ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

বাংলার চিরন্তন মুজিব

প্রকাশিত: ০৪:৩৬, ১৯ আগস্ট ২০১৮

 বাংলার চিরন্তন মুজিব

(গতকালের চতুরঙ্গ পাতার) ২৫ মার্চ ১৯৭১ টালমাটাল মার্চের এদিন মানুষের ঢল নামে মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানম-ির ৩২ নম্বর বাসভবনে। সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত সারাদিন মাঝে মাঝে মিছিলের সামনে এসেই তিনি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা করেন এবং সবাইকে সর্বাত্মক সংগ্রামের জন্য তৈরি হবার আহ্বান জানান। এদিন তার বাড়িতে সকাল থেকে অগণিত সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন এবং তাদের মধ্যে প্রায় দু’শ’ ছিলেন বিদেশী। বেলা ১২টায় শেখ মুজিব খবর পান যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সদলবলে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে চলে গেছেন। ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে পূর্ব বাংলায় সামরিক অভিযান চালানোর নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন আমি শুধু বাংলার মাটি চাই, মানুষ নয়। বাঙালীর আবেগ, সংগ্রাম ও মুক্তির আকাক্সক্ষাকে নির্মূল করতে অস্ত্র হাতে ইতিহাসের নির্মম হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠার নীলনক্সা চূড়ান্ত করে শোষিত ও নির্যাতিত মানুষের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষাকে রক্তের বন্যায় ডুবিয়ে দিতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইটের নামে ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে পৈশাচিক তা-ব চালিয়ে ছাত্র-শিক্ষক এবং নিরীহ লোকদের গণহারে নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী দখলদারী থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শেখ মুজিবকে পাকিস্তানী কারাগার হতে মুক্তি দেয়া হয়। ৮ জানুয়ারি ১৯৭২, শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানী কারাগার হতে মুক্তি পেয়ে পিআইএর একটি বিশেষ বিমানে লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রা করেন। ৮ জানুয়ারি সকাল ৭টায় বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে প্রচারিত খবরে বলা হয় ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বিমানযোগে লন্ডনে আসছেন।’ বিমানবন্দরে অবতরণ করার পর ব্রিটিশ সরকার বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা দেয়। এবং ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বহরের কমেট জেটে লন্ডন থেকে বিজয়ীর বেশে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। সারাদেশে আনন্দ ও উচ্ছ্বাসের বন্যা বয়ে যায়। সমাজের সর্বস্তরের লাখো জনতা তেজগাঁও পুরনো বিমানবন্দরে তাঁকে বীরোচিত অভ্যর্থনা জানায়। লন্ডন থেকে প্রকাশিত দৈনিক গার্ডিয়ান পত্রিকার ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়েছিল : ‘শেখ মুজিব ঢাকা বিমানবন্দরে পদার্পণ করা মাত্র নতুন প্রজাতন্ত্র এক সুদৃঢ় বাস্তবতা লাভ করে।’ ব্যক্তিত্বে ও নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু বিশ্ব মিডিয়ার নজর কেড়েছিলেন। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় তাকে তুলে ধরা হয়েছে ‘মহান নেতা’ ও ‘অসামান্য ব্যক্তিত্ব’ শিরোনামে। নিউজউইক ম্যাগাজিন তাদের প্রচ্ছদে বঙ্গবন্ধুকে ‘পোয়েট অব পলিটিকস’ আখ্যায়িত করে নিবন্ধ প্রকাশ করে। ফিন্যানশিয়াল টাইমস ১৯৭৫ সালে তাকে নিয়ে লিখে বঙ্গবন্ধু না থাকলে কখনই বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন এর প্রচ্ছদে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে শিরোনাম করে ‘বাংলাদেশ : ফ্রম জেইল টু পাওয়ার’। দ্য গার্ডিয়ানে লেখা হয় ‘শেখ মুজিব ছিলেন এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব’। পশ্চিম জার্মানির পত্রিকায় ‘শেখ মুজিবকে চতুর্দশ লুইয়ের সঙ্গে তুলনা করা হয়। জনগণ তার কাছে এত প্রিয় ছিল যে, লুই ইয়ের মতো তিনি এ দাবি করতে পারেন, আমি-ই রাষ্ট্র। প্রয়াত ভারতীয় বিজ্ঞানী ও সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে. আবদুল কালামের ভাষায় বঙ্গবন্ধু নিজেই ছিলেন ‘ঐশ্বরিক আগুন’ এবং তিনি নিজেই সে আগুনে ডানা যুক্ত করতে পেরেছিলেন। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ভাষায় তিনি হলেন এ দেশের মুক্তিদাতাও বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের বন্ধু। কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হিমালয়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন। শ্রীলঙ্কার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী লক্ষণ কাদির গামা উপমহাদেশের এ মহান নেতা সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়া গত কয়েক শতকে বিশ্বকে অনেক শিক্ষক, দার্শনিক, দক্ষ রাষ্ট্রনায়ক, রাজনৈতিক নেতা ও যোদ্ধা উপহার দিয়েছে। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান সবকিছুকে ছাপিয়ে যান, তার স্থান নির্ধারিত হয়ে আছে সর্বকালের সর্বোচ্চ আসনে। সাবেক ইরাকী প্রেসিডেন্ট প্রয়াত নেতা সাদ্দাম হোসেন বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রথম শহীদ। তাই তিনি অমর।’ ফিলিস্তিনী নেতা ইয়াসির আরাফাত বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বলেন, ‘আপোসহীন সংগ্রামী নেতৃত্ব আর কুসুম কোমল হৃদয় ছিল মুজিব চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।’ নোবেল বিজয়ী উইলিবান্ট বলেন, ‘মুজিব হত্যার পর বাঙালীদের আর বিশ্বাস করা যায় না, যারা মুজিবকে হত্যা করেছে তারা যে কোন জঘন্য কাজ করতে পারে।’ বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার খবর শুনে কাস্ট্রো বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারালো তাদের একজন মহান নেতাকে, আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে। মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত এতটাই দুঃখ পেয়েছিলেন যে, তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘তোমরা আমারই দেয়া ট্যাঙ্ক দিয়ে আমার বন্ধু মুজিবকে হত্যা করেছ! আমি নিজেই নিজেকে অভিশাপ দিচ্ছি।’ এ মহান নেতার ৫৫ বছরের জীবনের প্রায় অর্ধেক শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য আর যৌবনের এক অংশ কেটে যায় ভবিষ্যতের প্রস্তুতিতে, পরাধীন ভারতবর্ষে। তারপর ১৯৪৭ সালের আগস্ট থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত ২৪ বছর কেটে যায় নবগঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তানে বাংলার মানুষের এবং বাঙালীর অধিকার আদায়ের সংগ্রামে। জীবনের এই অধ্যায়ের প্রায় পুরো সময়টাই কেটে গেছে পাকিস্তানীদের হাতে প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হয়ে এবং কারা অভ্যন্তরে। আর ২৫ মার্চ ১৯৭১-এর মধ্যরাত থেকে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে মুক্তি পাওয়া পর্যন্ত ৯ মাস কেটে যায় সুদূর পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে। মুক্তির পরের সাড়ে তিন বছর সময় অতিবাহিত হয় একদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশকে গড়ে তোলার নিরবচ্ছিন্ন কঠোর প্রচেষ্টায় এবং একই সঙ্গে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত সামলাতে। ১৯৭৫ সালের সেই ভোরে কি বৃষ্টি হয়েছিল? খুব ভোরবেলা টেলিফোনের শব্দে ঘুম ভাঙে বঙ্গবন্ধুর, তিনি শুনতে পান আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় হামলা হয়েছে, গোলাগুলি হচ্ছে। তিনি টেলিফোন করেছিলেন পুলিশকে। কিন্তু তিনি কোনদিনও ভাবেননি তার বাড়িতেও যে হামলা হতে পারে! ভারত ও আমেরিকানরা সাবধান করে দিয়েছিল, বিশেষ প্রতিনিধি বাড়িতে এসে খবর দিয়েছিল, ও সাবধান করে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বাংলার মানুষ কোন দিনও আমার ক্ষতি করবে না। পাকিস্তানী জেনারেলরা সাহস পায়নি গায়ে হাত তোলার। কিন্তু তিনি যখন দেখলেন, তার বাড়িতেও আক্রমণ করা হয়েছে, বাইরে গোলাগুলি হচ্ছে, তখন কী ভাবছিলেন বঙ্গবন্ধু? যখন দেখলেন, শেখ কামালের বুলেটবিদ্ধ শরীর থেকে রক্তের ধারা বইছে, তখন এই বাঙালীদের ওপর থেকে আস্থা কি টলে যাচ্ছিল? না কারণ, বঙ্গবন্ধু পুলিশকে বলেছিলেন, পাল্টা গুলি করা বন্ধ করো। গুলি বন্ধ হলো। খুনিরা ঢুকে গেল বাড়িতে। বঙ্গবন্ধু সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন। পরনে লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, হাতে পাইপ আর দেশলাই। ‘তোরা কী চাস?’ বঙ্গবন্ধুর এই প্রশ্নের জবাবে ওরা যখন গুলি করল, তখনও কি বাঙালীদের ওপর থেকে আস্থা হারাননি? গুলিবিদ্ধ হয়ে সিঁড়িতে পড়ে যেতে যেতে কি ভেবেছিলেন বঙ্গবন্ধু? ওরা বাংলার মানুষ, ওরা আমার কোন ক্ষতি করতে পারে না! ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকদের বুলেটের আঘাতে নশ্বর মুজিব অবিনশ্বরতার পথে চলে গেলেন চিরতরে। তাঁর জীবনাবসানে উত্থান হলো চিরন্তন মুজিবের। ইতিহাস তাকে নিয়ে গেল ধরাছোঁয়ার উর্ধে রূপকথার মহানায়কের আসনে, তাঁর যথাযোগ্য স্থানে। এই পৃথিবীর কোন ষড়যন্ত্র আর কোনদিন তাঁকে স্পর্শ করতে পারবে না। (সমাপ্ত) লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×