ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কোরবানির পশুর হাট ঘিরে জাল নোট কারবারিরা তৎপর

প্রকাশিত: ০৫:১৬, ১৯ আগস্ট ২০১৮

  কোরবানির পশুর হাট ঘিরে জাল নোট কারবারিরা তৎপর

রহিম শেখ ॥ দরজায় কড়া নাড়ছে মুসলমানদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব ঈদ-উল-আজহা। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে রাজধানীসহ সারা দেশে কোরবানি পশুর হাটগুলো জমে উঠতে শুরু করেছে। একই সঙ্গে বড় এই উৎসবকে সামনে রেখে তৎপরতা বাড়ছে জাল টাকার কারবারিদের। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সবচেয়ে বেশি জাল হচ্ছে ১ হাজার টাকা ও ৫০০ টাকার নোট। পরিসংখ্যান বলছে, গত তিন বছরে প্রায় তিন কোটি টাকার জাল নোট শনাক্ত করা হয়েছে। ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে জাল নোটের একটি বিরাট অংশ। তবে বাজারে জাল নোটের বিস্তার ঠেকাতে ইতোমধ্যেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে সতর্ক করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিটি হাটে একাধিক বুথ বসিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতার নোট যাচাই করে দিচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। জানা গেছে, জাল নোট তৈরি ও বাজারজাতের সঙ্গে জড়িত রয়েছে বেশ কয়েকটি চক্র। এদের সঙ্গে কিছু অসাধু ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীও জড়িত। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকটি চক্রকে শনাক্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। বাংলাদেশ ব্যাংকের জাল নোট প্রচলন প্রতিরোধ বিষয়ক এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশে প্রচলিত নোটগুলোর মধ্যে ৫০০ ও ১০০০ টাকা মূল্যমানের নোটই বেশি পরিমাণে জাল হচ্ছে। জাল নোট তৈরির সরঞ্জাম ও নোটসহ যেসব প্রতারক চক্র ধরা পড়েছে সেগুলোর বেশিরভাগই ওইসব নোটের জালকারী। ৫০ ও ১০০ টাকা মূল্যমানের নোটগুলো এখন জাল হচ্ছে না বললেই চলে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, জাল নোটসহ গ্রেফতার করা চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ থাকলেও এ ক্ষেত্রে জোরালো কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। বিছিন্নভাবে যেসব জাল নোট উদ্ধার করা হয়, ওইসব মামলায় যাদের সাক্ষী করা হয় তারা নিয়মিত সাক্ষ্য দিতে আসেন না। ফলে মামলাগুলো নিষ্পত্তি হচ্ছে না। আর যেগুলোর নিষ্পত্তি হচ্ছে সেগুলোয় সাজা হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে জাল টাকা প্রতিরোধ কমিটির সভায় বারবার বিষয়টি তুলে ধরা হলেও নেয়া হচ্ছে না কার্র্যকর কোনো উদ্যোগ। জানা যায়, জাল নোটের কারবারিরা সাধারণত বড় নোট বিশেষত এক হাজার ও ৫০০ টাকার নোট সবচেয়ে বেশির জাল করে থাকে। জালনোট সংক্রান্ত এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সর্বমোট ২০ হাজার ৭৯০টি জাল নোট ধরতে পেরেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। উদ্ধারকৃত নোটের মধ্যে এক হাজার টাকার জালনোটের সংখ্যা ১৫ হাজার ৭৮০টি। যা মোট ধরাপড়া নোটের ৭৬ শতাংশ। ওই পরিসংখ্যানে দেখা যায়, আলোচ্য সময়ে ৫০০ টাকার নোট ধরা পড়েছে তিন হাজার ৮৯৩টি। ১০০ টাকার নোট ধরা পড়েছে এক হাজার ১১৮টি। ৫০ টাকার জাল নোট ধরা পড়েছে ৭২টি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মোঃ সিরাজুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জাল নোটের ব্যবহারও বেড়েছে। যার ফলে সাধারণ মানুষকে এ ধরনের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। এ কারণে জাল নোটের ব্যবহার বন্ধে বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তিনি বলেন, জালনোটের মামলার সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। কারণ এ বিষয়ে বিচারকার্যে অনেক সময় লেগে যাচ্ছে। জালনোট কারবারিদের কঠোরভাবে দমন করতে নতুন আইন হচ্ছে। আইন হলে জালনোটের কারবারের সঙ্গে জড়িতদের সহজেই জামিন পাওয়া বন্ধ হবে এবং কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, অধিকাংশ মামলার আসামিরা সহজেই জামিন পেয়ে যান। চূড়ান্ত রায়ে খালাস পান। এর কারণ হচ্ছে জাল টাকার মামলায় সাক্ষী পাওয়া যায় না। যেখান থেকে জাল টাকা উদ্ধার করা হয় সেখানকার দারোয়ান, রিক্সাচালক কিংবা ভাসমান কাউকে সাক্ষী করা হয়। এ ছাড়া ভুল ঠিকানা ব্যবহারেরও প্রবণতা রয়েছে। নোট জালকারী চক্রের পেছনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা থাকেন। তাই কারবারিদের সঙ্গে যোগসাজশে ঘুষের বিনিময়ে বা হুমকির কারণে ভৌতিক সাক্ষী করে পুলিশ। এসব সাক্ষীর অস্তিত্ব না পেলে আসামিরা সহজেই খালাস পেয়ে যায়। আবার অনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমে পুলিশ অভিযোগ শিথিল করে চার্জশিট দেয়। এই চার্জশিট অনুসারে পরবর্তীতে মামলার বিচার শুরু হয়। এতে সহজেই মামলা থেকে রেহাই পায় জাল টাকা প্রস্তুত ও সরবরাহকারীরা। পরে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এ ব্যাপারে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া শাখার উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, জাল নোট তৈরি চক্রের সদস্যদের দিকে কঠোর নজরদারি রয়েছে। ইতোমধ্যে এই চক্রের বড় সিন্ডিকেটের সদস্যরা গ্রেফতারও হয়েছে। অপরাধীদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিটও দেয়া হচ্ছে। আসামি জামিন পাওয়ার বিষয়টি বিজ্ঞ আদালতই দেখেন। তিনি বলেন, প্রতিবারের মতো এবারও জাল নোট শনাক্তের জন্য পশুর হাটে মেশিন থাকবে। জাল টাকা ঠেকাতে হাটে মেশিন নিয়ে ব্যাংক ॥ এদিকে প্রতিবছর কোরবানি পশুর হাটে বড় অঙ্কের নগদ অর্থের লেনদেনকে কেন্দ্র করে সক্রিয় হয় জাল নোট চক্রগুলো। এসব চক্রের অপতৎপরতা রোধ এবং জাল নোটের বিস্তার ঠেকাতে ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২২টি অস্থায়ী পশুর হাটে নোট শনাক্তকারী মেশিন নিয়ে বসছে ৪৭টি দেশি-বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংক। প্রতিটি হাটে থাকছে কোন না কোন ব্যাংকের জাল নোট শনাক্তকরণ বুথ। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১০টি হাটের মধ্যে মিরপুর-গাবতলী গবাদি পশুর হাটে সোনালী, সীমান্ত, ঢাকা ও পূবালী ব্যাংকের জাল নোট শনাক্তকরণ বুথ থাকছে। উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরের প্রথম গোলচত্বরসংলগ্ন পশুর হাটে স্ট্যান্ডার্ড, শাহজালাল ইসলামী ও ইউনিয়ন ব্যাংক দায়িত্ব পালন করবে। খিলক্ষেত ৩০০ ফুট সড়ক ও দক্ষিণ পাশের বসুন্ধরা প্রাচীরসংলগ্ন হাটে ব্যাংক এশিয়া ও প্রাইম ব্যাংক, খিলক্ষেত বনরূপা আবাসিক প্রকল্পের খালি জায়গাসংলগ্ন হাটে ট্রাস্ট ও আইএফআইসি ব্যাংক, ভাটারা (সাইদনগর) পশুর হাটে যমুনা ও ব্র্যাক ব্যাংক, বসিলা পুলিশ লাইনসংলগ্ন হাটে অগ্রণী ও মেঘনা ব্যাংক, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের খেলার মাঠে ওয়ান ও উত্তরা ব্যাংক, ইস্টার্ন হাউজিংসংলগ্ন হাটে সিটি ব্যাংক ও প্রিমিয়ার ব্যাংক, মিরপুর ডিওএইচএসসংলগ্ন হাটে ব্যাংক আলফালাহ ও বেসিক এবং উত্তরখান মৈনারটেক শহিদনগর হাউজিংসংলগ্ন হাটে ইস্টার্ন ব্যাংক ও বিডিবিএল জাল নোট শনাক্তকরণ বুথের মাধ্যমে সেবা দান করবে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১২টি কোরবানি পশুর হাটের মধ্যে খিলগাঁও রেলগেটসংলগ্ন হাটে এবি ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের নোট যাচাইয়ে বুথ থাকছে। ব্রাদার্স ইউনিয়নের বালুর মাঠসংলগ্ন গোপীবাগ হাটে জাল নোট শনাক্তকরণ বুথ থাকছে এইচএসবিসি ও এনসিসি ব্যাংকের। এ ছাড়া ধোলাইখাল ট্রাক টার্মিনালসংলগ্ন হাটে মিডল্যান্ড ও আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, রহমতগঞ্জ খেলার মাঠে বাংলাদেশ কমার্স ও মার্কেন্টাইল ব্যাংক, ঝিগাতলা পশুর হাটে এক্সিম ও এনআরবি গ্লোবাল, কমলাপুর স্টেডিয়ামের পূর্ব পাশের হাটে এনআরবি ও এসবিএসি ব্যাংক, ধূপখোলা হাটে ডাচ্-বাংলা ও সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, পোস্তগোলা হাটে রূপালী ও ইসলামী ব্যাংক, দনিয়া হাটে মধুমতি ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, মেরাদিয়া বাজারসংলগ্ন হাটে ফার্স্ট সিকিউরিটি ও কৃষি ব্যাংক, কামরাঙ্গীর চর হাটে ন্যাশনাল ও সাউথইস্ট ব্যাংক এবং শ্যামপুর বালুর মাঠসংলগ্ন হাটে জনতা, ইউসিবি ও ফারমার্স ব্যাংক জাল নোট যাচাই সংক্রান্ত সেবা প্রদান করবে।
×