ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অবাধে বাজারজাত সোডিয়াম সালফেট ॥ খাবার লবণ হিসেবে

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ১৬ আগস্ট ২০১৮

অবাধে বাজারজাত সোডিয়াম সালফেট ॥ খাবার লবণ হিসেবে

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ খাবার লবণ। যার রাসায়নিক নাম সোডিয়াম ক্লোরাইড। আমদানি প্রক্রিয়ায় এর এইচএস কোড-২৫। এই সোডিয়াম ক্লোরাইড বা লবণ সরকারী অনুমোদন ছাড়া আমদানি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। দেশে যখন ঘাটতি হয় তখন এর চাহিদার প্রয়োজনে সরকারী অনুমোদনে শুধু মিল মালিকদেরই এই লবণ আমদানির সুযোগ দেয়া হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে, সোডিয়াম সালফেট। আমদানি প্রক্রিয়ায় এর এইচএস কোড ২৮। এটি মানুষের খাবার অনুপযোগী। মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর ও রীতিমতো বিষাক্ত। তবে কেমিক্যাল কারখানায় ব্যবহারের জন্য সোডিয়াম সালফেট আমদানি হয়ে থাকে। যেসব কেমিক্যাল মিল কারখানায় সোডিয়াম সালফেটের প্রয়োজন রয়েছে সে সব সংস্থাকে তাদের চাহিদা দেখিয়ে এবং যথাযথ প্রমাণ সাপেক্ষে সোডিয়াম সালফেট আমদানির অনুমতি দেয়ার বিধান রয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, দেশে এই দুই জাতের লবণজাতীয় পণ্যের আমদানি ও ব্যবহার নিয়ে চলছে ভয়ানক জালিয়াতি। সোডিয়াম ক্লোরাইড আমদানি নিষিদ্ধ। তবে যখনই প্রয়োজন তখন আমদানির ক্ষেত্রে এর ওপর ধার্য রয়েছে ৫ শতাংশ কাস্টমস শুল্ক। বিপরীতে সোডিয়াম সালফেট আমদানির ক্ষেত্রে বিধি বিধানের আরোপ নেই। চলছে অবাধ আমদানি। জালিয়াতি হচ্ছে এইচএস কোড ব্যবহার নিয়েও। এর ফলে মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর ও বিষাক্ত সোডিয়াম সালফেটের বাণিজ্যিক অবাধ আমদানি যেমন হচ্ছে, তেমনি খাবার লবণ হিসাবে প্যাকেটজাত হয়ে বাজারজাতকরণও চলছে দেদারছে। উভয় পণ্যের রং সাদা আকারও একই। উপরন্তু সোডিয়াম সালফেট-সোডিয়াম ক্লোরাইডের চেয়েও অনেক বেশি ধবধবে সাদা। সাধারণ চোখে পৃথক করার সাধ্য নেই। ল্যাব টেস্টেই প্রকৃত তথ্য পাওয়া যায় বটে। সরকার দেশে কেমিক্যাল ব্যবহারকারী শিল্পকে উৎসাহিত করতে সোডিয়াম সালফেট আমদানি শুল্কমুক্ত রেখেছে। যেহেতু সোডিয়াম ক্লোরাইড আমদানিতে ৫ শতাংশ শুল্ক রয়েছে এবং সরকারী অনুমোদন ব্যতিরেকে এ পণ্য আমদানি করা যায় না, সেক্ষেত্রে অসাধু ব্যবসায়ী চক্র সোডিয়াম সালফেট আমদানি করে তা আরেক অসাধু চক্রের সদস্যদের বাজারজাতকরণের সুযোগ দিয়েছে। বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের যে লবণ পাওয়া যায় সে সব ব্র্যান্ডের প্যাকেট নকল করে অসাধু চক্রের সদস্যরা সোডিয়াম সালফেট ঢুকিয়ে দিচ্ছে বলেও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। এসব ঘটনা নিয়ে লবণ মিল মালিকরা চরম ক্ষুব্ধ অবস্থানে রয়েছেন। দেশে আড়াই শতাধিক লবণ মিল কারখানা রয়েছে। এসব মিল মািলকদের পক্ষে চট্টগ্রাম মিল মালিক সমিতি ইতোমধ্যে সরকারের উচ্চ মহলে দফায় দফায় অভিযোগ দিয়েছে। কিন্তু সুফল মিলছে না। কেন মিলছে না-এর কোন উত্তরও নেই। চট্টগ্রাম লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি নুরুল কবির বুধবার জনকণ্ঠকে জানান, তাদের পক্ষে কাস্টমস, এনবিআর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে এ নিয়ে অভিযোগ করা হয়েছে। কিন্তু চাহিদার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি সোডিয়া সালফেট কেন এবং কারা আমদানি করছে তা নিয়ে কোন তদন্ত হচ্ছে না। উপরন্তু সোডিয়াম সালফেটের আমদানির পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। এদিকে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, আগস্ট পর্যন্ত গত তিন মাসে সোডিয়াম সালফেট আমদানি হয়েছে ১ লাখ ২৩ হাজার টন। অধিকাংশ চালান এসেছে চীন থেকে। কিছু কিছু থাইল্যান্ড, ইরানসহ কয়েকটি দেশ খেতে এসেছে। এ হিসাবে প্রতি মাসে গড়ে সোডিয়াম সালফেট আসছে প্রায় ৫০ হাজার টন। এত বিপুল পরিমাণ এ পণ্য কোথায় ব্যবহৃত হচ্ছে তার কোন নজরদারি নেই। প্রাপ্ত তথ্য মতে, এর একটি বড় অংশ এডিবল সল্ট হিসাবে মানুষের খাবারের লবণ হিসাবে বাজারজাতই হচ্ছে। এদিকে বিসিকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে চলতি বছর লবণের চাহিদা রয়েছে ১৭ লাখ টন। গত মে মাসে লবণ উৎপাদনের মৌসুম শেষ হয়েছে। মৌসুম শেষে দেখা যায়, এবার দেশে লবণ উৎপাদনের পরিমাণ ১৫ লাখ টন। চাহিদার তুলনায় ঘাটতি প্রায় ২ লাখ টন। এ ঘাটতি মেটাতে সরকার কখন আমদানির অনুমতি প্রদান করবে তা এখনও অঘোষিত। এ সুযোগে শুল্কমুক্ত আমদানির সোডিয়াম সালফেট আসছে দেদার। আড়াই শতাধিক লবণ মিল মালিক শঙ্কিত রয়েছেন সোডিয়াম সালফেটের বাজারজাতকরণের দাপটে। বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত যে, সোডিয়াম সালফেট ক্লিনিং এজেন্ট হিসাবে ব্যবহার হয়ে থাকে। এ পণ্য সাধারণত পেপার মিল, টেক্সটাইল মিল, ডিটারজেন্ট, ডায়িং এজেন্ট, ওষুধ প্রস্তুতকারী কারখানাসহ কেমিক্যাল জাতীয় বিভিন্ন শিল্পে ব্যবহৃত হয়। অথচ, অসাধু ব্যবসায়ীরা এ সোডিয়াম সালফেটকে মানুষের খাবারের লবণ হিসাবে বাজারজাত করছে। বৈজ্ঞানিকভাবে আরও স্বীকৃত যে, সোডিয়াম সালফেট মানুষের কিডনিসহ বিভিন্ন অঙ্গের বহুবিধ মরণব্যাধির কারণ হয়ে থাকে। অথচ, বিষয়টি নিয়ে কোন মহলের তেমন কোন উদ্বেগ উৎকণ্ঠা নেই বলেই প্রতীয়মান। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সোডিয়াম সালফেট আমদানিতে সুনির্দিষ্ট কোন নীতিমালাও নেই। বাজারজাতকরণে নজরদারিও অনুপস্থিত। ফলে সুবিধাভোগী ও সুযোগ সন্ধানী অসাধু ব্যবসায়ীরা কেমিক্যাল ফ্যাক্টরিতে ব্যবহারের নাম করে জাল কাগজপত্র দেখিয়ে প্রতিনিয়ত সোডিয়াম সালফেটের চালান নিয়ে আসছেন। ফলে তা বাজারজাতকরণের জন্য বিক্রি করে দিচ্ছে। এদিকে কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, মাঝে মাঝে মিথ্যা ঘোষণার সোডিয়াম সালফেটের আমদানির চালান ধরাও পড়ছে। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের হাতেগোনা কিছু অসাধু ব্যবসায়ী জাল জালিয়াতির মাধ্যমে সোডিয়াম সালফেট আমদানির সঙ্গে জড়িত। কাস্টমস সূত্র জানিয়েছে, ইতোপূর্বে জাল জালিয়াতির মাধ্যমে আমদানিকৃত সোডিয়াম সালফেটের চালান ধরা পড়েছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে কাস্টম এ্যাক্টে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তবে সূত্র মতে, ফাঁক ফোকরে এইচএস কোড ও জালজালিয়াতির কাগজপত্র দিয়ে সোডিয়াম সালফেটে চালান নিয়মিত আমদানি হয়ে আসছে। খালাসও হচ্ছে। মানুষের খাবারের জন্য বাজারজাতও হচ্ছে। এদিকে ঈদ-উল আজহা আসন্ন। পশুর চামড়া সংরক্ষণে এ সময় প্রায় দেড় লাখ টন সোডিয়াম ক্লোরাইডের চাহিদা রয়েছে। সুযোগ সুন্ধানীরা এ সময় সোডিয়াম সালফেটের যোগান দেয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। সূত্র মতে, বুঝে হোক আর না বুঝে হোক যদি চামড়া সংরক্ষণের সঙ্গে জড়িতরা সোডিয়াম ক্লোরাইডের বদলে সোডিয়াম সালফেট ব্যবহার করে তাতে চামড়ার গুণগত মান ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ক্ষতি ও ধস নেমে আসতে বাধ্য। সঙ্গত কারণে, চামড়া সংরক্ষণে জড়িতদের এক্ষেত্রে সচেতনতা প্রয়োজন বলেও সূত্রগুলোর অভিমত।
×