ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এনামুল হক

এইচআইভি নিরাময়ের উজ্জ্বল সম্ভাবনা

প্রকাশিত: ০৬:২৮, ১৭ আগস্ট ২০১৮

এইচআইভি নিরাময়ের উজ্জ্বল সম্ভাবনা

এইডস রোগের ক্ষেত্রে নিরাময় শব্দটা সাধারণত ব্যবহৃত হয় না। তার কারণ এই রোগের জন্য দায়ী যে ভাইরাস সেই এইচআইভি প্রথম শনাক্ত হওয়ার পর ৩৫ বছরের বেশিরভাগ সময় ডাক্তাররা এ রোগের নিরাময়কে যত না বাস্তব তার চেয়ে বেশি কাল্পনিক বলে গণ্য করেছেন। এখন কিছু কিছু বিশেষজ্ঞ আগামী প্রজন্মের এইচআইভি চিকিৎসা উদ্ভাবনের চেষ্টা করতে গিয়ে রোগটি নিরাময় করার লক্ষ্যে কাজ করতে শুরু করেছেন। এইচআইভি ভাইরাস অন্য আর দশটি ভাইরাসের মতো নয়। শরীরের যে ইমিউন কোষগুলোর এই ভাইরাসকে ধ্বংস করার কথা সেই কোষগুলোকেই এটি নিষ্ক্রিয় বা অথর্ব করে ফেলে নিজেকে দেহকোষের ভেতরে স্বতন্ত্র জায়গা বের করে লুকিয়ে রাখে। কয়েক মাস এমনকি কয়েক বছর পর রোগটি বেকায়দা চেহারা ধারণ করলে দেহের ইমিউন ব্যবস্থার প্রতিরক্ষা বাহিনী যখন ভাইরাসকে খুঁজে বের করে আক্রমণ করতে নামে তখন ভাইরাসগুলো গুপ্তস্থান থেকে বেরিয়ে এসে মারাত্মক চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালায়। এইচআইভি মহামারীতে সারাবিশ্বে যেখানে আজ প্রায় পৌনে চার কোটি লোক আক্রান্ত সেখানে এখন প্রথমবারের মতো কিছু বিশেষজ্ঞ এটাকে নিরাময় করার উদ্যোগ নিয়েছেন। তারা জানতে পেরেছেন কিভাবে এইচআইভি দেহকোষের মধ্যে নিজেকে আত্মগোপন করে রাখে এবং ইমিউন ব্যবস্থার সতর্ক দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে চলে। এগুলোকে কিভাবে উন্মোচন করতে ও ধ্বংস করতে হয় তার কিছু কিছু ধারণাও তারা লাভ করেছেন। আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ (এনআইএইচ) এই নতুন জ্ঞানের ভিত্তিতে এইচআইভি নিরাময়ের উদ্যোগে অর্থায়ন করছে। এএমএফএআর নামে একটি সংস্থা এই চিকিৎসায় শুধু অর্থায়নই করছে না, রোগটিকে সম্পূর্ণ নিরাময় করার উপায়ও খুঁজছে। সংস্থাটির এক কর্মকর্তা বলেন, এইচআইভি অবশ্যই নিরাময় করা সম্ভব। প্রশ্ন হচ্ছে কিভাবে। এইচআইভিতে যারা আক্রান্ত তাদের শরীরে এই ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ডাক্তারদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না একটি ওষুধের বদৌলতে। সেটি হলো এন্টিরেট্রোভাইরাল বা এআরভি। ওষুধটি এই ভাইরাসে সুস্থ দেহকোষের মধ্যে ঢোকার পর প্রতিরূপ সৃষ্টি বা সংখ্যা বৃদ্ধির কাজটি ঠেকিয়ে দেয়। ভাইরাস যদি নিজের প্রতিরূপ সৃষ্টি করতে না পারে তাহলে এইচআইভি নতুন নতুন কোষকে সংক্রমিত করার জন্য ছড়িয়ে পড়তে পারে না। এর ফলে এইচআইভি পজিটিভ যাদের আছে তারা দীর্ঘদিন সুস্থ শরীরে বেঁচে থাকতে পারে। তথাপি বর্তমান ওষুধের ভিত্তিতে চিকিৎসা যত শক্তিশালীই হোক না কেন, ভাইরাসটিকে দমন করে রাখার জন্য প্রতিদিন ওষুধ খাবার দরকার হয় এবং সেই ওষুধ ইতোমধ্যে সংক্রমিত কোষগুলো থেকে দেহকে প্রকৃতপক্ষে মুক্ত করতে পারে না। আত্মসংরক্ষণের জন্য কিছু এইচআইভি নিজের প্রতিরূপ সক্রিয়ভাবে তৈরি না করে কিছু কিছু ইমিউন কোষের মধ্যে নিজেদের সুপ্ত অবস্থায় রাখে। ভাইরাসের প্রতিরূপে সৃষ্টিতে বাধা দেয়ার ব্যাপারে ওষুধ অসাধারণ কার্যকর। কিন্তু সমস্যা হলো, এক ধরনের এইচআইভি নিজেদের প্রতিরূপ সৃষ্টি না করে সুপ্ত অবস্থায় থাকে। ওষুধ সেগুলোর ওপর কাজ করতে পারে না এবং ইমিউন ব্যবস্থাও তা দেখতে পারে না। লোকে ওষুধ খাওয়া বন্ধ করলে বা ঠিকমতো না খেলে এই শ্রেণী ভাইরাসগুলো সগর্জনে ফিরে আসে। অন্তত জীবজন্তুর শরীরে সুপ্ত এই ভাইরাসগুলোকে যে সক্রিয় করে তোলা এবং তা নিশ্চিহ্ন করা যায় সম্প্রতি গবেষকরা তার এ যাবতকালের সবচেয়ে জোরালো প্রমাণ হাজির করেছেন এক ধরনের এইচআইভি সংক্রমিত কিছু বানরের ওপর গবেষণা চালিয়ে তারা দেখিয়েছেন যে ইমিউন ব্যবস্থাকে উদ্দীপ্ত করে ও সুপ্ত এইচআইভিকে সক্রিয় করে এমন একটি ওষুধ এইচআইভি সংক্রমিত কোষগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে সক্ষম একটি শক্তিশালী এন্টিবডির সঙ্গে যুক্ত করে প্রয়োগ করার পর দেখা গেছে যে, এআরভি গ্রহণ বন্ধ করে দেয়ার ছয় মাস পর ১১টি বানরের মধ্যে ৫টির ক্ষেত্রে এইচআইভির পুনরাগমন ঘটেনি। আর যেগুলোর বেলায় এইচআইভির প্রত্যাগমন ঘটেছে সেগুলোর শরীরে ভাইরাসের মাত্রা ছিল একেবারেই চিকিৎসা না পাওয়া বানরগুলোর তুলনায় ১০০ গুণ কম। এ থেকে এমন সম্ভাবনাই উজ্জ্বল হয়ে দেখা দিয়েছে এই রোগ নিরাময় করার মতো ব্যবস্থা আছে যে ব্যবস্থার এমন কার্যকারিতা আগে কখনও দেখা যায়নি। এইচআইভি দমনের ওষুধ এআরভি বন্ধ করে দেয়ার সাধারণত দু-সপ্তাহের মধ্যে এই রোগ ফিরে আসে। কিন্তু প্রায় অর্ধেক সংখ্যক বানরের ক্ষেত্রে যাদের নতুন ওষুধটি দেয়া হয়েছে তাদের বেলায় এইচআইভির কোন লক্ষণ ফুটে না ওঠা থেকে প্রমাণ হয় যে নতুন ওষুধটিতে কাজ হচ্ছে। এটি সুপ্ত ভাইরাসগুলোর প্রহেলিকাময় ভা-ার সার্থকভাবে টার্গেট করে সেগুলোকে ধ্বংস করে দিতে পারছে। এইচআইভি চিকিৎসার পরবর্তী ধাপের দিকে এটা এক সম্ভাবনাময় অগ্রগতি। এই চিকিৎসায় এমন ভাইরাস যার শরীরে আছে সে এ থেকে যুক্তই শুধু হবে না, উপরন্তু এমন রোগীদের সারাজীবন এআরভি ওষুধের ওপর আর নির্ভরও করতে হবে না। নতুন পদ্ধতিটা এখনও পর্যন্ত মানবদেহে পরীক্ষা করে দেখা হয়নি এবং সম্পূর্ণ নিরাময়ের কৌশলটি বের হতে আরও বেশ কয়েক বছর লাগতে পারে। তবে আশার আলো যে দেখা দিয়েছে সেটাই বড় কথা। মহামারীর ইতিহাসে এক ব্যক্তি এইচআইভি থেকে নিরাময় লাভ করেছে বলে ধারণা করা হয়। তাঁর নাম টিমোথি ব্রাউন। এই আমেরিকান ভদ্রলোকের বর্তমান বয়স ৫২। ১৯৯৫ সালে বার্লিনে অধ্যয়নকালে তার এইচআইভি ধরা পড়ে। কয়েক ধরনের এআরভি ওষুধ খেয়ে তিনি প্রায় ১০ বছর ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন। কিন্তু এরপর তিনি এক ভয়ঙ্কর রোগে আক্রান্ত হন যার নাম লিউকেমিয়া। ডাক্তারদের ধারণা এর সঙ্গে তাঁর এইচআইভির কোন সম্পর্ক ছিল না। ক্যান্সারের চিকিৎসায় তাঁকে কেমো দেয়া হয়। দুবার বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হয় যাতে করে রক্তে ক্যান্সার দুষ্ট কোষ সরিয়ে দিয়ে সূক্ষ্ম কোষ আনা যায়। ব্রাউনের এইচআইভির কথা জানা থাকায় ডাক্তাররা এক ডোনার জোগার করেছিলেন যার রক্ত কোষে এমন মিউটেশন ছিল যে এইচআইভির পক্ষে নতুন প্রতিস্থাপিত কোষগুলো সংক্রমিত করা ছিল অসম্ভব। বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন গ্রহণের সময় থেকে ব্রাউন এআরভি গ্রহণ করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এক দশকেরও বেশি সময় পর তার কোন পরীক্ষাতেই সক্রিয় এইচআইভির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তিনি বয়ে গেছেন একমাত্র এইচআইভি-পজিটিভ ব্যক্তি যার এআরভি ওষুধ সেবন ছাড়াই শরীরে এই ভাইরাস আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। তারপর থেকে অন্যান্য ব্যক্তির বেলায় ব্রাউনের দৃষ্টান্ত অনুকরণ করা হলেও তাতে অবশ্য কাজ হয়নি। প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই এইচআইভি শেষ পর্যন্ত ফিরে এসেছিল। ব্রাউনের কেস থেকেই বুঝা যায় যে, এইচআইভি নিরাময় করা সম্ভব। তবে তার জন্য শরীরের ভিতর লুকিয়ে থাকা কার্যত প্রতিটি এইচআইভি কোষ বের করে দেয়ার প্রয়োজন হতে পারে। শূন্য ভাইরাসের যতটা সম্ভব কাছাকাছি অর্জন করা দরকার। প্রত্যেক রোগীর এইচআইভির শেষ অবশেষটুকু যদি দূর করা সম্ভব নাও হয় সেক্ষেত্রে তার বা তাদের ইমিউন ব্যবস্থা এমনভাবে পুনর্গঠন করা যেতে পারে যে সেটা ভাইরাসের যা কিছু অবশিষ্ট আছে সেগুলো সাফল্যের সঙ্গে নিশ্চিহ্ন করে দেবে। ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা এ ধরনের কৌশল অর্থাৎ ইমিউন ব্যবস্থা দিয়ে ক্যান্সার দুষ্ট কোষ আক্রমণের কৌশল কাছে লাগাচ্ছেন। এইচআইভি নিরাময়েও এই কৌশল কাজে দেবে বলে বিশেষজ্ঞরা যথেষ্ট আশাবাদী। আরেকটা কৌশলও পরীক্ষা করে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তাহলো যেসব কোষের মধ্যে এইচআইভি সুপ্ত অবস্থায় আছে সেগুলোর মধ্যে ওগুলোকে স্থায়ীভাবে আটকে ফেলা যাতে ওগুলো আর কখনই সক্রিয় হতে না পারে। তারা জিন কৌশল প্রয়োগের কথাও ভাবছেন যার দ্বারা সংক্রমিত কোষ থেকে এইচআইভিকে একেবারে বাদ দেয়া হবে। আগামী বছরই যে এইচআইভি সম্পূর্ণ পরাভূত করা যাবে এই আশা কেউ করছেন না। তবে ভবিষ্যতে কোন না কোন ধরনের নিরাময় যে এইচআইভি চিকিৎসার অংশ হবে সে ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের আস্থা ক্রমশ বাড়ছে। সূত্র : টাইম
×