ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শোকের দিনে শক্তির উৎস শেখ মুজিব

শূন্যতার দিনে পরিপূর্ণ ফিরে পাওয়া, উজ্জীবন

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ১৬ আগস্ট ২০১৮

শূন্যতার দিনে পরিপূর্ণ ফিরে পাওয়া, উজ্জীবন

মোরসালিন মিজান ॥ তোমার ছবি টাঙাতে পারি না ঘরে,/ তাই তো আমার দেয়াল শূন্য রাখি,/ আমার বুকের গভীর ভালোবাসায়/ উন্নতশির তোমার ছবি আঁকি...। প্রিয় পিতার ছবি বড় ভালবেসে বুকে এঁকে রেখেছে বাঙালী। মুজিব নামের ধ্রুবতারাটি সেই যে জ্বলেছিল, এখনও একই রকম জ্বলজ্বল করছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বড় নির্দয়, বড় নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছিল। কেড়ে নিয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে। অথচ আজ, কী আশ্চর্য, সে দিনটিতেই সবচেয়ে বেশি ফিরে আসেন তিনি। বুধবারও দেখা গেল অভিন্ন দৃশ্য। চিরবিদায়ের দিনে নতুন প্রাণ পেয়েছিলেন শেখ মুজিব। বাংলার প্রতি প্রান্তে এদিন একটি নামই উচ্চারিত হয়েছে। সারা দেশের মতো রাজধানী শহর ঢাকাতেও আর কেউ ছিলেন না। কাউকে দেখা যায়নি। শেখ মুজিবুর রহমানের বহুমাত্রিক উপস্থাপনা চোখে পড়েছে শুধু। এভাবে শূন্যতার দিনে অদ্ভুত এক পূর্ণতা। উজ্জীবন। নতুন করে আশাবাদী করে। বরাবরের মতো এবারও চিরবিদায়ের দিনে শ্রদ্ধা-ভালবাসায় স্মরণ করা হয় প্রিয় পিতাকে। সাধারণ মানুষের বুকে তিনি ছিলেন। ছিলেন সভা-সমাবেশে। ব্যানারে-ফ্যাস্টুনে। কথা কবিতায় গানে। আরও সত্য আরও অনিবার্য হয়ে সারা বাংলায় এদিন ছড়িয়ে পড়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। খুব ভোরে ঘর থেকে বের হয়ে এসেছিলেন রাজধানীর মানুষ। কৃতজ্ঞ বাঙালীর একটিই গন্তব্যÑ ধানম-ি ৩২। ¯্রােতের মতো সেদিকে ছুটছিলেন সবাই। অনেক দূরে গাড়ি রেখে হাঁটতে হচ্ছিল। অথচ ক্লান্তিহীন। কী এক যাদুমন্ত্র টেনে নিয়ে যাচ্ছিল সবাইকে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ভিড় করে ছিলেন রাজনীতির মানুষেরা। সে তুলনায় বিকেলটা ছিল ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ। কেউ আসছিলেন। ফিরে যাচ্ছিলেন কেউ। বিভিন্ন বয়সী মানুষ। সবারই মলিন মুখ। হাতে ফুল। কাঁচা ফুলের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা এলাকায়। মুজিবপ্রেমী মানুষরা ছলছল চোখে তাকাচ্ছিলেন ৩২ নম্বর সড়কের ঐতিহাসিক বাড়িটির দিকে। শূন্য খোলা বাড়ান্দাটি দূর থেকে দৃশ্যমান হয়। তাই দেখে ভেতরটা কেমন যেন গুমরে কেঁদে ওঠে। অবশ্য পরক্ষণেই আনন্দে হেসে ওঠে মন। এই ভেবে যে, মুজিবের নামে ঠিক ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশ। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ স্বরূপে ফিরেছে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালীর প্রতিকৃতির সামনে এখন দীর্ঘ লাইন। সেই লাইনে লম্বা সময় দাঁড়িয়ে ফুল দিচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধুপ্রেমীরা। কথা প্রসঙ্গে আমির হোসেন নামের এক প্রবীণ আওয়ামী লীগ কর্মী বলছিলেন, এখন অসংখ্য মানুষ ৩২ নম্বর আসেন। দেখে ভাল লাগে। তবে আমার গায়ে শক্তি নেই। এত ভিড় ঠেলতে পারি না। তাই বিকেলে এসেছি। শেখ সাহেবের বাড়িটা দূর থেকে আজ আবার দেখলাম। আহারে! এই মানুষটা আজ বেঁচে থাকলে কোথায় চলে যেত দেশ...। কথা শেষ হয় না। জলে ভরে ওঠে চোখ। সিরাজুল ইসলাম নামের আরেক বঙ্গবন্ধু প্রেমিক থাকেন ধানম-িতেই। তিনি বলছিলেন, বঙ্গবন্ধুর মতো নেতা হয় না। তিনি কত বড় নেতা ছিলেন তা আজকের প্রজন্ম হয়ত অনুমানও করতে পারবে না। কারণ, তারা রুগ্ন রাজনীতি দেখে বিতশ্রদ্ধ হয়ে গেছে। এই প্রজন্মের আস্থা অর্জন করতে শেখ সাহেবের মতো দেশের জন্য, মানুষের জন্য রাজনীতি করতে হবে। ৩২ নম্বরের জন¯্রােত ক্রমে রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষেরা বহুবিধ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। শোক দিবসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বঙ্গবন্ধুর বিশাল প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়। মিলন চত্বর সংলগ্ন রাস্তাটি ধরে এগোলে দারুণভাবে দৃশ্যমান হন জাতির জনক। বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদের উদ্যোগ। সংগঠনের ১৫০ শিল্পী টানা তিন দিন কাজ করেছেন। ৬৩টি পৃথক ক্যানভাসে এ্যাক্রেলিক মাধ্যমে কাজ করেছেন তারা। সবগুলোই সমন্বিত করে গড়া হয়েছে বঙ্গবন্ধুর অবয়ব। দেখে কবিতার প্রিয় পঙ্ক্তির কথা মনে পড়ে যায়, যেখানে বলা হচ্ছেÑ তোমার ছায়া দীর্ঘ হ’তে-হ’তে/ মানচিত্র ঢেকে দ্যায় সস্নেহে, আদরে...। কবিতা নিয়ে স্বতন্ত্র আয়োজনও ছিল। জাতীয় জাদুঘর এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। স্বনামধন্য কবিরা স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন। কবিতার সঙ্গে কবিকণ্ঠ। অন্যরকম আবেগ। অভিব্যক্তি। দারুণ এক আবহ তৈরি করতে সক্ষম হয়। নির্মলেন্দু গুণ সবার আগে সেই ষাটের দশকে সম্ভাবনাময় শেখ মুজিবুর রহমানকে উৎসর্গ করে কবিতা লিখেছিলেন। বহুকাল পর কবিতাটি পাঠ করে শোনান তিনি। এত আগের রচনা অথচ চমকিত না হয়ে পারা যায় না। বিরুদ্ধ সময়ে এ কবিতা ছাপতে সম্পাদককে বাধ্য করার গল্প, কবিতা পাঠে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিক্রিয়া ইত্যাদিও ছোট করে বলার চেষ্টা করেন কবি। সবাই তখন মুগ্ধ ¯্রােতা। অন্য কবিরাও নিজের বাছাই করা কবিতা নিয়ে মঞ্চে উপস্থি হয়েছিলেন। তাদের ভাব ও ভাষা বহুমাত্রিক বঙ্গবন্ধুকে তুলে ধরে। স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কবি রবিউল হুসাইন, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, মোহাম্মদ নূরুল হুদা, অসীম সাহা, কবি মোহাম্মদ সামাদ, নূহ-উল-আলম লেনিন, রুবি রহমান, শিহাব সরকার, কামাল চৌধুরী, আনিসুল হক, মোহাম্মদ সাদিক। একটির পর একটি কবিতা। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা এত কবিতা এক মঞ্চ থেকে অনেকদিন শোনা হয়নি। বেশির ভাগ কবিতাই পূর্বে প্রকাশিত। তবুও নতুনের মতো লাগে। নতুনক কবিতাও ছিল। অনুষ্ঠানে একেবারে সদ্যজাত কবিতা পাঠ করে শোনান কবি তারিক সুজাত। ছড়াকারদের মধ্যে আলম তালুকদার এদিনও নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেন। অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে ছিল আবৃত্তি। খ্যাতিমান বাচিক শিল্পীদের এক মঞ্চে বসিয়েছিল জাদুঘর। আবৃত্তি করেন সৈয়দ হাসান ইমাম, আশরাফুল আলম, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ের মতো সিনিয়ররা। এ সময়ের তারকা শিল্পী হাসান আরিফের আবৃত্তি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে উপভোগ করেন ¯্রােতা। রফিকুল ইসলাম, মাহীদুল ইসলাম, লায়লা তারান্নুম চৌধুরীও নিজ নিজ পছন্দের কবিতা থেকে সুন্দর আবৃত্তি করেন। তবে বেশিরভাগ বাচিক শিল্পীর কণ্ঠেই ছিল নির্মলেন্দু গুণের কবিতা। বঙ্গবন্ধুকে এই কবি কত সফলভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন, তার যেন স্বীকৃতি দেন আবৃত্তি শিল্পীরা। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। তার আবৃত্তির গুণ সবার জানা। তারকা শিল্পী এদিন মহাদেব সাহার খুব বিখ্যাত একটি কবিতা থেকে জাতির জনককে হারানোর বেদনা ব্যক্ত করেন। এভাবে শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলো একে একে তুলে ধরতে থাকে মুক্তি সংগ্রামের মহান নেতাকে। কবিতার প্রতি পঙ্ক্তিতে শোক। পিতা হারানোর ব্যথা। মহান নেতাকে ফিরে পাওয়ার আকুতি। সব মিলিয়ে অনন্য। শিল্পকলা একাডেমিতে আয়োজন করা হয় চিত্র প্রদর্শনীর। ‘যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা’ শিরোনামে নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ করা হয়। ছিল আরও কিছু অনুষ্ঠান। শাহবাগের পাঠক সমাবেশ কেন্দ্রে মাসের প্রথম দিন থেকেই চলছিল বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা বাংলা ও ইংরেজী বইয়ের বিশেষ প্রদর্শনী। ‘জাতির জনককে জানুন’ শীর্ষক আয়োজনে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কিত দেড় হাজার বাংলা ও ইংরেজী গ্রন্থ প্রদর্শিত হচ্ছে। আছে জীবনীগ্রন্থ, প্রবন্ধ, কবিতা, তৎকালীন সময়ের রাজনৈতিক অবস্থার বিশ্লেষণসহ নানা রচনা। জাতির জনককে বিষয় করে লেখা বই দিয়ে সাজানো হয়েছে একটি আলাদা কর্নার। সেখান থেকে পছন্দমতো বই খুঁজে নিয়ে সেখানে বসেই পড়ছিলেন পাঠক। এভাবে হারানোর দিনে জাতির পিতার দারুণ এক ফিরে আসা। এ যেন কবির সেই ‘একটি মুজিবরের থেকে/লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি/আকাশে বাতাসে ওঠে রণী...।
×