ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গুজব ছড়িয়ে নাশকতায় উস্কানি ॥ আটক ৩

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ১৬ আগস্ট ২০১৮

গুজব ছড়িয়ে নাশকতায় উস্কানি ॥ আটক ৩

বিভাষ বাড়ৈ ॥ নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনকে কাজে লাগিয়ে ফেসবুকে ভিডিও বার্তায় গুজব ছড়িয়ে নাশকতায় উস্কানি দেয়ার অভিযোগে দু’দিনে আটক হয়েছেন তিনজন। এছাড়া একজনকে আটকের পর মুচলেকা দেয়ায় তাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আটক তিনজন কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতা হলেও তাদের বিরুদ্ধে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে ধর্ষণের গুজব ছড়ানোর গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। গুজব ছড়ানোই আটকের কারণ। এদিকে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে সহিংসতা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উস্কানি দেয়ার ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৫১ মামলায় গ্রেফতার ৯৭ জন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, গত দুুদিনে আটক তিনজনের এক ছাত্রী ইডেন কলেজ ও দুজন ছাত্র বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় ইউল্যাবের শিক্ষার্থী। যাকে আটকের পর ছেড়ে দেয়া হয়েছে সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আটক হওয়ার পর বিভিন্ন মাধ্যমে কোটা সংস্কার আন্দোলনে অভিযোগে তাদের গ্রেফতারের তথ্যপ্রচার হলেও তাদের আটকের কারণ ভিন্ন। আটক তিনজনই নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে ধর্ষণ ও হত্যার মতো গুজব ছড়িয়েছেন বলে তথ্য মিলছে। তাদের আটকের কারণ কোন আন্দোলন নয়, বরং আন্দোলনের সুযোগে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও বার্তায় গুজব ছড়িয়ে নাশকতায় উস্কানি দেয়া। জানা গেছে, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন নাহার হলের সামনে থেকে শেখ তাসনিম আফরোজ ইমি নামে এক ছাত্রীকে আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ডিএমপির গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার মাসুদুর রহমান বলেছেন, তাসনিম আফরোজ ইমি নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য আনা হয়েছিল। এ কথা প্রক্টর স্যার জানতেন। তাকে জানিয়েই ইমিকে আনা হয়েছিল। তিনি আরও বলেন, তার ফেসবুক পেজে আন্দোলনের নামে উস্কানিমূলক পোস্ট পাওয়া গিয়েছিল। ডিবি পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাকে রাত ১০টার মধ্যেই ছেড়ে দিয়েছে। তার কাছ থেকে লিখিত নেয়া হয়েছে যে, ভবিষ্যতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ওরকম উস্কানিমূলক কোন পোস্ট আর তিনি দেবেন না। ইমি সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৩-১৪ সেশনের শিক্ষার্থী। ইমির সহপাঠীরা জানিয়েছেন, ইমি কোটা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। এছাড়া ইমি সাংস্কৃতিক সংগঠন স্লোগান ৭১-এর সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রক্তদাতাদের সংগঠন বাঁধনের সাবেক কার্যকরী পরিষদের সদস্য। এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেত্রী ও ইডেন মহিলা কলেজের ছাত্রী লুৎফুন নাহার লুমাকে বুধবার ভোরে সিরাজগঞ্জ থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বেলকুচি থানার ওসি আব্দুর রাজ্জাক জানিয়েছেন, জেলার চৌহালী উপজেলার এনায়েতপুর এলাকায় খিদ্রচাপড়ার চর থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। সাইবার ক্রাইম টিম খোঁজা শুরু করলে লুমা এই বাড়িতে এসে আত্মগোপন করেন। তথ্যপ্রযুক্তি আইনে গ্রেফতারের পর তারা তাকে ঢাকায় আনা হয়েছে। লুমা ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী জানিয়ে পুলিশ বলছে, গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার বাউখোলা গ্রামের আব্দুল কুদ্দসের মেয়ে লুমা বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ কমিটির যুগ্ম সম্পাদক। লুমার বাবা বর্তমানে গোপালগঞ্জে বসবাস করলেও খিদ্রচাপড়ার চরে তাদের পৈত্রিক বাড়ি রয়েছে। তার স্বজনরা এখানেই বসবাস করেন। জানা গেছে, এই ছাত্রী কোটা আন্দোলনে যুক্ত থাকলেও সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছেন শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের দাবিতে চলা আন্দোলনের সময় ফেসবুকে ভিডিও বার্তার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে ধর্ষণের গুজব ছড়ানোর মধ্য দিয়ে। এ সময় বোরকা পরা এক তরুণীকে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে দেখা যায়, ‘জিগাতলাতে তাদের পার্টি সেন্টারে অনেক অনেক মেয়েকে রেপ করা হচ্ছে। প্লিজ কিছু করেন। গ্রেফতার এ ছাত্রী জঙ্গী নেতা মুফতী হান্নানের আত্মীয় বলেও তথ্য মিলছে। গেল ৪ আগস্ট নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের রাস্তায় অবস্থানের সময় হঠাৎ ফেসবুক লাইভে এসে বেশ কয়েকজন বলতে থাকে, আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে ধর্ষণ, হত্যা করা হচ্ছে। এ সময় বোরকা পরা এক তরুণী রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘জিগাতলাতে তাদের পার্টি সেন্টারে অনেক অনেক মেয়েকে রেপ করা হচ্ছে। প্লিজ কিছু করেন।’ মেয়েটির মুখ ঢাকা ছিল। কিন্তু রেকর্ডিংয়ের সময় তার সেই মুখেও ক্যামেরা ধরা হয়নি। চিৎকার করে ওই তরুণী যা যা বলতে থাকেন তার সব পরিষ্কার বোঝা যায়নি। যতটুকু বুঝা যায় তা হলো, ‘ওরা গুলি করতেছে, ওরা কি ছাত্র? ওরা কি আদৌ কোন ছাত্র?’ এটি যখন রেকর্ড করা হচ্ছিল, তখন দুই তরুণকে পেছন থেকে দেখা যায়। তবে তারা ক্যামেরার সামনে আসেনি। ফলে তাদের চেহারা দেখা যায়নি। মেয়েটি বলতে থাকেন, ‘জিগাতলা পার্টি সেন্টারে প্রতিটা ছাত্ররে ঢুকাইয়া ঢুকাইয়া গুলি করতাছে, প্লিজ।’ মেয়েটি দাবি করতে থাকেন, সেখানে সাধারণ মানুষসহ অনেকের রক্ত ঝরেছে এবং তাতে তিনি নিজেও ছিলেন। তবে কার্যালয়ের ভেতরে আহত হলে তিনি কিভাবে বের হলেন, সেটা বলেননি। মেয়েটির মুখও ভালভাবে দেখানো হয়নি ভিডিওতে। তবে এটি লুনা বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কদিন ধরেই তথ্য প্রমাণ দিচ্ছিল কোটা সংস্কার আন্দোলনে থাকা অনেক শিক্ষার্থীও। বুধবার ভোরে ঢাকা মহানগর পুলিশের একটি তদন্ত দল ও বেলকুচি থানা পুলিশ যৌথ অভিযান চালিয়ে যমুনা নদীর দুর্গম চরাঞ্চলের খিদ্র চাপড়ির চর থেকে লুমাকে গ্রেফতার করে। তার বিরুদ্ধে ঢাকার রমনা থানায় তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা রয়েছে। তিনি দীর্ঘদিন বেলকুচির খিদ্র চাপড়ির চরে দাদার বাড়িতে পালিয়ে ছিলেন। এদিকে আওয়ামী লীগের ধানম-ির কার্যালয়ে হত্যা ও ধর্ষণের গুজব ছড়িয়ে উত্তেজনা সৃষ্টির অভিযোগে আরও দুই জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। দুইজন হলেন- আহমাদ হোসাইন এবং নাজমুস সাকিব। এদের মধ্যে সাকিব বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় ইউল্যাবের শিক্ষার্থী। তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডিয়া ক্লাবের সভাপতি ছিলেন। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর এবং ফার্মগেটের রাজাবাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদেরকে বুধবার রাতে আটক করে। পুলিশ জানায়, গত ৪ আগস্ট শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালে ধানম-িতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে চারজন ছাত্রের চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছে এবং চারছাত্রীকে ধর্ষণ করা হয়েছে বলে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন আহমাদ হোসাইন ও নাজমুস সাকিব। তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের রাস্তায় নেমে আসতে আহ্বান জানান। সেদিন এই কথা ফেসবুক লাইভে এসে এবং সাক্ষাতকারের মতো করে বানিয়ে বিভিন্ন আইডি থেকেই প্রচার করা হয়। আর এরপর স্কুল-কলেজের পোশাক পরিহিত এবং ড্রেসছাড়া কিছু তরুণ ধানম-িতে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে হামলা করে, সংঘর্ষ হয় দুই পক্ষে, ঝরে রক্ত। পুলিশ বলছে, একথা ছড়ানোর পেছনে যে অন্য উদ্দেশ্য ছিল, সেটাও স্পষ্ট। দেশের পাশাপাশি দেশের বাইরে থেকে ফেসবুক লাইভে এসে সবাইকে রাস্তায় নেমে এসে সরকার উৎখাতের আহ্বানও জানানো হয়। অন্যদিকে নাশকতায় উস্কানি ও সরাসরি হামলায় জড়িতদের বিরুদ্ধে নেয়া ব্যবস্থা সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেছে, নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে সহিংস ঘটনা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উস্কানির প্রেক্ষিতে বিভিন্ন থানায় মোট ৫১টি মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় বুধবার পর্যন্ত মোট ৯৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে দ-বিধি ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে দায়ের করা মোট ৪৩ মামলায় ৮১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আন্দোলনে সহিংস ঘটনা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উস্কানির প্রেক্ষিতে রমনা বিভাগে মোট ১৪টি মামলা করা হয় এবং মোট ৩১ জনকে গ্রেফতার করা হয়। যার মধ্যে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলা হয় ১০টি। যেখানে গ্রেফতার করা হয় ২০ জনকে এবং ৮৪ জনকে আসামি করে ৪টি মামলায় গ্রেফতার করা হয় ১১ জনকে। ১৪টি মামলার মধ্যে ১৩টির তদন্ত করছে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ এবং একটি মামলা তদন্ত করছে ডিবি পুলিশ। লালবাগ বিভাগে একজনসহ অজ্ঞাতনামা ৫০-৬০ জনকে আসামি করে ১টি মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় একজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ওয়ারী বিভাগে মোট মামলা হয়েছে ২টি। অজ্ঞাতনামা ৩৫০-৪৫০ জনকে আসামি করে করা দুই মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে একজনকে। এ বিষয়ে মতিঝিল বিভাগে অজ্ঞাতনামা আসামি করে ৬টি মামলা করা হয়েছে। ৬টি মামলায় ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তেজগাঁও বিভাগে ৬ জনকে আসামি করে দুটি মামলা করা হয়েছে। যার মধ্যে ২ জন এজাহারনামীয়সহ সন্দিগ্ধ আরও ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মিরপুর বিভাগের মিরপুর মডেল থানায় বিইউবিটি ইউনিভার্সিটি ও কমার্স কলেজসহ অন্যান্য কলেজের অজ্ঞাতনামা ৫০০-৬০০ ছাত্র শিক্ষককে আসামি করে ১টি মামলা, অজ্ঞাতনামা ৫০-৬০ জনকে আসামি করে কাফরুল থানায় ১টি মামলা এবং ৯৬ জনকে আসামি করে আরও ৩টিসহ মোট ৫টি মামলা করা হয়েছে। গুলশান বিভাগে অজ্ঞাতনামা ২০০০-২৪৫০ জনকে আসামি করে ৭টি মামলা এবং ৩১ জনকে আসামি করে আরও ২টি মামলাসহ মোট ৯টি মামলা করা হয়েছে। ৯টি মামলায় মোট ২৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। উত্তরা বিভাগে অজ্ঞাতনামা ১০০-১৫০ জনকে আসামি করে ৩টি মামলা এবং ১১৩ জনসহ অজ্ঞাতনামা আসামির বিরুদ্ধে একটি মামলাসহ মোট ৪টি মামলা করা হয়েছে। মামলায় মোট ৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি আইনে ২৯ জনকে আসামি করে দায়ের করা মোট ৮টি মামলায় ১৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ৮টি মামলার মধ্যে ৪টি মামলা ডিএমপি’র সাইবার সিকিউরিটি এ্যান্ড ক্রাইম বিভাগ, একটি ডিবি পুলিশ এবং একটি থানা পুলিশ তদন্ত করছে। এই আন্দোলনে নানাভাবে গুজব ছড়ানো ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে তৎপর রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
×