ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আত্মোপলব্ধির কোরবানির ঈদ

মনে যে পশু, তার গলায় দড়ি দেবে কে?

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ১৯ আগস্ট ২০১৮

 মনে যে পশু, তার গলায় দড়ি দেবে কে?

মোরসালিন মিজান ॥ ঈদ-উল আজহা আনন্দের। আনন্দের তো বটেই। বিভিন্ন হাট ঘুরে সেরা গরুর খোঁজ করা। কেনা। তারপর থেকে ডিপ ফ্রিজ ভর্তি কাঁচা মাংস। ইউটিউব দেখে সুস্বাদু রেসিপি। ভূরিভোজ। কার না ভাল লাগে? মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, আসন্ন ঈদে কোরবানির জন্য প্রস্তুত আছে ১ কোটি ১৫ লাখ ৮৮ হাজার পশু। এর মধ্যে কোরবানিযোগ্য গরু ও মহিষের সংখ্যা ৪৪ লাখ ৫৭ হাজার। ছাগল ও ভেড়ার সংখ্যা ৭১ লাখ। এছাড়া কোরবানিযোগ্য উট ও দুম্বার সংখ্যা ৩১ হাজার। প্রতি বছরই এমন বিপুলসংখ্যক পশু কোরবানি হয়। এবারও হবে। কিন্তু একসঙ্গে এত পশুর জীবন নেয়া শুধু কি ভূরিভোজের জন্য? রসনা বিলাসই কি শেষ কথা? না, একদমই তা নয়। বরং এই কোরবানির আছে আলাদা তাৎপর্য। ‘ঈদ-উল আজহা’ কথাটি আরবী। এই বাক্যাংশের বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘ত্যাগের উৎসব’। ঈদে ত্যাগই মূল কথা। ত্যাগ করার আনন্দটুকুই প্রকৃত। এ প্রসঙ্গে নজরুল লিখেছেন- ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্বোধন। অন্য জায়গায় কবির উচ্চারণÑ মনের পশুরে করো জবাই,/পশুরাও বাঁচে, বাঁচে সবাই। এর চেয়ে সুন্দর কথা আর কি হতে পারে? মনের ভেতরে যে পশুত্ব, সেটি আগে ধ্বংস করার তাগিদ দিয়েছেন তিনি। আত্মশুদ্ধির ওপর জোর দিয়েছেন। কয়েকদিন পর যারা পশু কোরবানি দেবেন তাদের ভাবনায় কি আছে এইসব মহৎ চাওয়া? থাক বা না থাক, প্রতিদিন ঢাকায় ঢুকছে অসংখ্য ট্রাক। ট্রাকভর্তি গরু। বিভিন্ন হাটের পানে ছুটছে। রাজধানী ঢাকায় এবার হাট বসেছে ২৩টি। দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে ১৩টি। উত্তরে ১০টি হাট বসেছে। সবকটিতেই পশু। গরু মহিষ ছাগল উট। যার যা চাই, আছে। কিনছেনও। শুক্র ও শনিবার থেকে ভাল বিক্রি। পশু কিনে বাড়ি ফিরতে দেখা যাচ্ছে বহু লোককে। কোরবানির পশুর গলায় পরানো রশিটি তাদের হাতে ধরা। এ পর্যায়ে আবারও প্রশ্নÑ মনে যে পশুর বাস, সেটির গলায় দড়ি পরাবে কে? আজ যখন মুসলমানদের ধর্মীয় এই আচার পালন করার জোর প্রস্তুতি চলছে তখন আমরা দিব্য চোখে দেখি, আমাদের চারপাশে মানুষের বড় অভাব। চেহারায় মানুষ, ভেতরে অন্য কেউ। সমাজ থেকে মানবিকতার বোধ নির্বাসিত হচ্ছে ক্রমেই। হিংস্র হচ্ছে মানুষ। বেপরোয়া সেই গাড়ি চালকের কথাই ধরা যাক, শহীদ রমিজ উদ্দীন স্কুলের দুই শিক্ষার্থীর ওপর বাস তুলে দিল সে। ষাঁড়ের মতো গুঁতোগুঁতি করতে করতে দুটি বাস এগিয়ে আসছিল। কার আগে কে যাত্রী তুলবে, সেই প্রতিযোগিতা। ততক্ষণে চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ গেল ছোট দুটি ছেলে মেয়ের। চলন্ত বাসে তরুণী ধর্ষণ, পরে জঙ্গলে ছুঁড়ে ফেলার মতো বীভৎস মনের কথাও আমরা জানি। আগস্ট যেহেতু, পঁচাত্তরের সেই বর্বরদের কথাও প্রাসঙ্গিক হবে। মানুষের মতো দেখতে হিং¯্র হায়েনারা ওই বছরের ১৫ আগস্ট বাঙালীর বুকে চির-বেদনা ঢেলে দিয়েছিল। পাষ-রা মুক্তিসংগ্রামের মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। নবপরিণিতা পুত্রবধূটির মেহেদী রাঙা হাত রক্তে ধুয়ে গিয়েছিল। কেঁদে কেটে রক্ষা পায়নি দশ বছরের শিশু। মানুষের ভেতরেই এমন বর্বর মানুষের বাস। আজও বহু মানুষের মনে, তারা নিজেরাও হয়ত জানেন না, পাশবিকতা ঠাঁই করে নিয়েছে। বিভিন্ন সময় বিচ্ছিন্নভাবে হলেও কুৎসিত মনের পরিচয় পাওয়া যায়। মানুষকে তাই নিজের সঙ্গে কথা বলতে হবে। পশু কোরবানির আগে মনের ভেতরের পশুকে বদ করা আবশ্যক। ঈদ-উল আজহার এই শিক্ষা কি আমরা গ্রহণ করছি? ঈদ-উল আজহা একইসঙ্গে আত্মত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত। নিজের জন্য বাঁচা নয় শুধু, অন্যের জন্য আত্মোৎসর্গ করতে উদ্বুদ্ধ করে। আমরা কি উদ্বুদ্ধ হচ্ছি?
×