ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আবদুল গাফফার চৌধুরী

‘বজ্রে তোমার বাজে বাঁশি’

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ১৫ আগস্ট ২০১৮

‘বজ্রে তোমার বাজে বাঁশি’

বহুকাল আগে আমি কলিম শরাফীর কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের একটা গান শুনেছিলাম- ‘বজ্রে তোমার বাজে বাঁশি।’ সেই উদাত্ত ভরাট কণ্ঠের গানটি মনে গেঁথে গিয়েছিল। দীর্ঘকাল পর বাংলাদেশের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, গণতন্ত্রের হাতে এখন এই বজ্রের বাঁশি। এই বাঁশির সুরকে আর ভুল বোঝার অবকাশ নেই। তবু অনেকে ভুল বুঝছেন। কেউ বুঝে, কেউ না বুঝে, কেউ সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য। সম্প্রতি দেশে তিনটি আন্দোলন হয়েছে। একটি কোটা পদ্ধতি বাতিলের আন্দোলন। দ্বিতীয়টি সরকারী চাকরির বয়ঃসীমা সংক্রান্ত আন্দোলন। তৃতীয়টি নিরাপদ সড়কের দাবিতে স্কুল ছাত্র-ছাত্রীদের বিশাল আন্দোলন। এই তিনটি আন্দোলনই সরকারবিরোধী আন্দোলন ছিল না। ছিল অনেক ন্যায্য দাবি আদায়ের আন্দোলন। সরকার এই তিনটি আন্দোলনেরই দাবি দাওয়া মেনে নিতে চেয়েছেন। যেমন কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সঙ্গে সঙ্গে মেনে নিয়েছেন (আমি এই কোটা পদ্ধতি বাতিলের সমর্থক নই, সংস্কারের পক্ষপাতী)। এখন এই কোটাপদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত কার্যকর করাও একটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আন্দোলনকারীরা নিশ্চয় সরকারকে সময় দেবেন এবং এই ব্যাপারে সরকার কি করেন তা দেখার জন্য অপেক্ষা করবেন। সরকারী চাকরির বয়ঃসীমা সংক্রান্ত আন্দোলনও একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন। আন্দোলনকারীরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দ্বারা তাদের দাবি-দাওয়া আদায়ের চেষ্টা করছেন। সর্বশেষ নিরাপদ সড়কের দাবিতে স্কুল ছাত্রদের বিশাল আন্দোলন। সরকার এই আন্দোলনের শুরুতেই কচি-কাঁচাদের দাবি মেনে নিয়েছেন এবং সড়কের নিরাপত্তা সংক্রান্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যা তাদের বহুপূর্বে নেয়া উচিত ছিল। সত্যকথা বলতে কি, বাংলাদেশে এক শ্রেণীর বাস মালিক ও ড্রাইভারের দৌরাত্ম্য চরমসীমায় পৌঁছেছে। মানুষের জীবনের কোন দাম তাদের কাছে নেই। তার উপর দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় উন্নয়ন সত্ত্বেও রাস্তাঘাট ও যানবাহনগুলোর অবস্থা খুব খারাপ। দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু নিত্যনৈমত্তিক। এতে প্রতিকারহীন হত্যাকান্ড আখ্যা দেয়া যায়। এই ধরনের হত্যাকান্ডের জন্য একশ্রেণীর বাস ও লরি ড্রাইভার এবং মালিকদের বিচারে সোপর্দ করে মৃত্যুদন্ড দেয়া হলেই মাত্র জনক্ষোভ প্রশমিত হতে পারে। তার আগে সরকারকে তার দায়িত্ব পালন করতে হবে। রাস্তাঘাটের সংস্কার, অচল প্রায় বাস ও লরিকে রাস্তায় চলাচল করতে না দেয়া, দুর্বিসহ যানজট হ্রাস করা ইত্যাদির ব্যাপারে বর্তমান সরকারও বড় একটা নজর দিয়েছেন মনে হয় না। এই ব্যাপারে দেশের জনক্রোধ তাই পুঞ্জীভূত হয়েছে এবং সম্প্রতি দু’জন ছাত্রের মর্মান্তিক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে স্কুলছাত্রদের আন্দোলনের মধ্য দিয়েই তার বিস্ফোরণ ঘটেছে। এই আন্দোলনও কোন রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল না। সরকার উচ্ছেদের আন্দোলন ছিল না। ছিল নিরাপদ সড়ক চলাচলের দাবি আদায়ের আন্দোলন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনের দাবিগুলোকে সঠিক আখ্যা দিয়েছেন এবং তা মেনে নিয়েছেন। এরপর দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর বিশেষ করে বিএনপির উচিত ছিল এই আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে সরকার যাতে আন্দোলনকারীদের দাবিগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করে সে জন্য সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখা। স্কুলছাত্রদের স্কুলে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেয়া। এটাই একটি বিরোধীদলের কর্তব্য। তারা যদি গণতান্ত্রিক হন, তাহলে এটাই তাদের কাজ। স্কুল ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের আন্দোলনে শান্তি-শৃঙ্খলার রক্ষার কাজে অভূতপূর্ব নজির স্থাপন করেছে। তারপরও এই তিনটি আন্দোলনেরই অরাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ চরিত্র ধ্বংস করে একে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির কাজে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে কারা? আগেই বলেছি, কোটা পদ্ধতি বাতিলের আন্দোলনও ছিল একটি অরাজনৈতিক শান্তিপূর্ণ আন্দোলন। কিন্তু পেছন থেকে এই আন্দোলনকে সাবোটাজ করেছে কারা? প্রকৃত আন্দোলনকারীরা কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের বাড়িতে ভাঙচুর করেছে, না করেছে আন্দোলনকারীদের মুখোশ ধারণ করে বিএনপির ছাত্রদল ও জামায়াতের ছাত্রশিবিরের এক দল ক্যাডার? তাদের পশ্চাদ্ধাবন করে ছাত্রলীগও মাঠে নামে। এবং তাদের বাড়াবাড়িও ছিল নিন্দনীয়। তারা তাদের কার্যকলাপ দ্বারা এই আন্দোলনকারীদেরও সরকারবিরোধী করে তুলেছে। বিএনপি-জামায়াত তাই চেয়েছে। তারা চেয়েছে, এই আন্দোলনকে সরকার উচ্ছেদের আন্দোলনে রূপান্তর করে দেশে আবার সন্ত্রাস ও অরাজকতা সৃষ্টি করতে। সরকারও তাই তাদের বিরুদ্ধে লাঠ্যাষোধি প্রয়োগ করেছে। স্কুলছাত্রদের নিরাপদ সড়কের দাবি আদায়ের আন্দোলনেও বিএনপি-জামায়াত নৈতিক সমর্থনদানের জন্য রাস্তায় নেমে তাদের পাশে দাঁড়ায়নি। তারা পাশে দাঁড়ালে এবং পুলিশ তাদের ওপর হামলা চালালে তাকে নিষ্ঠুর দমননীতি বলে নিন্দা করা যেত। কিন্তু বিএনপি নেতারা তা করেননি। সে সাহস তাদের হয়নি। তারা ঘরে বসে এই কোমলমতি ছাত্রদের হিংসার পথ অনুসরণের জন্য উস্কানি দিয়েছেন। এটিকে সরকার উচ্ছেদের আন্দোলনে পরিণত করার চেষ্টা করেছেন। যে কাজটি তারা নিজেরা পারেননি সে কাজটি তারা শিশু-কিশোরদের আন্দোলনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সফল করতে চেষ্টা করেছেন। স্কুলছাত্রেরা তাদের ফাঁদে পা দেয়নি। স্কুলছাত্ররা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করেছে। কিন্তু তাদের মুখোশ ধারণ করে রাজপথে গাড়ি ভাঙচুর করেছে কারা? আওয়ামী লীগ অফিসে সশস্ত্র হামলা চালিয়েছে কারা? এই আন্দোলনে ছাত্র হত্যা, নারী ধর্ষণ, আন্দোলনকারীদের চোখ উপড়ে ফেলার গুজব ছড়িয়ে দেশে আগুন জ্বালাবার চেষ্টা করেছে কারা? অভিনেত্রী নওশাবা তো স্কুলছাত্রী নন। একজন পূর্ণ বয়স্কা মহিলা। ধরা পড়ার পর স্বীকার করেছেন তিনি অন্যের কাছে এসব খবর শুনে ফেসবুকে ছড়িয়েছেন। তাকে উস্কানি দিল কারা? বহির্বিশ্বে কারা একটি জঘন্য মিথ্যা ছড়াচ্ছেন যে, ঢাকায় ঘটনা হচ্ছে ভয়াবহ গণহত্যা? শহিদুল আলম একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন আলোকচিত্রশিল্পী। আলজাজিরাকে দেয়া তার সাক্ষাতকার নিয়ে যখন দেখে বিতর্ক সৃষ্টি হয়, তার বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করে, তখনও আমি তার বক্তব্যটি পড়িনি। ফলে কোন মন্তব্য করতে পারিনি। পরে লন্ডনের একটি প্রো-জামায়াতী সাপ্তাহিক কাগজে প্রকাশিত তার বক্তব্য পাঠ করে বুঝতে পারলাম, এতো সরকারের কোন সমালোচনা নয়; বিএনপি-জামায়াতের সরকারবিরোধী অসত্য প্রচারণার পুনরাবৃত্তি মাত্র। যা এই মুহূর্তে দেশের জন্যও ক্ষতিকর। তিনি সরকারের কোন কোন কাজের নিরপেক্ষ সমালোচনা নিশ্চয়ই করতে পারেন। কিন্তু দেশে নির্বিচার হত্যা, গুম, খুন চলছে, এই সরকার নির্বাচিত ও বৈধ নয় এই ধরনের জামায়াতী প্রচারণা তিনি বিদেশীদের কাছেও চালাতে পারেন কি? বাংলাদেশ এখন একটি জাতীয় সঙ্কটের মধ্য দিয়ে চলছে। দেশটিতে আফগান ও পাকিস্তান পরিস্থিতি সৃষ্টির চক্রান্ত চলছে। এই সময় দেশ এবং সরকারের জন্য বিপজ্জনক প্রচারণা কোন দেশের সরকারেই চলতে দিতে পারেন কি? তিনি যত বড় আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান ব্যক্তি হন, তিনি দেশের আইনের উর্ধে থাকতে পারেন না। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, দেশে ছাত্র আন্দোলন শেষ হয়েছে। কিন্তু একদল বহুরূপী ও সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবী ও কলামিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে তাদের ‘কাগুজে যুদ্ধ’ এখনও অব্যাহত রেখেছেন। তাদের এই প্রচারণার ফাঁদে পা দিয়েছেন দেশের একাধিক বরেণ্য বুদ্ধিজীবীও। তারা হয়তো ভাবছেন দেশে এখন স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক অবস্থা বিরাজ করছে এবং দ্বন্দ্ব চলছে দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী গণতান্ত্রিক দলের মধ্যে। তারা এই দ্বন্দ্বে নিরপেক্ষ পরমহংস দেবের ভূমিকা পালন করে পূজনীয় থাকতে চান। আমি তাদের সবিনয়ে জানিয়ে দিতে চাই, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। বর্তমানে যে সংঘাত চলছে তা একটি গণতান্ত্রিক শিবির ও ফ্যাসিবাদী শিবিরের মধ্যে। এই দ্বন্দ্বে গণতান্ত্রিক শিবিরের দুর্বলতা দেখানোর কোন অবকাশ নেই। অতীতে এই দুর্বলতা দেখাতে গিয়ে গণতন্ত্রকে বার বার রক্তাক্ত ও উৎখাত হতে হয়েছে। গণতন্ত্রকে তাই এখন বার বার শুধু মার খাওয়া নয়, মার দিতেও শিখতে হয়েছে। একটা গণতন্ত্রের শক্তির উদ্বোধন, শত্রুর কাছে দুর্বার আত্মসমর্পণ নয়। এই দুর্বলতা (অথবা উদারতা) দেখাতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিষ্ঠুরভাবে নিহত হয়েছেন। এই সেদিন ২০০৪ সালে শেখ হাসিনা ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার সম্মুখীন হয়েছেন। আজ বর্তমান সরকারের অতিরঞ্জিত ও কল্পিত অত্যাচার সম্পর্কে আমাদের এই ‘পূজনীয় পরমহংস দেবেরা’ যতটা মুখর, সেদিন তাদের ততটা মুখর হতে দেখা যায়নি। দেশে একটি সাধারণ নির্বাচন আসন্ন। এটা আসলে নির্বাচন নয়; দেশটা স্বাধীন ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র থাকবে, না একটি ধর্মান্ধ ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র হবে তা নির্ধারণের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে কারোরই তথাকথিত নিরপেক্ষ থাকার অবকাশ নেই। ১৯৭১ সালে একদল নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবীর কি পরিণতি ঘটেছিল তা কি আমরা ভুলে গেছি? তার চাইতে বজ্রেও বাঁশি বাজুক সেটাই আমার কাম্য। লন্ডন, ১৪ আগস্ট, ২০১৮
×