ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

প্রকৃতপক্ষে এই শহিদুল আলম কে?

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ১৮ আগস্ট ২০১৮

প্রকৃতপক্ষে এই শহিদুল আলম কে?

বেশ ক’বছর আগে বাংলাদেশে এক সম্পাদকের আবির্ভাব হয়েছিল, পেশায় হাতেখড়ি হবার আগেই সম্পাদক হয়েছিলেন। তারপর যা হবার হয়েছে। সম্পাদক প্রতিষ্ঠানটির বারোটা বেজেছিল। সেই সম্পাদকের নাম ছিল মাহমুদুর রহমান। তার প্রধান গুণ ছিল তিনি চরম আওয়ামী লীগ, সরকার, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাবিরোধী। শুধু বিরোধী বললে ভুল হবে, তার কথাবার্তা, মুখের ভাষা পড়তে পারলে বুঝা যাবে তিনি কতখানি প্রতিহিংসাপরায়ণ এবং পারলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, স্বাধীন বাংলার পতাকা সবকিছু খেয়ে ফেলতেন। গণজাগরণ মঞ্চে তরুণদের কণ্ঠে মুক্তিযুদ্ধের মূল রণধ্বনি ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ এই দুটি স্লোগান ছিল তার কাছে বিষের মতো। স্লোগান দুটি তাকে শুনতে হয়, হজম করতে হয়। কিভাবে মোকাবিলা করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। ক্ষেপে গিয়ে গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধেই নেমে গেলেন, যা তা বললেন। অবশ্য আরেকজন খালেদা জিয়া তো আরেক ধাপ এগিয়ে বললেন- গভীর রাতে ছেলেমেয়েরা ওখানে থেকে কী করে? ইঙ্গিতটা ছিল খুব খারাপ এবং অসম্মানের। আমরা অবাক হয়েছি, কিন্তু করার কিছু ছিল না। করবইবা কিভাবে, এটি যার যার রুচি ও মননের ব্যাপার। দ্বিতীয়ত. এই মাহমুদুর রহমান তার সম্পাদিত পত্রিকা ‘আমার দেশ’-এ একটি ছবি ছেপেছেন। ছবিটি হলো পবিত্র কা’বা শরীফের গিলাপটি পরিবর্তন করছেন কয়েকজন খতিব। তখন কুখ্যাত রাজাকার যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচার চলছিল। এই কুখ্যাত নারী ধর্ষক লোকটি মাহমুদুর রহমানের এতই প্রিয় যে, তিনি এই ছবির ক্যাপশন দিলেন-“কা’বা শরীফের খতিবগণ সাঈদীর মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন করছেন।” নাউজুবিল্লা। এমন মিথ্যা এবং পবিত্র কা’বা শরীফের মর্যাদাহানিকর এমন মিথ্যা বলতে তার বাধল না। একইভাবে আরেকটি ছবি ছেপেছেন, যাতে দেখা যাচ্ছে চাঁদের মাঝখানে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মুখ। এর ক্যাপশন দিলেন এমন যে, এই মানুষ যাকে চাঁদে দেখা যায় তাকেই বর্তমান সরকার হত্যা করছে। এরপর দেখা গেল বগুড়ার একটি এলাকায় রীতিমতো দাঙ্গা লেগে গেছে। বগুড়া, যেটিকে ধরা হয় জিয়া এবং তার বিএনপির ঘাঁটি, দেখা গেল তারই একটি গ্রাম থেকে কিছু মানুষ দা, চাপাতি, সড়কি ইত্যাদি নিয়ে থানা আক্রমণ করছে। এ ঘটনাগুলো লেখার পেছনে মাহমুদুর রহমান বা তার দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার গুণকীর্তন গাওয়া নয়। লেখার উদ্দেশ্য হলো- একটি সংবাদপত্র বা মিডিয়ার একজন গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের মানুষ ভুল করলে কত বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। ইচ্ছাকৃতভাবে উস্কানি দিলে বা সচেতনভাবে ঐ ধরনের নিউজ বা ছবি ছাপলে মোটেই অস্বীকার করা যাবে না যে, একটি জঘন্য দাঙ্গা লাগানোর উদ্দেশ্যেই তিনি এমনটি করেছিলেন। আমি তাই মনে করি। নইলে সুস্থ মস্তিষ্কের কোন লোক এমনটি করতে পারে না। সম্প্রতি শুনলাম এক মিডিয়া ব্যক্তিত্বের নাম। তিনি শহিদুল আলম। দৃক গ্যালারি বা তার ফটোগ্রাফির পাঠশালা বলে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেখানে তিনি অর্থের বিনিময়ে ক্যামেরা চালনা বা ছবি তোলা, ছবি ডেভেলপ করা শেখাতেন। তাতে কি রকম আয় হতো জানি না। শুনেছি তিনি নিউজ ফটোগ্রাফি করতেন। কারও কারও মতে ছবি বিক্রি করেও অর্থ কামাতেন। সরকার সম্প্রতি তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠিয়েছেন। কেন কী কারণে সম্ভবত সে সবের অনুসন্ধান চলছে। তবে মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রচারিত একটি টিভি চ্যানেল আল জাজিরায় তিনি একটি ইন্টারভিউ দিয়েছেন, যার একটি বাংলা অনুবাদ আমার হাতে এসেছে। ইন্টারভিউতে তিনি সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলন বা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের ওপর মন্তব্য করেছেন। অবশ্য একে মন্তব্য না বলে বলা উচিত আন্দোলনকারীদের সমর্থনে সরকারবিরোধী অনেক কথা বলেছেন। এমনকি সময়ের সারথী বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে সফল, সবচেয়ে সম্মানিত রাষ্ট্রনেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও পরোক্ষভাবে আক্রমণ করেছেন। তিনি সরকারের নীতি কার্যক্রমের সমালোচনা করতেই পারেন। সেই সমালোচনা যদি হয় উস্কানিমূলক তাহলে তা জার্নালিস্টিক ইন্টারভিউ বলা যাবে না। বরং বলা যায় তিনিও মাহমুদুর রহমানের মতো ‘দাঙ্গা’ লাগানোর উদ্দেশ্যে স্বপ্রণোদিত হয়ে অথবা কারও উস্কানিতে এমন কাজটি করেছেন। সামনে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকার বাংলাদেশকে আজ যে উচ্চতায় তুলে এনেছেন এবং সদর্পে এগিয়ে চলেছেন তাতে শেখ হাসিনার বাইরে অপর কারও ক্ষমতায় আসা বা নির্বাচিত হবার কোন সম্ভাবনা নেই। প্রতিদ্বন্দ্বী যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী রয়েছেন তিনিও কোনভাবেই শেখ হাসিনার তুল্য নন। বরং তিনি দুর্নীতির অভিযোগে কারাগারে শাস্তি ভোগ করছেন। তাও আবার বিদেশ থেকে প্রাপ্ত জিয়া অরফানেজের, অর্থাৎ এতিমের নামে আসা টাকা আত্মসাতের অভিযোগে। যে অভিযোগটি বলা যায় খুব বড় ধরনের। এতিমের টাকা কেউ মেরে খাবে এটা কোন বিবেকবান মানুষই সহ্য করবে না। অবশ্য বিএনপির লোকেরা বলে এটি ‘রাজনৈতিক’। আবার কেউ এও বলার চেষ্টা করছেন যে, তাতে কী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও দীর্ঘদিন কারাভোগ করেছেন। এসব শুনে হাসি পাবে না তা কী হয়। কোথায় কার সঙ্গে কার তুলনা। হিমালয়ের সঙ্গে ঘরের পাশের উইপোকার ঢিবির তুলনা। বঙ্গবন্ধু বাঙালী জাতির স্বাধীনতার কথা বলে, আপন জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বারবার জেলে গেছেন, ১৩ বছর জেল খেটেছেন, চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন করেই ঘরে ফিরেছেন। বারবার তাঁকে ফাঁসিতে হত্যারও ষড়যন্ত্র হয়েছে কিন্তু তিনি বাঙালী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে এতটুকু আপোস করেননি। ছিলেন এক শ’ ভাগ বাঙালী ও এক শ’ ভাগ খাঁটি মুসলমান এবং সবার ওপরে মানুষ। তার সঙ্গে অন্য কারও কারাভোগ বা দন্ড মাথায় নিয়ে বিদেশে পলাতক সন্তানের তুলনা কেবল হাসির নয়, ধৃষ্টতাও বটে। আল জাজিরার পক্ষ থেকে শহিদুল আলমকে প্রশ্ন করা হয়েছিল- ‘কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ছাড়াই ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলন কতখানি এগুতে পারবে? দেখা যাচ্ছে এই আন্দোলন দেশব্যাপী ডীপরুটে শেকড় গেড়েছে, যা সরকারের জন্যে চ্যালেঞ্জও বটে।’ শহিদুল আলমের জবাব ছিল- ‘সরকার ভেবেছিল ভয় দেখিয়ে দমিয়ে রাখলেই চলবে, যা সম্ভব না। সামনে নির্বাচন আসছে। নির্বাচন যত কাছে আসবে সরকার তত বেপরোয়া আচরণ করবে, কারণ তারা জানে সুষ্ঠু মুক্ত নির্বাচনে তারা হারবে: ‘তাদের পালাবার পথ থাকবে না’ ‘কারণ তারা (সরকার) এতকাল ধরে ডার্টি নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। নির্বাচনে হারলে সবাই তাদের ‘ছিঁড়ে খুঁড়ে’ (?) ফেলবে। সে কারণেই তাদের টিকে থাকতে হবে। তারা সেটাই করছে ....’ অথচ শহিদুল আলম তার ইন্টারভিউতে কোটা আন্দোলনের সময় ভিসি প্রফেসর ড. আখতারুজ্জামানের (সরকারী) বাসভবন আক্রমণ ও তাদের জীবননাশের হিংস্র প্রচেষ্টার কথা বলেননি। ‘আমি রাজাকার গায়ে লিখে যে ছাত্রটি ঘুরেছে তার সম্পর্কেও কোন মন্তব্য করেননি। এখানে আমার প্রশ্ন হলো- শহিদুল আলমের ডার্টি বা নোংরা নেতৃত্ব কে দিচ্ছে? তার কথায় মনে হবে সরকার। কিন্তু একটু গভীরে গিয়ে চিন্তা করলে দেখা যাবে এ আর কেউ নয়- বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যার ওপর ২০টি এটেম্পট হয়েছে। মুক্ত সুষ্ঠু নির্বাচন হলে সরকার হারবে- এ ধরনের কথা তো বিএনপি-জামায়াতের। সরকারের নেতৃত্ব বা প্রধানমন্ত্রীকে ‘ছিঁড়ে খুড়ে’ ফেলবে- এ ধরনের উস্কানিমূলক ভাষার ব্যবহার কোন মিডিয়া কর্মী করতে পারেন না। তাছাড়া ‘আমি রাজাকার’ শরীরে লিখে যে ছাত্রটি ঘুরে বেড়াল শহিদুল আলমের চোখে তা ধরা পড়ল না, নাকি পড়–ক তিনি চাননি? আমার বিশ্বাস তিনি চেয়েছিলেন এমন ছাত্র আরও বেরিয়ে আসুক। কারণ আন্দোলনে কোটা সংস্কারের কথা বলা হলেও এর টার্গেট ছিল মূলত ‘মুক্তিযোদ্ধা সন্তান-৩০% কোটা।’ এ আন্দোলনে ওরা জয়লাভ করতে পারলে গোটা মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধকেই প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারত। তাহলে ঐ আন্দোলনের নেপথ্য কুশীলব কারা ছিল? যদি প্রশ্ন করি তারা স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার-আলবদর জামায়াত-শিবিরের ঘাপটিমারা সন্তান নয় কি? জানি এর কোন জবাব নেই। সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি বা ডিজিটাইজেশনের সুযোগ নিয়ে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ভুল বোঝানো হয়েছে। তারা ‘বিভ্রান্ত’ হয়েছে। তারা সরল মনেই রাস্তায় নেমেছে। যে ছাত্ররা ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে রাজপথে নামে তারা নিজেকে ‘আমি রাজাকার’ লিখে পথে নামতে পারে না। আল জাজিরার সঙ্গে শহিদুল আলমের ইন্টারভিউর কয়েকটি লাইনে সেই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী গন্ধটিই পাওয়া যাচ্ছে। দীর্ঘদিনের একটি বহুল এবং ক্র্যাডিবল পত্রিকায় রিপোর্টার হিসেবে কাজ করার সুবাদে কখনও-সখনও শহিদুল আলমকে দেখেছি ঘুরাফেরা করতে; কিন্তু কোন্ মিডিয়ার আলোকচিত্র সাংবাদিক তা কোনদিন বুঝতে পারিনি। চেহারা পোশাক-আশাক দেখে মনে হয়েছে তাকেও দেখেছি বিভিন্ন ইভেন্টে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মাঝে মিছিলের সামনে এগিয়ে ৪/৫ বছরের একটি শিশুর পুলিশকে ঢিল মারার আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদারের ছবি যা গণঅভ্যুত্থানের প্রতীকী ছবি এ যুগে কারও কাছ থেকে আশা করি না। ঐ থিমের একটি অতি সাধারণ ছবিও কি শহিদুল আলম কোথাও ছাপাতে পেরেছেন? অন্তত আমার চোখে পড়েনি। যদি বলি প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তার নেতৃত্বকে জনগণের মাঝে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন এবং জনপ্রিয়তার দিক থেকে তার ধারে-কাছেও কেউ নেই এবং কোন নির্বাচন বা অভ্যুত্থানে তাকে ক্ষমতা থেকে সরানো যাবে না বলেই বিএনপি-জামায়াত শিবির এবং কিছু জনসমর্থনহীন বাম প্রতিনিয়ত যে হুংকার দিচ্ছে শহিদুল আলমরা তার সাইড লাইনের কুশীলবদের একজন। কিছু বুদ্ধিজীবী যখন তাকে মানবাধিকার মিডিয়া ব্যক্তিত্ব বানাবার চেষ্টা করেন তখন প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে- এই শহিদুল আসলে কে? ঢাকা ॥ ১৬ আগস্ট ২০১৮ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি জাতীয় প্রেসক্লাব [email protected]
×