ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কোন মতেই থামছে না পাহাড়ের টার্গেট কিলিং

প্রকাশিত: ০৫:১৭, ১৯ আগস্ট ২০১৮

  কোন মতেই থামছে  না পাহাড়ের টার্গেট কিলিং

মোয়াজ্জেমুল হক/জীতেন বড়ুয়া ॥ পাহাড়ে আবারও টার্গেট কিলিং। রক্তের হোলিখেলা রয়েছে অব্যাহত। পাহাড়ের আঞ্চলিক দুটি সংগঠন জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ও ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। এ দুটি গ্রুপই আবার দ্বিধাবিভক্ত। ফলে আঞ্চলিক এই দুই সংগঠন নিজেদের মধ্যে চার ভাগে বিভক্ত। বিশেষ করে পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে এ দুটি সংগঠন চাঁদাবাজিসহ নিজেদের একক আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ের অপতৎপরতায় লিপ্ত। খুন, খারাবি, রাহাজানি, চাঁদাবাজি, প্রভাব বিস্তারসহ এমন কোন ঘটনা নেই যা তারা করছে না। ঐতিহ্যবাহী পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর থেকে প্রথমে জেএসএস থেকে বেরিয়ে যায় প্রসীত বিকাশ খীসা নেতৃত্বে একটি দল। তারা সৃষ্টি করে ইউপিডিএফ নামে একটি সংগঠন। সে থেকে জেএসএস ও ইউপিডিএফের মধ্যে গ্রুপিং ও কোন্দল কেবল বাড়তেই থাকে। ফলে পড়তে থাকে উভয় গ্রুপের লাশ। আরও পরে এই দুই আঞ্চলিক সংগঠনের মধ্যে উপগ্রুপ সৃষ্টি হয়ে আরও দুই সংগঠনের জন্ম নেয়। ফলে এরা এলাকাভিত্তিক আধিপত্য বজায় রেখেছে। এই আধিপত্য ক্রমাগতভাবে বিস্তৃতি ঘটাতে শুরু হয়েছে টার্গেট কিলিং। এই টার্গেট কিলিংয়ের সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটল শনিবার সকালে খাগড়াছড়ি শহরের সন্নিকটস্থ স্বনির্ভর বাজার এলাকায়। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, পাহাড়ে আধিপত্যের লড়াইয়ে আঞ্চলিক এই দুটি দল ও উপদলগুলো মরিয়া হয়ে উঠেছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে জনসংহতি সমিতি এম এন লারমা, জেএসএস (সন্তু) ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ও ইউপিডিএফ মুখোমুখি অবস্থানের কারণে সবুজের পাহাড় কেবলই রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে। যা ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত রূপে চিহ্নিত হচ্ছে। প্রতিনিয়ত ঝরছে তরতাজা প্রাণ। যা চরম উদ্বেগজনক। কিছুতে বন্ধ হচ্ছে না রক্তক্ষয়ী সংঘাত। ফলে ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে পাহাড়ের সংঘাতময় পরিস্থিতি। জেএসএস-ইউপিডিএফে ক্যাডারদের হাতে রয়েছে অত্যাধুনিক ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারু। এতে করে দুর্বৃত্তরা বেপরোয়া। তাদের এই বেপরোয়া তৎপরতা সাধারণ পাহাড়ী বাঙালীদের মাঝে ভয়ানক আতঙ্কগ্রস্ত করে রেখেছে। বহু আগে থেকে অনেকেই প্রাণ রক্ষার্থে নিরাপদ স্থান যে সরে যাওয়া শুরু করেছে তা অব্যাহত রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে শুরু হয়েছে দুটি পাহাড়ী সংগঠনের দ্বিধা বিভক্ত আরও দুটি উপগ্রুপসহ ৪টি সংগঠনের দুর্বৃত্তরা টার্গেট করেই কিলিংয়ের ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। ফলে একের পর এক বাড়ছে লাশের মিছিল। অনাকাক্সিক্ষত এসব খুন-পাল্টা-খুনের ঘটনা এবং হত্যাকা-ে ব্যবহৃত অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানিতে আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম। পরিস্থিতি এখন যেদিকে যাচ্ছে তাতে সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বের ইউপিডিএফ ও জেএসএস এমএনলারমা গ্রুপ এবং ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক সংগঠন কার্যত একে অপরকে ঘায়েল করে আধিপত্য বিস্তার ও রক্ষার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েই টার্গেট কিলিং শুরু করেছে। শনিবারের খাগড়াছড়ির ঘটনা এরই একটি অংশ। টার্গেট কিলিংয়ে পর্যন্ত বেসরকারী হিসাবে মতে, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে গত ৫ মাসে পাহাড়ী সংগঠনের সশস্ত্র অপতৎপরতায় খুন হয়েছে ১৮ নেতাকর্মী। খুন হয়েছেন এমএন লারমা গ্রুপের নেতা নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমা। গুলিবিদ্ধ হন তার সহযোগী রূপম চাকমা। সেই শক্তিমানের শেষকৃর্তে যোগ দিতে গিয়ে মহালছড়িতে বেতছড়িতে খুন হন ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকদলের আহ্বায়ক তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্র্মাসহ ৫ নেতাকর্মী। পাহাড়ীদের সংঘাতে বলি হয়েছে মোঃ সজীব নামের এক মাইক্রো চালকও। পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর পাহাড়ে আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন হলেও চুক্তির পক্ষ-বিপক্ষ পাহাড়িদের সশস্ত্র সংগঠনগুলোর রক্তের হোলিখেলার অপতৎপরতার পার্বত্য চট্টগ্রামের জনজীবনকে ক্রমাগতভাবে বিপর্যয়কর পরিস্থিতিকে নিয়ে যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) এবং ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এই দুই আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের লালিত অস্ত্রধারীদের উন্মাদনায় বিশেষ করে খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় সাম্প্রতিক আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি সাধারণ মানুষকে শঙ্কিত অবস্থায় রেখেছে। দেশ-বিদেশে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণায় পার্বত্যবাসীর অবস্থা এখন যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা সমতুল্য। দিন-রাত সমান আতঙ্কে থাকছে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী বাঙালী উভয় সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠী। স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, প্রতিবার সংঘর্ষের সময় পাহাড়ের বিবাদমান সশস্ত্র সংগঠনগুলো ব্যবহার করছে অত্যাধুনিক আগ্নেয়ান্ত্র। বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে দুর্বৃত্তরা ভারি অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ ব্যবহার করছে। কিন্তু সংঘর্ষ শেষ হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এই ৪ গ্রুপের কাছ থেকে কোন অস্ত্র উদ্ধার করতে পারেনি। ফলে ঐসব অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে দুর্বৃত্তরা দিন দিন বেপরোয়া অবস্থানে চলে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো আরও জানায়, টার্গেট কিলিংয়ের যে তালিকার কথা ছড়িয়ে পড়ে এ নিয়ে বর্তমানে চরম আতঙ্কে রয়েছেন ইউপিডিএফ সমর্থিত খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা চেয়ারম্যান চঞ্চুমনি চাকমা, পানছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান সর্বোত্তম চাকমাসহ পাহাড়ের একাধিক উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউপি চেয়ারম্যানসহ চার সংগঠনের হেভিওয়েট নেতারা। যদিওবা বিষয়টি নিয়ে সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ও পানছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যানের একাধিক নাম্বারে মুঠোফোনে বারবার চেষ্টা করেও সংযোগ পাওয়া যায়নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চার পাহাড়ী সংগঠনের সমর্থিত নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউপি চেয়ারম্যানরা বর্তমানে নিজ নিজ নিরাপত্তার বেষ্টনীর বাহিরে কোথাও সরকারী ও সামাজিকভাবে আমন্ত্রণ, নিমন্ত্রণ থাকলেও তাতে এদের খুব বেশি উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয় না। এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী ১৯৯৭ সালে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম (শান্তিচুক্তি) চুক্তির পর থেকে চলতি বছরের ৪ মে পর্যন্ত তিন পার্বত্য জেলায় সামাজিক অপরাধের বাইরে খুন হয়েছে ২ হাজার ২৪৫ জন। অপহৃত হয়েছে ২ হাজার ৩৯৬ জন। নিহতের অধিকাংশই বাঙালী। বাঙালীরা খুন হয়েছেন সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও চাঁদাবাজির জের ধরে এবং অধিকাংশই পাহাড়ীতে হাতে। এছাড়া নিহতদের এক-তৃতীয়াংশ পাহাড়ী। তন্মধ্যে অধিকাংশ হত্যাকা- ঘটেছে পাহাড়ীদের নিজস্ব অন্তর্কোন্দলের কারণে। চলতি বছরে সশস্ত্র তৎপরতায় বিগত ৫ মাসে খুন হয়েছে রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে মোট ২৩ জন। এর মধ্যে গত মে মাসে রাঙ্গামাটি সড়কে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক সংগঠনের আহ্বায়ক তপন জ্যোতি চাকমাসহ ৫ জন উপজাতি নেতার সঙ্গে গুলিতে বলি হয়েছেন। আরও বলি হয়েছেন বাঙালী নিরীহ মাইক্রোচালক মোঃ সজীব। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন ৮ জন নেতাকর্মী। এর আগের একই মাসে নিজ কার্যালয়ের সম্মুখে প্রতিপক্ষের গুলিতে খুন হন নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেএসএস এমএনলারমা গ্রুপের নেতা এ্যাডভোকেট শক্তিমান চাকমা। এছাড়াও গত ৪ মার্চ হতে অপহৃত অবস্থায় রয়েছে রামগড়ের মারমা ঐক্য পরিষদ নেতা চাইথুই মারমা এবং গত ১৬ এপ্রিল থেকে মাটিরাঙ্গা উপজেলার কাঠ ব্যবসায়ী মোঃ সালাউদ্দীন, মোঃ বাহার মিয়া (ড্রাইভার) ও মহরম আলী অপহৃত অবস্থায় রয়েছেন। পরিবার সূত্র জানায়, তিন কাঠ ব্যবসায়ীকে মহালছড়ির মাইসছড়ি হতে অপহরণের শিকার হন। অপহরণের দীর্ঘদিন পরও তারা মুক্তি পায়নি এবং প্রশাসন এদের উদ্ধার করতে পারেনি।
×