ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

হৃদয়রাজ্যে নায়করাজ

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ১৬ আগস্ট ২০১৮

হৃদয়রাজ্যে নায়করাজ

আজীবন চিন্তা করেছেন বাংলা চলচ্চিত্রের বর্তমান ও ভবিষ্যত নিয়ে। ২১ আগস্ট, ২০১৭ পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেছেন, রাজ্জাক বেঁচে আছেন, থাকবেন বাঙালীর হৃদয়রাজ্যের রাজা হয়ে পপি দেবী থাপা ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের মুকুটবিহীন সম্রাট। অভিনয় দক্ষতা আর বিশাল জনপ্রিয়তার কারণে তিনি ছিলেন রুপালি পর্দার রাজাÑ নায়করাজ রাজ্জাক। নায়করাজ উপাধিটি দিয়েছিলেন বাংলা চলচ্চিত্র পত্রিকা ‘চিত্রালী’র সম্পাদক আহমদ জামান চৌধুরী। তার ভুবন ভোলানো হাসি, রোমান্টিক ম্যানারিজম, নিষ্পাপ দৃষ্টি বাংলা চলচ্চিত্রের তিন প্রজন্মের দর্শককে মাতিয়ে রেখেছে। হাতের মুঠোয় ধরে রেখেছেন কোটি দর্শকের হৃদয়। জন্ম ২৩ জানুয়ারি ১৯৪২, দক্ষিণ কলকাতার নাকতলায়। শৈশবেই বাবা আকবর হোসেন এবং মা নিসারুননেসাকে হারান। তিন ভাই, তিন বোনের সংসারে বেশি সাপোর্ট পেয়েছেন তাঁর মেজ ভাই আবদুল গফুরের। ইচ্ছা ছিল ফুটবলার হওয়ার, ভাল গোল রক্ষক ছিলেন। রীতিমতো হায়ার করে নিয়ে যাওয়া হতো তাকে। তার পড়াতেই থাকতেন ছবি বিশ্বাস, আবৃত্তি শেখাতেন শিশু কিশোরদের। সে দলে ছিলেন রাজ্জাকও। কলকাতার খানপুর হাই স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় শিশু-কিশোরদের নিয়ে লেখা নাটক ‘বিদ্রোহীতে’ গ্রামীণ কিশোর চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়েই নায়করাজের অভিনয়ে যাত্রা শুরু। পাড়ার শক্তিসংঘ ক্লাবে ‘ইহুদি’ নাটকে অভিনয় করলেন। এরপর তরুণতীর্থ সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীতে। ছবি বিশ্বাস ছিলেন এই ক্লাবের সভাপতি। সেখানে নাট্য পরিচালক ছিলেন পীযুষ বোস। রাজ্জাক অভিনয়ে গুরু মানেন পীযুষ বোসকে, নায়ক হিসাবে তার আইডল ছিলেন উত্তম কুমার। ১৯৬২ সালে খায়রুন্নেসা লক্ষ্মীকে বিয়ে করেন তিনি। ১৯৬৪’র দাঙ্গার পর ভাবলেন বোম্বে চলে যাবেন। ফেরালেন পীযুষ বোস, বললেন ‘ক্যারিয়ার গড়তে হলে পূর্ব পাকিস্তানে যাও।’ ১৯৬৪ সালের ২৬ এপ্রিল স্ত্রী লক্ষ্মী এবং শিশুপুত্র বাপ্পাকে নিয়ে শরণার্থী হয়ে তৎকালীন পূর্ব পকিস্তানে আসেন। সঙ্গে পীযুষ বোসের দেয়া একটি চিঠি ও পরিচালক আবদুল জব্বার খান ও শব্দগ্রাহক মনি বোসের ঠিকানা। ঢাকার কমলাপুরে ৮০ টাকা ভাড়ায় একটি বাসায় উঠেছিলেন। আবদুল জব্বার তাকে ইকবাল ফিল্মসে কাজ করার সুযোগ দেন। ১৯৬৪ সালে ‘উজান’ চলচ্চিত্রে কামাল আহমদের সঙ্গে সহকারী পরিচালক হিসেবে প্রথম কাজ করেন। তখনও সংগ্রামের জীবন। তৎকালীন পাকিস্তান টেলিভিশনে ‘ঘরোয়া’ নামক ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করে দর্শকদের কাছে জনপ্রিয় হন। নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে তিনি আবদুল জব্বার খানের সঙ্গে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান। সালাউদ্দিন প্রোডাকসন্সের তের নম্বর ফেকু ওস্তাগড় লেন চলচ্চিত্রে ছোট একটি চরিত্রে অভিনয় করে সবার কাছে নিজ মেধার পরিচয় দেন রাজ্জাক। পরবর্তীতে কার বউ, ডাক বাবু, আখেরি স্টেশনসহ আরও বেশ কিছু ছবিতে ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। পাকিস্তান টেলিভিশনের খবর পাঠক হিসেবে ইন্টারভিউ দিয়ে টিকে গিয়েছিলেন। কিন্তু অভিনেত্রী রেশমার স্বামী জামান আলী খান তাকে অভিনয়ের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে বলেন। সে সময় জহির রায়হান শুরু করেন লোক কাহিনী নিয়ে বেহুলা ছবির নির্মাণ কাজ। জহির রায়হান রাজ্জাককে তাঁর ছবির নায়ক লখিন্দর হিসেবে নিলেন। তার বিপরীতে নায়িকার ভূমিকায় ছিলেন কোহিনুর আক্তার সুচন্দা। ১৯৬৬তে মুক্তি পেয়ে ছবিটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। বেহুলা ছবিটি করে পেয়েছিলেন পাঁচ হাজার টাকা। সেই থেকে বড় পর্দায় নায়ক হিসেবে তাঁর পথ চলা শুরু। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ঢাকার সিনেমা হলগুলোতে তখন পাকিস্তান, ভারতীয় ছবির দাপট, সেখানকার বড় শিল্পীরা তখন দর্শক মাতিয়ে আছেন। এদের ছবির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে শুরু করল ঢাকার নির্মাতাদের ছবি। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এখানে নির্মিত বেশির ভাগ ছবির নায়ক ছিলেন রাজ্জাক। দুই ভাই, আবির্ভাব, বাঁশরি, এতটুকু আশা, নীল আকাশের নিচে, যে আগুনে পুড়ি, পায়েল, দর্পচূর্ণ, যোগ বিয়োগ, ছদ্দবেশী, জীবন থেকে নেয়া, মধুর মিলন ইত্যাদি ছবির সাফল্যে রাজ্জাক হয়ে ওঠেন চলচ্চিত্রের অপরিহার্য নায়ক। ঢাকায় এফডিসি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৭ সালে। নায়করাজ অভিনয় শুরু করেন ১৯৬৪ সাল থেকে। বাংলা চলচ্চিত্রের শৈশব থেকে যৌবন যেন তাঁর হাত ধরেই পথ চলেছে। তাঁর অভিনয় দক্ষতা দিয়ে তিনি বাংলার নারী হৃদয়ে স্বপ্নের নায়ক হয়ে উঠেছেন। তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলো বাস্তবজীবনে আদর্শের প্রতীক। যে কারণে তিনি মায়ের কাছে ছেলের মতো, ভাইয়ের কাছে বোন, আর যুবতী নারীর কাছে আরাধ্য প্রেমিকের মতো। বাংলা চলচ্চিত্রে দাপটের সঙ্গে বিরাজ করেছেন প্রায় অর্ধ শতাব্দী। প্রেমের ছবির পাশাপাশি এ্যাকশান ছবিতেও ছিলেন সমান সফল। প্রযোজক হিসেবে নায়ক রাজের পথচলা ‘রংবাজ’ ছবিটি প্রযোজনার মধ্য দিয়ে। ছবিটিতে তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের সার্বিক অবস্থার কথা চিন্তা করে তাঁর প্রেমিক রাজের ইমেজ থেকে নিজেকে বেড় করে তৈরি করলেন নতুন চরিত্র। এ ছবিতেও তিনি সুপার হিরো। চলচ্চিত্রে সমাজ এবং সময়ের প্রয়োজনে চরিত্রের পরিবর্তন ঘটিয়েও কী করে সুপার হিরো হওয়া যায় তা তিনিই দেখিয়ে গেছেন। এরপর করলেন ‘বেইমান’। ১৯৭৭ সালে পরিচালিত প্রথম ছবি ‘অনন্ত প্রেম,’ পরিচালক হিসেবে তাঁর প্রথম আত্মপ্রকাশ। অভিনয় পাগল মানুষটি নিজেই বলতেন, ‘আমার প্রেম, আমার ভালবাসা, আমার সবকিছু অভিনয় আর চলচ্চিত্রকে ঘিরে। এছাড়া আমি আর কিছু জানি না, পারি না।’ তিনি তার কর্মময় জীবনে প্রায় ৩০০টি বাংলা ও উর্দু চলচিত্রে অভিনয় করেছেন। পরিচালনা করেছেন ১৬টি চলচ্চিত্র। প্রযোজনা করেছেন ২০টি ছবি। তাঁর উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে, কি যে করি, অশিক্ষিত, বড় ভাল লোক ছিল, চন্দ্রনাথ, যোগাযোগ, ছুটির ঘণ্টা, বেইমান, অনির্বান, সেøাগান, ঝড়ের পাখি, আলোর মিছির, এখানে আকাশ নীল, অবাক পৃথিবী, বদনাম, আমি বাঁচতে চাই, কোটি টাকার ফকির, মন দিয়েছি তোমাকে, উত্তর ফাল্গুনী উল্লেখযোগ্য। পুরস্কার পেয়েছেন অসংখ্যবার। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সরকার সংস্কৃতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখার জন তাঁকে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করে। এছাড়া ১৯৭৬, ১৯৭৮, ১৯৮২, ১৯৮৪, ১৯৮৮ সালে মোট ৫ বার শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন তিনি। ২০১৩ সালে চলচ্চিত্র অবদানের জন্য তাঁকে আজীবন সম্মাননা দেয়া হয়। তিনি ২০১৪ সালে মেরিল প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা পুরস্কারসহ আরও বেশ কয়েকটি আজীবন সম্মাননা পুরস্কার পান। মরণোত্তর সম্মাননা পদক পেয়েছেন ২০১৭তে। চলচ্চিত্রের বাইরে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের শুভেচ্ছা দূত হিসেবে কাজ করেছেন। বড় মনের এই অভিনেতা এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, ‘ আমি আমার জীবনের অতীত ভুলি না। আমি এই ঢাকা শহরে রিফিউজি হয়ে এসেছি। স্ট্রাগল করেছি। না খেয়ে থেকেছি। যার জন্য পয়সার প্রতি লোভ কোনদিন আসেনি। ওটা আসেনি বলেই আজকে আমি এতদূর শান্তিতে এসেছি।’ তিনি ছিলেন চলচ্চিত্রে সকলের ভরসার স্থান। কারও কোন সমস্যা, বিবাদ মেটানো, সকলের অভিযোগ উপস্থাপনের ভরসাস্থল ছিলেন তিনি। তাঁর হাত ধরে উঠে এসেছে অনেক শিল্পী। আজীবন চিন্তা করেছেন বাংলা চলচ্চিত্রের বর্তমান ও ভবিষত নিয়ে। ২১ আগস্ট, ২০১৭ পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেছেন, রাজ্জাক বেঁচে আছেন, থাকবেন বাঙালীর হৃদয় রাজ্যের রাজা হয়ে।
×