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী। তবে ২০১৬ সালে সম্মেলনের মাধ্যমে দ্বিতীয় দফায় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর অনুগত (এক সময়ে বেগম মতিয়া চৌধুরীর গড়া) জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট চন্দন কুমার পালকে নিয়ে যে নির্বাহী পরিষদ গঠন করেন তাতে অবমূল্যায়ন করা হয় জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা এ্যাডভোকেট মুহাম্মদ আখতারুজ্জামান, সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি, সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ছানুয়ার হোসেন ছানু, মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদক আব্দুল ওয়াদুদ অদু ও সাবেক সমাজকল্যাণ সম্পাদক তাপস কুমার সাহাসহ প্রায় ২০ জন নেতাকে। দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর যাবত এ আসনের প্রতিনিধিত্ব করায় আতিউর রহমান আতিক এলাকার উন্নয়ন কর্মকা-ও বাস্তবায়ন করেছেন অনেক। তবে পূর্বাঞ্চলের তুলনায় পশ্চিমাঞ্চল ও চরাঞ্চলের উন্নয়নের ক্ষেত্রে রীতিমতো বৈষম্যের অভিযোগ রয়েছে। জেলা শহর থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে ভাতশালা ইউনিয়নে গড়ে তুলেছেন জেলা পর্যায়ের প্রায় ৭/৮টি প্রতিষ্ঠান। সেইসঙ্গে নিজের নামে স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় স্থানীয় রাজনীতিতে রেকর্ড গড়লেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, শেখ হাসিনা বা তার পরিবারের কারও নামে কোন প্রতিষ্ঠান না করায় মিশ্র প্রতিক্রিয়াও রয়েছে দলের নেতাকর্মী ও সচেতন মহলের। দলের ত্যাগী, পরীক্ষিত ও মেধাসম্পন্ন প্রতিশ্রুতিশীল নেতাদের পাশ কাটিয়ে সুবিধাভোগী, তোষামোদী ও বিশেষ কোটারির নেতা-নেত্রীদের প্রতি দুর্বলতার অভিযোগও শোনা যায়। সম্প্রতি অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হওয়ায় অনেকে ধরেই নিয়েছিলেন যে এবার হয়তো ফেঁসে যাচ্ছেন তিনি। কিন্তু ইতোমধ্যে ওই অভিযোগের বিষয়টির পরিসমাপ্তি হওয়ায় মেজাজ ফুরফুরে হয়ে উঠেছে সাংসদ আতিক ও তার সমর্থকদের। তাদের দাবি, এবারও দলীয় মনোনয়ন জুটছে আতিকের ললাটেই। এ আসনে হুইপ আতিকের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে দলের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে মাঠ বেশ আগে থেকেই মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ছানুয়ার হোসেন ছানু। তার প্রতি সমর্থন জানিয়ে সভা-সমাবেশে সরাসরি পরিবর্তনের ডাক তুলেছেন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক-১ হুমায়ুন কবীর রুমানসহ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ডাক সাইটের কয়েক নেতা। তার পক্ষে তৃণমূলেও গড়ে উঠেছে সমর্থকগোষ্ঠী। এ বলয়ের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ‘আতিক ছাড়া নৌকা চাই, নৌকার মাঝি ছানু ভাই’ স্লোগান তার সমর্থকদের মুখে মুখে। তাই এ বলয়ের দাবি, দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের অবমূল্যায়ন, অনিয়ম-দুর্নীতি ও বৈষম্যমূলক উন্নয়ন কর্মকা-ের প্রশ্নে মানুষ আতিকের পরিবর্তন চায় বলেই ছানুয়ার হোসেন ছানুর দলীয় মনোনয়নের বিষয়ে তারা আশাবাদী। আর এ আসনে এলাকার প্রথম মহিলা সংসদ সদস্য, জেলা যুব মহিলা লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক এ্যাডভোকেট ফাতেমাতুজ্জোহরা শ্যামলী প্রকাশ্যে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে ঘোষণা না দিলেও তার নানা তৎপরতায় অনেকেই ধরে নিয়েছেন তিনিও একজন সম্ভাব্য প্রার্থী। এছাড়া এ আসনে দলের মহিলা নেতৃত্বের কর্ণধার ও জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শামছুন্নাহার কামাল, জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা প্রকৌশলী মাহবুবুল আলম মঞ্জুসহ প্রজন্ম একাত্তরের কেন্দ্রীয় সভাপতি আজিজুর রহমানও মনোনয়ন পেতে আগ্রহী। অন্যদিকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে বিএনপিও একেবারে ঘরে বসে নেই। তাদের দীর্ঘদিন ধরে অচল থাকা দলীয় কার্যালয়টি সচল হয়ে উঠেছে। নেতাকর্মীদের আনাগোনাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গত বছরের প্রথম দিকে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা করা হলেও এখন পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ কমিটি প্রকাশ করা হয়নি। তবে এ আসনে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক, শিল্পপতি মোঃ হযরত আলী দলের সর্বাধিক প্রভাবশালী প্রার্থী। জেলা থেকে সদর আসনের তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত তার যেমন রয়েছে ব্যাপক তৎপরতা, তেমনি রয়েছে দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতি সহায়তার হাত। তবে ঋণ কেলেঙ্কারির মামলায় হাজতবাসসহ বর্তমানে জেলা বিএনপির সভাপতি, সাবেক এমপি মাহমুদুল হক রুবেলের সঙ্গে ঠা-া লড়াই শুরু হওয়ায় মাঠ গুছানোর চেয়ে তাকে কেন্দ্রসহ কোর্ট-কাচারিতেই দৌড়াতে হচ্ছে বেশি। জোটগত নির্বাচন প্রশ্নে জামায়াতকে ছেড়ে দিতে না হলে এ আসনে তিনিই দলীয় মনোনয়ন পাবেন এমনটিই ধারণা সচেতন মহলের। আর মাঠে তৎপর না থাকলেও জোটগত নির্বাচন প্রশ্নে টানা তিন বার জামায়াতকে ছেড়ে দেয়া এ আসনে যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসি হওয়া কেন্দ্রীয় নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ছেলে হাসান ইকবাল ওয়ামী প্রার্থী হতে পারেন। এ আসনে বিএনপির আরও সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে তৎপর রয়েছেন সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সাবেক সহকারী এ্যাটর্নি জেনারেল এ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আবদুল্লাহ ও জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি, জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট তৌহিদুর রহমান তৌহিদ। জাতীয় পার্টি থেকে দলের জেলা শাখার সভাপতি, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ মোঃ ইলিয়াস উদ্দিন এবং জাতীয় পার্টি (মঞ্জু) থেকে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য, সাবেক এমপি শাহ রফিকুল বারী চৌধুরীর নাম এককভাবে শোনা যাচ্ছে। তবে তাদের দুজনের মধ্যে ইলিয়াস উদ্দিন এলাকায় বিচরণ করলেও আদৌ দেখা মেলে না শাহ রফিকুল বারী চৌধুরীর। তারা দুজনই মহাজোটের প্রার্থী হতে চান। একইভাবে সদর উপজেলার পাকুড়িয়া পৈত্রিক নিবাস হওয়ায় জাকের পার্টির কেন্দ্রীয় চেয়ারম্যান পীরজাদা মোস্তফা আমির ফয়সালও এ আসনে মহাজোটের প্রার্থী হতে চান। এ আসনে জাসদ (ইনু) থেকে দলের জেলা সভাপতি, প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আতিউর রহমান আতিকের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী মনিরুল ইসলাম লিটন এবারও প্রার্থী হতে তৎপর রয়েছেন। তার পাশাপাশি তরিকত ফেডারেশনের মিজান সরকারও মহাজোটের প্রার্থী হতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। শেরপুর-২ (নকলা-নালিতাবাড়ী) ॥ নালিতাবাড়ী ও নকলা উপজেলার ২টি পৌরসভা ও ২১টি ইউনিয়ন নিয়ে এ আসন গঠিত। এ আসনে বিজয়ী প্রার্থীর মন্ত্রী হওয়ার রেওয়াজ থাকায় এটি স্থানীয়ভাবে ‘ভিআইপি’ আসন হিসেবে পরিচিত। এ আসনে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থা সুসংহত হলেও বিএনপি রয়েছে ভঙ্গুর অবস্থায়। জাতীয় পার্টি কিছুটা তৎপর হলেও অনেকটাই তা অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে। অন্যদিকে এ আসনে ভিআইপি প্রার্থী কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীসহ যেমন আওয়ামী লীগে রয়েছে সম্ভাব্য একাধিক প্রার্থী, তেমনি সাংগঠনিক দুর্দশার মধ্যেও বিএনপিরও রয়েছে একই অবস্থা। এ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য, কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ‘ক্লিন ইমেজ’ ও ব্যক্তিত্বের কারণে দলের সর্বাধিক অবস্থাসম্পন্ন প্রার্থী। ‘বাংলার অগ্নিকন্যা’ খ্যাত মতিয়া চৌধুরীকে ১৯৯১ সালে এ আসন থেকে প্রথমবার এলাকার পুত্রবধূ হিসেবে নির্বাচিত করেন ভোটাররা। এরপর তিনি ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০৮ ও ২০১৪’র নির্বাচনসহ ৪ দফায় নির্বাচিত হয়েছেন। ২০০১ এর নির্বাচনে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে তাকে হারানোর অভিযোগ রয়েছে। চার দফায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার সুবাদে ১৯৯৬ সালের সরকারের এবং ২০০৮ ও ২০১৪’র সরকারে তিনি টানা তিন দফায় কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এখন আর ‘পুত্রবধূ’ নন, তিনি এখানকার মানুষের উন্নয়নের ‘অগ্রদূত’ হিসেবে জায়গা করে নিয়েছেন। বেগম মতিয়া চৌধুরী মানেই ‘স্বচ্ছতা ও উন্নয়ন’Ñ এমনটাই বিশ্বাস করেন ভোটাররা। ফলে দলের একটি অংশের সঙ্গে বিভেদ-বিতর্ক থাকলেও তাকে এখানে ‘মহীরূহ’ বলেই জানেন সচেতন মহল। তিন দফায় সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী হওয়ার সুবাদে নিজ নির্বাচনী এলাকায় নজরকাড়া উন্নয়ন কর্মকা-ও বাস্তবায়ন করেছেন। কৃষিক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পাশাপাশি মসজিদ-মাদ্রাসা, ব্রিজ-কালভার্টসহ যোগাযোগ, বিদ্যুত ও শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক প্রসার ঘটেছে এলাকায়। বিদ্যুতের গ্রিড সাবস্টেশন, সীমান্ত সড়ক, নাকুগাঁও বন্দর আধুনিকায়ন, টিটিসি, কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল কাম ট্রেনিং সেন্টার নির্মাণ, পাশাপাশি এলাকায় সৃষ্টি করেছেন কর্মসংস্থানের। এতে স্থানীয় অর্থনীতিতেও প্রাণচাঞ্চল্য এসেছে। শহর থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সাধারণ মানুষ সন্তুষ্ট তার ঐকান্তিক উন্নয়ন প্রচেষ্টায়। সরকার ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে থাকার পরও নিয়মিত এলাকায় অবস্থান করে তিনি ভিজিএফ-ভিজিডি, টিআর-কাবিখা কর্মসূচী, মেধাবী-দরিদ্র শিক্ষার্থী, প্রতিবন্ধীদের সহায়তা দেন। এলাকায় ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ড মনিটরিং করেন। যে কারণে তার সম্পর্কে স্থানীয় নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন হচ্ছে, এ আসনে মতিয়া চৌধুরী ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। সাধারণ মানুষ তাঁর সৎ নেতৃত্বে মুগ্ধ। তা ছাড়া তিনি একজন জাতীয় পর্যায়ের নেতা। তাঁর বিকল্প কেউ নেই। কারো কারো মতে, মতিয়া চৌধুরীর তুলনা কারো সঙ্গেই চলে না। তিনি এ এলাকার জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছেন। সাধারণ মানুষ মতিয়া চৌধুরীর কর্মকা-ে আস্থাশীল। তিনি ছিলেন, আছেন ও থাকবেন। তাই আগামী নির্বাচনেও তিনি নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন পেয়ে বিপুল ভোটে বিজয়ী হবেন। তবে নালিতাবাড়ী ও নকলাতে একসময় মতিয়া চৌধুরীর কাছাকাছি থাকা কয়েকজন নেতা এখন তার প্রতিপক্ষ হিসেবে মাঠে নেমেছেন। কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের সাবেক সহ-সভাপতি, নালিতাবাড়ী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান কৃষিবিদ বদিউজ্জামান বাদশা গত নির্বাচনে মতিয়া চৌধুরীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে বহিষ্কৃত হলেও সদস্য পদ ফিরে পাওয়ার পর থেকেই আবারও তাঁর প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে মাঠে তৎপরতা চালাচ্ছেন। আগামী নির্বাচনেও প্রার্থী হওয়ার জন্য তৎপরতার অংশ হিসেবে তিনি এলাকায় সভা-সমাবেশ করছেন। বাদশার সমর্থকরা ‘মতিয়া ছাড়া’ নৌকার দাবি তুলছেন। আর ওই দাবির সঙ্গে সুর মিলাচ্ছেন এক সময় মতিয়া চৌধুরীর হাত ধরে এগিয়ে যাওয়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, হুইপ আতিউর রহমান আতিক এমপি। এছাড়া নালিতাবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোকছেদুর রহমান লেবু দলের বাইরে দেশরতœ জনঐক্য পরিষদের ব্যানারে স্বতন্ত্র অবস্থান নিয়ে তৎপর রয়েছেন মাঠে। হরহামেশাই তাকেও সভা-সমাবেশ করতে দেখা যায়। বিএনপি থেকে এ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে তৎপর রয়েছেন সাবেক হুইপ মরহুম আলহাজ জাহেদ আলী চৌধুরীর ছেলে, কেন্দ্রীয় বিএনপির নির্বাহী সদস্য, জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম-আহবায়ক প্রকৌশলী ফাহিম চৌধুরী। পারিবারিক কারণে দলে ও এলাকায় তার অবস্থান অনেকটা মজবুত হলেও নেতাকর্মীদের সঙ্গে উঠা-বসা কম থাকায় তাদের মাঝে হতাশাও রয়েছে। আওয়ামী লীগের ভিআইপি প্রার্থী বেগম মতিয়া চৌধুরীর বিপরীতে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে তার বিচক্ষণতা নিয়েও হতাশ অনেকেই। তারপরও আগামী নির্বাচনে তিনিই বিএনপি বা ২০ দলীয় জোটের প্রার্থী হচ্ছেনÑ এমনটাই গুঞ্জন রয়েছে। এ আসনে দলের অপর প্রার্থী বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা, সাবেক সচিব ব্যারিস্টার এম হায়দার আলী। এলাকা ও দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগের প্রশ্নে তার অবস্থা অনেকটাই নাজুক। যে কারণে তাকে নিয়ে মাঠে নেই তেমন আলোচনা। এরপরও কেন্দ্রীয় অবস্থানের কারণে এবং বিএনপি ঘরানার সাবেক সচিব হিসেবে তিনিই দলীয় মনোনয়ন বাগিয়ে নিলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই বলে মন্তব্য করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এছাড়া এ আসনে দল থেকে নালিতাবাড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম-আহ্বায়ক একেএম মোখলেছুর রহমান রিপনও মনোনয়ন প্রত্যাশী। এজন্য তার কিছুটা তৎপরতাও লক্ষণীয়। এ আসনে নকলার সাবেক ছাত্রনেতা জায়েদুর রশীদ শ্যামলকেও সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে ব্যানার ফেস্টুনে দেখা যাচ্ছে। জাতীয় পার্টি থেকে এ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী হয়েছেন সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত অধ্যাপক আব্দুস সালামের পুত্র, জেলা জাতীয় পার্টির সহ-সভাপতি মোঃ শওকত সাঈদ। একসময় এ আসনটি জাতীয় পার্টির নেতা অধ্যাপক আব্দুস সালামের দখলে থাকলেও ১৯৯১ সালে আসনটি জাতীয় পার্টির হাতছাড়া হয়ে যায়। কাজেই আসনটি পুনরুদ্ধারের জন্য শওকত সাঈদ দলীয় তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ ছাড়া জাতীয় সাংস্কৃতিক পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্য তালুকদার রোজী সিদ্দিকী ও উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি এ্যাডভোকেট আক্কাস আলীও দলীয় মনোনয়ন চাইবেনÑ এমন প্রচারও এলাকায় রয়েছে। শেরপুর-৩ (শ্রীবরদী-ঝিনাইগাতী) ॥ সীমান্তবর্তী শ্রীবরদী ও ঝিনাইগাতী উপজেলার একটি পৌরসভা ও ১৭টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এ সংসদীয় আসন। স্বাধীনতার পর থেকে এ আসনে বিজয়ী দল সরকার গঠন করে আসছে বলে এলাকায় এটি ‘লাকি’ আসন হিসেবে পরিচিত। যে কারণে সবার কৌতূহল থাকে এ আসনটির দিকে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকায় আওয়ামী লীগ এবার জেলায় সর্বোচ্চ রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। কারণ এ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল হক চাঁন ছাড়াও আরও এক ডজন সম্ভাব্য প্রার্থী মাঠে রয়েছেন। তবে এ আসনে তিন বারের সাবেক সংসদ সদস্য, জেলা বিএনপির সভাপতি মাহমুদুল হক রুবেলকে নিয়ে বিএনপি অনেকটাই নির্ভার রয়েছে। এ আসনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মনোনয়ন পেয়ে এক পরিবার থেকেই ঘুরে ফিরে এমপি নির্বাচিত হওয়ার রেকর্ডও রয়েছে। প্রকৌশলী ফজলুল হক চাঁন ও মাহমুদুল হক রুবেল আপন চাচা-ভাতিজা। আগামী নির্বাচনেও চাচা-ভাতিজার লড়াই হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন অনেকেই। এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ২০০৮ ও ২০১৪’র নির্বাচনে বিজয়ী প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল হক চাঁন আগামী নির্বাচনেও দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী। দুই মেয়াদেই ক্ষমতাসীন দলের প্রতিনিধিত্ব করায় এলাকায় রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্টসহ যোগাযোগ ব্যবস্থা, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসাসহ নানা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। এলাকায় গ্রামীণ যোগাযোগ অবকাঠামো, পাহাড়ী জনপদে হাতির তা-ব থেকে মানুষকে রক্ষার জন্য নেয়া পদক্ষেপ, গ্রামে বিদ্যুত সংযোগ এবং আদিবাসীদের উন্নয়নে বিশেষ পদক্ষেপসহ হরহামেশাই নেতাকর্মী ও সমর্থকদের নিয়ে এলাকার নানা কর্মকা-েও ব্যস্ত থাকেন। যে কারণে দলের বাইরে সাধারণ মানুষের সঙ্গেও তার একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তবে তার বিষয়ে জেলায় বাদ থাকা একমাত্র উপজেলা সদর ঝিনাইগাতীকে পৌরসভায় রূপান্তর না করাসহ দলের মূল নেতৃত্বকে পাশ কাটিয়ে বিশেষ কোটারির লোকজন নিয়ে উন্নয়ন কাজ করার অভিযোগও রয়েছে। ওই অবস্থায় দলের একটি অংশ তার বিপরীতে অবস্থান নিলেও মাঠে থাকা প্রার্থীদের তুলনায় তাকেই যোগ্য ভাবছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এ আসনে আগামী নির্বাচনকে ঘিরে আওয়ামী লীগ থেকেই আরও এক ডজনেরও বেশি সম্ভাব্য প্রার্থী মাঠে রয়েছে। তারা হচ্ছেন অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক জিএম, জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের সাবেক কমান্ডার ও শেরপুর সরকারী কলেজের সাবেক ভিপি নুরুল ইসলাম হিরু, ঝিনাইগাতী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এসএম আব্দুল্লাহেল ওয়ারেজ নাইম, জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাসরিন রহমান ফাতেমা, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ইফতেখার কাফী জুবেরী, শ্রীবরদী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোতাহারুল ইসলাম লিটন, জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান প্রয়াত খন্দকার খুররমের ছোটভাই কেন্দ্রীয় যুবলীগ নেতা খন্দকার ফারুক আহমদ, সাবেক এমপি প্রয়াত এম এ বারীর ছেলে মোহসিনুল বারী রুমী, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সহ-সম্পাদক কৃষিবিদ ড. ফররুখ আহমদ, কেন্দ্রীয় কৃষকলীগ নেতা কৃষিবিদ আল ফারুক ডিওন, ইউপি চেয়ারম্যান এডিএম শহিদুল্লাহ ও ছাত্রলীগের সাবেক জাতীয় পরিষদ সদস্য মিজানুর রহমান রাজা। তাদের মধ্যে প্রকৌশলী একেএম ফজলুল হক চাঁনকে টেক্কা দিতে ক্লিন ইমেজের নুরুল ইসলাম হিরুর পাশাপাশি এসএম আব্দুল্লাহেল ওয়ারেজ নাইম ও নাসরিন রহমান ফাতেমা দলীয় নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষের মাঝেও অনেকটা জনমত গড়ে তুলেছেন।
×