ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

হাট ভরে যাবে আজ

কোরবানির পশু আসতে শুরু করেছে রাজধানীতে

প্রকাশিত: ০৪:৪৬, ১৮ আগস্ট ২০১৮

 কোরবানির পশু আসতে শুরু করেছে রাজধানীতে

ওয়াজেদ হীরা ॥ মুসলমানদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব কোরবানির ঈদ। বছর ঘুরে ফিরে আসা এই ঈদের দিকে তাকিয়ে থাকে দেশের নানা জায়গার খামারিরা। শহর কিংবা গ্রামের খামারিরা বছরব্যাপী গরু-ছাগল লালন-পালন করে একটু ভাল দাম পাওয়ার স্বপ্ন বুনেন। স্বপ্ন থাকে পালিত পশুর মাধ্যমে সংসারে আরও একটু সচ্ছলতা ফেরানও। ভাল দাম পাওয়ার আশায় গ্রাম থেকে বড় শহর কিংবা রাজধানীতেও ছুটেন খামারিরা। ইতোমধ্যেই রাজধানীর বিভিন্ন হাটে আসতে শুরু করেছে নানা ধরনের পশু। বেচাকেনা জমে উঠতে আরও সময় লাগবে। তবে অধিকাংশ হাটই মোটামুটি পশুতে সরগরম হয়ে উঠেছে। নদীপথে ট্রলারে আর সড়ক পথে ট্রাকে করে আসছে অসংখ্য গরু, আসছে ছাগলও। পশুবাহী গাড়ির সঙ্গে আছেন খামারি বা পশুর মালিক। মূলত পশু নয় খামারির স্বপ্ন আসছে রাজধানীতে। ব্যস্ত এই শহরে বড় প্রত্যাশা নিয়েই আসছেন প্রান্তিক খামারিরা। পরিবারের স্বপ্ন পূরণে স্বজনদের সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য রাজধানীবাসী যখন বাড়ি ফেরার পথ ধরেছে তখন প্রান্তিক খামারিরা নিজেদের সারাবছরের স্বপ্ন নিয়ে আসছে ঢাকায়। পশু বিক্রি করে স্বপ্ন যাবে বাড়ি। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে কাটবে আনন্দের ঈদ। সন্তানের জন্য কেনা হবে নতুন জামা, আরও কত কি! খামারির স্বপ্ন নির্ভর করছে পশুর ভাল দাম পাওয়ার ওপর। এবার ভাল দাম পেলে পরের বার আরও কিছু বেশি পশু লালন পালন করবে এমন চিন্তা নিয়ে ঢাকামুখী হাজারো খামারিরা। এদিকে, হাটগুলোতে আসা ক্রেতা-দর্শনার্থীরা কোরবানির পশুর দরদাম যাচাই করলেও এখনও বেচাবিক্রি শুরু হয়নি বলে জানিয়েছেন বিক্রেতা ও ইজারাদাররা। এবারের বাজারে অধিকাংশই দেশী গরু। আর চাহিদাও দেশী গরুর বেশি থাকবে বলে জানা গেছে। এবার রাজধানীর উত্তর সিটি কর্পোরেশনের স্থায়ী গাবতলীর হাটসহ ১০টি এবং দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ১৩টিসহ মোট ২৩টি কোরবানি পশুর হাট বসছে। রাজধানীর অস্থায়ী ও স্থায়ী হাট ঘুরে জানা যায়, সব হাটে গরু উঠেছে। আর হাটমুখো এখন গরুবাহী শত শত ট্রাক। আজ শনিবার রাজধানীর হাটগুলো কোরবানি পশুতে আরও ভরে উঠবে। আগামী সোমবার থেকে পশু বিক্রি শুরু হতে পারে বলে আশা করছেন বিক্রেতা ও ইজারাদাররা। ব্যস্ত শহর ঢাকায় প্রতিরাতেই প্রবেশ করছে পশুবাহী গাড়ি। দিনের চেয়ে রাতে এবং ভোরে পশু নামানোর দৃশ্য বেশি হাটগুলোতে। এদিকে, রাজধানীর ব্যস্ততা নিয়ে প্রান্তিক পর্যায়ের সহজ-সরল খামারিদের ধারণা খুব একটা না থাকলেও এই শহরে প্রত্যাশাটা তাদের খুব বেশি। গত বছরও রাজধানীর বিভিন্ন হাটে পশু বিক্রি করে ভালই মুনাফা পেয়েছেন। আর এবারও সেই আশা করছেন। কুষ্টিয়ার খামারি আব্দুল মোতালেব ৬টি গরু নিয়ে ঢাকায় এসেছেন বৃহস্পতিবার সকালে। স্থায়ী হাট গাবতলীতে নামিয়েছেন গরু। গত বছর ভাল দাম পাওয়ার পর এবারও স্বপ্ন বুনছেন ভাল বিক্রির। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘আমরা কৃষক মানুষ সারাবছর গরু পালি, আর চাষাবাদ করি। ভারতীয় গরু এবার খুব একটা নেই। গতবারের মতো মোটামুটি ভাল দাম পামু।’ একই বাজারে আরেক ব্যবসায়ী সহিদুল এসেছেন সিরাজগঞ্জ থেকে। তিনি গতবার বিক্রি করেছেন ৫টি গরু এবার নিয়ে এসেছেন ৯টি। তিনি বলেন, এবার দেশী গরু আছে, যারা লালন-পালন করছে আশা করছি দাম ভাল হবে। বাজার পরে না গেলে আগামীতে আরো বেশি গরু লালন-পালনের কথাও বলেন তিনি। অধিকাংশ খামারির মনে এখন নিজের পালিত পশুটির বিক্রি এবং ভাল দাম পাওয়ার আশা। গরু লালন-পালন করেই কারো কারো গোটা বছর কাটিয়ে দিতে হয়। কিন্তু ভারতীয় গরু অবাধ প্রবেশের ফলে অনেক সময় দেশীয় খামারিরা চরমভাবে মার খায়। গত বছর কোরবানিতে দেশীয় গরুর সংকট ছিল না। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক ডাঃ হীরেশ রঞ্জন ভৌমিক জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, কোরবানিতে এবারও পশুর কোন সংকট নেই। সেই সঙ্গে এখন পর্যন্ত দেশের সীমান্ত এলাকা দিয়ে খুব একটা ভারতীয় গরু প্রবেশ করেনি। দেশের খামারিরা স্বপ্ন দেখতেই পারেন। এদিকে, রাজধানীর গাবতলীসহ কয়েকটি হাটে গিয়ে দেখা গেছে গরুতে ভরপুর। আরিচাঘাট দিয়ে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চল থেকে ট্রাকে ট্রাকে আসছে গরু। রাজধানীর স্থায়ী হাটে কিছু গরু কেনাবেচাও হচ্ছে। তবে হাসিল ঘর সূত্রে জানা গেছে যে গরুগুলো বিক্রি হচ্ছে এ সব মূলত কসাইরা মাংস বিক্রির জন্য কিনছেন। শনিবারের পর মূল জমজমাট থাকবে হাট এবং রবিবার থেকে অনেকেই কোরবানির পশু কিনে ফেলবেন বলে জানায় গাবতলী স্থায়ী হাটের হসিল ঘরের দায়িত্বে থাকা সুলায়মান। শুক্রবার গাবতলীর হাটের প্রবেশপথে বিশাল আচ্ছাদনের মধ্যে দেখা গেল উৎসুক জনতার সমাগম। সবাই দাঁড়িয়ে কালো রঙের একটা গরু দেখছেন। দূর থেকে দেখে মনে হবে এটি একটি হাতি! বিশালদেহী গরুটির নাম ‘কালা মানিক’। গরুটির মালিক দুলাল ব্যাপারী ‘কালা মানিক’র দাম হাঁকাচ্ছেন ২০ লাখ টাকা। অনেকেই গরুটি দেখতে ভিড় করছেন বলেও জানান তিনি। গাবতলীর মতো অন্যান্য হাটেও গরু আসা শুরু হয়েছে। কেউ কেউ গরু পাশে রাস্তার সঙ্গে বেঁধে রেখেছেন কেউ আবার বাজারে প্রবেশ করিয়েছেন। ছুটির দিনে অনেকেই গরু দেখতে বাজারে গিয়েছেন। অনেক বাজারে প্রস্তুতি শেষ হয়েছে কোন কোন বাজারে শেষ পর্যায়ে। ইজারাদার আর খামারি উভয় এখন বিক্রি শুরুর অপেক্ষায়। মোহাম্মদপুরের বছিলায় পুলিশের পরিত্যক্ত জায়গায় কোরবানির পশুর হাটে পশু রাখার শেডগুলো অর্ধেকের বেশি ভরে গেছে। আরও আসছে কোরবানির পশু। এই হাটে কোরবানির পশু দেখছিলেন এলাকার বাসিন্দা সোরহাব। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, দরদাম দেখতে এসেছেন, তবে কোরবানির গরু কিনবেন ঈদের দু’একদিন আগে। প্রায় একই ধরনের কথা বললেন বছিলার বাসিন্দা মুরাদ হোসেন। প্রায় প্রতিটি হাটের চিত্র একই। ক্রেতারা যারা আসছেন তারা কিনতে নয় বরং দেখতেই আসছেন বেশি। রামপুরা খালের পার্শ্ববর্তী আফতাব নগর হাটে গিয়ে দেখা যায় সেখানে গরু-ছাগল নিয়ে এসেছেন কয়েক শ’ ব্যবসায়ী। যে স্থানে গরু-ছাগল বেঁধে রেখেছেন, সেখানেই নিজেদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন এ সব ব্যবসায়ী। এ জন্য তারা পশুর খাবারের পাশাপাশি নিজেদের জন্য চাল-ডালও নিয়ে এসেছেন গ্রামের বাড়ি থেকে। রান্নার জন্য কেরোসিনের চুলা ছায়া তৈরির জন্য পলিথিনও এনেছেন সঙ্গে। ঝিনাইদহের ব্যবসায়ী গফুর বলেন, গরু দেখাশোনার জন্য সঙ্গেই থাকতে হয়। খাবার খেতে দূরে যেতে পারি না। তাই নিজেরা রান্না করি। শাহজাহানপুর রেলওয়ে মৈত্রী মাঠের হাটে গিয়ে দেখা যায়, মাঠের বাইরের রাস্তায় বেশ কয়েকটি ট্রাকে করে বিক্রির জন্য দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পশু নিয়ে এসেছেন ব্যবসায়ীরা। শাহজাহানপুর রেলওয়ে মৈত্রী মাঠে ইতোমধ্যে পশু নিয়ে আসা হয়েছে। হাটে আসা গরু ব্যবসায়ী খালেক জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ট্রাকে করে তারা ৭ জন গরু নিয়ে এসেছেন। এবার কোরবানির ঈদে তারা ৩২টি গরু এনেছেন। এর মধ্যে দুই লাখ টাকা থেকে চার লাখ টাকার গরু রয়েছে। মেরাদিয়া হাটে এরই মধ্যে গরু নিয়ে আসতে শুরু করেছেন ব্যবসায়ীরা। হাটের নির্ধারিত এলাকা ছাড়িয়ে নন্দীপাড়া বালুর মাঠেও খুঁটি লাগানো হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার থেকে পুরো মাঠে বাঁশ, খুঁটি দিয়ে তাঁবু তৈরির কাজ শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। বিদ্যুত সংযোগ দেয়ার কাজও শেষ হয়েছে। এ সব বিষয়ে জানতে চাইলে মেরাদিয়া অস্থায়ী পশুর হাটের ইজারাদার হাজী শাহ আলম বলেন, বালুর মাঠে প্রস্তুতি নেয়ায় জনসাধারণের কোন সমস্যা হবে না। এটা উন্মুক্ত জায়গা দেখে সেখানে প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীরা তো দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসেন। তাই তাদের সুবিধার্থে এটা করা হয়েছে। রহমতগঞ্জ খেলার মাঠে ইজারাকৃত অস্থায়ী পশুর হাটেও কোরবানির পশু উঠতে শুরু করেছে। বাঁশের খুঁটিসহ আনুষঙ্গিক কাজও শেষ হয়েছে ইতোমধ্যে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে হাটটির ইজারাদার শফি মাহমুদ জানিয়েছেন, খামারিরা কিছু পশু এনে রেখেছেন। এখনও কেনাবেচা শুরু হয়নি। দুয়েক দিনের মধ্যে পুরোদমে বেচাকেনা শুরু হবে। কামরাঙ্গীরচরের ইসলাম চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে বুড়িগঙ্গার পাড় পর্যন্ত হাটটির প্রস্ততিও একই অবস্থা। তবে এখনে কোন পশু ওঠেনি। হাটটির ইজারাদার আবুল হোসেন জানান, সিটি কর্পোরেশন থেকে এখনও গরু ওঠানোর অনুমতি দেয়া হয়নি। তাই অন্য প্রস্তুতির কাজগুলো শেষ করছেন তিনি। তেজগাঁও অস্থায়ী পশুর হাটে খুঁটি লাগানোসহ অন্যান্য কাজ শুরু হয় সপ্তাহখানেক আগে থেকেই। শুধু এই হাটই নয়, রাজধানীতে প্রায় সব জায়গাতেই নির্ধারিত সময়ের আগেই অস্থায়ী পশুর হাট বসানোর প্রস্তুতি শেষ হয়ে গেছে। ব্রাদার্স ইউনিয়ন সংলগ্ন বালুর মাঠ ও কমলাপুর স্টেডিয়ামের আশপাশের খালি জায়গায় পশুর হাট বসানোর প্রস্তুতি শেষ। হাটের প্রধান দুই প্রবেশ গেটে দুটি বড় তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে। জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা আবদুল মালেক বলেন, চূড়ান্ত হওয়া হাটগুলোতে ঈদের দিনসহ চার দিনের জন্য হাট বসানোর অনুমোদন দেয়া হয়। তবে এর আগে প্রস্তুতির সময়ও পান। এ সময় কোন গরুর গাড়ি এলেও যেন জনগণের ভোগান্তি না হয়। এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা আমিনুল ইসলামের কণ্ঠেও একই রকম কথা। তাঁর মতে, হাটের অনুমোদিত সময়ের আগে গরু আসে তবে বিক্রি খুব একটা হয় না এ সময় জনদুর্ভোগ যেন না হয়, সেদিকে আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশনা দিয়েছি, ইজারাদারদের বলেন তিনি।
×