ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘গুলজার’-এর উত্তরসূরি মেঘনা গুলজার

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ১৬ আগস্ট ২০১৮

‘গুলজার’-এর উত্তরসূরি মেঘনা গুলজার

সব কিছু দিতে রাজি হলেই কি সবটা দেয়া যায়? কিছু পিছুটান কি পড়ে থাকে না? এই দ্বন্দ্বই ফুটে উঠেছে মেঘনা গুলজারের ‘রাজি’তে। সত্যি ঘটনা অবলম্বনে ‘কলিং সেহমত’ লিখেছিলেন হরিন্দর সিক্কা। মেঘনা তাকে নিজের মতো করে পর্দায় তুলে ধরেছেন। তার সঙ্গে চিত্রনাট্য লিখেছেন ভবানি আইয়ার। দেশের জন্য প্রাণ দিতে হবে। প্রাণ নিতেও হবে। অথচ কেউ জানতে পারবে না। এমন সৈনিক তুমি যে শহিদ তো হবে, কিন্তু মৃত্যুর পর সম্মান ও জুটবে না। এমন জীবনকেই বেছে নিতে ‘রাজি’ হয়েছিল সেহমত। কেন? দেশের জন্য। বাবার জন্য। তার ফেলে যাওয়া কাজের দায়িত্ব নিজের নরম কাঁধেই নিয়েছিল সে। নিজেকে তৈরি করেছিল সমস্ত পরিস্থিতির জন্য। তাকে শেখানো হয়েছিল সমস্ত কিছু। শিখেছে সে। দায়িত্ব পালনও করেছে। দেশকে সবার আগে রেখেছে। কিন্তু ভেতরের মানুষটাকে আস্তে আস্তে হারিয়েছে। কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে এসেছে বটে কিন্তু ফেলে আসা বাঁধন আর ছিড়তে পারেনি। গ্লানির আগুনে সারাজীবন পুড়েছে। দেশ, জাতি, উন্নত, অনুন্নত, অধিকার, লড়াই- এ সবের বাইরেও একটা জীবন বলে বস্তু রয়েছে। সেটাই তুলে ধরেছেন পরিচালক মেঘনা গুলজার। ছবির গল্পটি কাশ্মীরের পটভূমিতে ১৯৭১ সালের ভারত-পাক যুদ্ধকে নিয়ে রচিত। মূলত এই কাহিনী অনুপ্রাণিত হয়েছে হরিন্দর সিক্কার উপন্যাস ‘কলিং সেহমত’ থেকে। যে গল্প ’৭১ সালের যুদ্ধের সময় এক মহিলা গুপ্তচরকে নিয়ে লেখা হয়। কী ছিল সেই মহিলা গুপ্তচরের কাহিনী, কোন তথ্যই বা তিনি দেশকে পাঠিয়েছিলেন সীমান্তের ওপার পাকিস্তান থেকে? ‘কলিং সেহমত’ উপন্যাসের লেখক হরিন্দর সিক্কা প্রাক্তন নৌসেনা অফিসার ছিলেন। তিনি কার্গিল যুদ্ধের সময় প্রাথমিকভাবে ভারতীয় গোয়েন্দা বিভাগ তথা সেনার ব্যর্থতা নিয়ে অসন্তুষ্ট হয়ে গবেষণা সংক্রান্ত কাজে কার্গিল পৌঁছান। সেখানে তিনি এক সেনা অফিসারের কাছ থেকে জানতে পারেন বহুকাল আগে ১৯৭১ সালের যুদ্ধে ভারত থেকে এক মহিলা গুপ্তচরকে পাঠানো হয়েছিল। যিনি সম্পর্কে ওই সেনা অফিসারের মা । খোঁজ শুরু হয় সেই মহিলার! খোঁজ শুরু হয় সেই মহিলার! ঘটনার কথা জানতে পেরেই হরিন্দর সিক্কা খোঁজ করতে থাকেন সেই সেনা অফিসারের মায়ের। যাকে নিয়েই লেখা ‘কলিং সেহমত’ উপন্যাসটি। যদিও ওই মহিলা গুপ্তচরের আসল নাম উপন্যাসে লেখা হয়নি। জানতেও দেয়া হয়নি সেই মহিলার আসল পরিচয়। আর সেই সেহমতকে নিয়েই লেখা হয় তার জীবনের গায়ে কাঁটা দেয়া আসল কাহিনী। পাকিস্তানে সেহমতে প্রবেশ গল্পে সিক্কা জানান, কিভাবে পাকিস্তানে সেহমতে পাঠানো হয়েছিল। জানা যায়, ১৯৭১ সালে সেহমতের সঙ্গে বিয়ে দেয়া হয় পাকিস্তানের এক সেনা অফিসারের। কাশ্মীরী মুসলিম পরিবারের মেয়ে সেহমতের বাবা ছিলেন উপত্যকার এক নামী ব্যবসায়ী। আর তিনিই সেহমতকে সীমান্তের ওপারে পাঠাতে রাজি হন। ‘রাজি’ হয়ে যায় সেহমতও! সেহমত পাকিস্তানে গিয়ে ক্রমাগত ভারতীয় গোয়েন্দাদের কাছে সীমান্তের ওপার থেকে খবর পাঠাতে থাকতেন। পাক সেনা অফিসারের স্ত্রী হওয়ার কারণে তার কাছে সমস্ত তথ্য আসা সম্ভব ছিল। আর এরই মধ্যে একটি তথ্য ছিল দেশের গর্ব ভারতীয় নৌ সেনার জাহাজ আইএনএস বিরাটকে নিয়ে। সেহমত জানান, আইএনএস বিরাটকে পাকিস্তান ডুবিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র করেছে। যা দেশের সুরক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ছিল। সেনা অফিসারের স্ত্রী হিসেবে পাকিস্তানের সেনা জেনারেল ইয়াহা খানের নাতি-নাতনিদের পড়াতে যেত সেহমত। আর পাশাপাশি চালাতেন তার গুপ্তচরবৃত্তির কাজ। দুই চরিত্রের সম্পর্কের এহেন দ্বন্দ্বকেই ছবির গল্পের প্রাণভোমরা হিসেবে ব্যবহার করেছেন পরিচালক মেঘনা গুলজার। শঙ্কর-এহসান-লয়ের সুরে ফিরে ফিরে আসে সত্তর দশকের প্রেক্ষিত। জাতীয়তাবাদ নয়, গীতিকার গুলজার ছবির গানের কথায় গুরুত্ব দিয়েছেন নিখাদ দেশপ্রেমকে। সুব্রত চক্রবর্তী ও অমিত রায়ের প্রোডাকশন ডিজাইন, এবং ম্যাক্সিমা বসু গোলানির অপূর্ব কস্টিউম ডিজাইন ছবির বিশ্বাসযোগ্যতা ধরে রাখতে সফল। তবে চিত্রনাট্যের গুণে কখনও-সখনও দর্শকের নজর সেসব খুঁটিনাটি থেকে সরে যায়। ছবির মূল সম্পদ অবশ্যই আলিয়া ভাটের অসাধারণ কাজ। এক সাক্ষাতকারে আলিয়া বলেছিলেন, তার ও মেঘনার চরিত্রে অদ্ভুত মিল রয়েছে। সে কারণেই বোধহয় সেহমত হয়ে উঠেছেন তিনি। আর মেয়ের ছবির জন্য বহুদিন বাদে কলম ধরেছেন গুলজার। প্রত্যেকটি গান যেন লেখকের জাদুকাঠির ছোঁয়ায় নতুন করে প্রাণ পেয়েছে। শংকর-এহসান-লয় সুবিচার করেছেন গুলজারের শব্দের। মেয়ে মেঘনা গুলজার বাবার যাথাযথ নাম রক্ষা করতে পেরেছে। তার নির্মিত সিনেমা ‘রাজি’ অর্থ আয়ের দিক থেকেও ব্যাপকভাবে সফল হয়েছে।
×