ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

লিয়াকত হোসেন খোকন

ঈদ ছিল বৈচিত্র্যময়

প্রকাশিত: ০৩:৪৭, ১৬ আগস্ট ২০১৮

ঈদ ছিল বৈচিত্র্যময়

ঈদ-উল-আজহা হচ্ছে আত্মত্যাগের ঈদ। এটি ঈদ আল-কোরবানি বা ঈদ আল-নাহর নামেও অভিহিত করা হয় । কোরবানির ঈদ বা বাকরা ঈদ নামেও পরিচিত। এদিনে যে যার মতো গরু, খাসি, ভেড়া, দুম্বা কোরবানি দেয়। এদিনে সামর্থ্যবান মুসলমানরা গরু জবাই ও প্রসেস নিয়ে বিকেল পর্যন্তই ব্যস্ত সময় পার করেন। মূলত সকালে ঈদের নামাজ শেষ হতেই যুবক-বয়স্করা কোরবানির পশু কাটাকাটি শেষে মাংস বিতরণ করার কাজেও আবার থাকেন ব্যস্ত। ছোটরা এদিনে নতুন পোশাক পরে, ফিন্নি-সেমাই খেয়ে আনন্দে দিন কাটায়। এ হলো এ যুগের কোরবানির চিত্র। আরও বাস্তবচিত্র হলো, ঈদের নামাজের সময় চারদিক থাকে নিরাপত্তা চাদরে ঢাকা। ৫০ বছর আগে ঈদের নামাজে নিরাপত্তার কথা কখনও কেউ ভুলেও ভাবত না। তখন একটি গরুর দাম ছিল হাজার টাকা, এখন সেই গরুর দাম পৌঁছেছে লাখ টাকায়। সে আমলে গরু মোটাতাজা করার কোন কৌশল ছিল না আর আজকাল তো রোগা গরু ২ কি ৩ মাসের মধ্যে হৃষ্টপুষ্ট করা হয়। অর্থাৎ ১৫ কেজি ওজনের গরু ৩ মাসের মধ্যে করা হচ্ছে দেড় মন ওজনে। ঈদে এখন আর আনন্দ-ফুর্তি চোখে পড়ে না। সবাই যেন আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছে- দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানোর সেই ঐতিহ্য যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। তবে ইতিহাস বলে, সুলতানি ও মুঘল আমলের ঈদ ছিল বৈচিত্র্যে ভরা । ঈদ উৎসবের আগের দিন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য সম্রাট মণিমুক্তা খচিত রেশমি বা মেষের পশমের পোশাক পাঠিয়ে দিতেন। সারা শহরই নতুন সাজে সজ্জিত থাকত এদিন। নতুন পতাকা উড্ডীন হতো প্রাসাদশীর্ষে। এদিনে হাতিশালা থেকে হাতিগুলোকে বের করা হতো, গা মেজে, স্নান করিয়ে, মণিমানিক্যে বোনা রেশমি পোশাক পরানোর পর হাতির ওপর হাওদাও থাকত, অমনি স্বর্ণ আর মখমলে মোড়া, ওপরে সম্রাটের নিজস্ব রাজছত্র। সেও রতœখচিত। ছাতার বাঁটগুলোও নিখাঁদ স্বর্ণের। এরমধ্যে পছন্দমতো একটিতে সম্রাট নিজে উঠতেন। সামনে থাকত ক্রীতদাসের দল। তাদের মাথায় থাকত স্বর্ণের ফেজ। প্রায় শ তিনেক লোকের এক বর্ণাঢ্য প্রাসাদ তোরণে পৌঁছলেই, সেখানে অপেক্ষমাণ সৈনিকেরা প্যারেড শুরু করত। ভিন্ন ভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন পতাকা থাকত। শোভাযাত্রা হতো সারা শহর পরিক্রমা করার মাধ্যমে। অবশেষে বিকেলে বসত ঈদ-দরবার। স্বর্ণসিংহাসনে বসতেন সম্রাট। সম্রাট এসে আসন গ্রহণ করলেই বিসমিল্লাহ ধ্বনিতে চারদিক মুখরিত হতো। কাজি, খতিব, উলামা, সইদ ইত্যাদি বসার পর বসতেন সম্রাটের ভাই, শ্যালক, জ্ঞাতিবর্গ। তারপর দূরে বসত ক্রীতদাসরা। সুগন্ধে ভরপুর হয়ে যেত দরবার। স্বর্ণ-রুপার পাত্রে করে সবার মাথায় ছিটানো হতো পুষ্পনির্যাস। সবশেষে ঈদের রাতে হতো বিরাট ভোজ। এ তো হলো সুলতানি ও মুঘল যুগের কাহিনী। আমাদের শৈশবে দেখেছি- ঈদের দিন সারা শহর নানা রঙের বাতিতে ঝলমলে করত। সে যেন ঝিকিমিকি- ঝিকঝিক। আতসবাজিও ফুটত- সে যে কি আনন্দ। তুবড়ির আলোয় পথ চিনে চিনে ঘরে ফিরেই পোলাওর সঙ্গে গরুর মাংস খেয়ে উঠতে না উঠতেই দেখি মেহমান। খয়ে-দেয়ে খোশমেজাজে গল্প করে বেশি রাত হতেই তারা ফিরে যেতেন যে যার ঘরে। তখন ঈদের রাতে পোলাও-মাংস খাওয়ার স্বাদটা ছিল অন্যরকম। আরেকটা মজার ব্যাপার ঈদের দিনে ‘সুচিত্রা-উত্তম’ জুটি অভিনীত ‘সাগরিকা’ ছবি দেখার স্মৃতি এই পড়ন্ত বেলায় খুব করে মনে করিয়ে দেয়। তবে আজ ছবি দেখার দিন ফুরিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি কোরবানির মাংস খাওয়ার দিনও ফুরিয়ে গেল বয়সের কারণে। তবে এ প্রজন্মের ছেলেদের গরুর মাংস খাওয়া দেখে দেখে আনন্দ অনুভব করি। বলি- ‘আহা এলো রে কোরবানির ঈদ।’ রূপনগর ঢাকা থেকে
×