ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মন্ত্রিসভায় অনুমোদন

কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিস মাস্টার্স ডিগ্রীর সমমান হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১৪ আগস্ট ২০১৮

   কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিস মাস্টার্স ডিগ্রীর  সমমান হচ্ছে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিস সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রী সমমান দেয়া সংক্রান্ত একটি আইন হচ্ছে। এ জন্য ‘কওমি মাদ্রাসাসমূহের দাওরায়ে হাদিসের (তাকমীল) সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রী (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবী) সমমান প্রদান আইন-২০১৮’ খসড়া নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। সোমবার তেজগাঁওয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠকে এ অনুমোদন দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। বৈঠক শেষে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম এ অনুমোদনের কথা জানান। এদিকে আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদন করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন হেফাজত আমির ও আল-হাইয়াতুল উলইয়ার চেয়ারম্যান শাহ্ আহমদ শফী। তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রিসভা আজ যে অনুমোদন দিয়েছে, তা ইতিহাস হয়ে থাকবে। ২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল রাতে গণভবনে কওমি মাদ্রাসার আলেম-ওলামাদের সঙ্গে এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের সনদকে মাস্টার্সের সমমানের স্বীকৃতির ঘোষণা দেন। কওমি মাদ্রাসার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে ও দারুল উলুম দেওবন্দের মূল নীতিকে ভিত্তি ধরে কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের সনদকে মাস্টার্সের (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবী) সমমান প্রদান করে ওই বছরের ১৩ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ থেকে এ বিষয়ে আদেশ জারি করা হয়। আদেশে বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের (বেফাক) সভাপতি ও হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা আহমদ শফীকে প্রধান করে একটি কমিটিও গঠন করার কথা জানানো হয়। কমিটি সনদ বিষয়ক যাবতীয় কার্যক্রমের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী বলে বিবেচিত হবেন। এ কমিটির মাধ্যমে নিবন্ধিত মাদ্রাসাগুলো দাওরায়ে হাদিসের সনদ মাস্টার্সের সমান বিবেচিত হবে বলেও ওই আদেশে উল্লেখ করা হয়েছিল। গত বছরের ১৩ এপ্রিলের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন তুলে ধরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, কয়েক বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে একটি কমিটি করা হয়। তারা কওমি মাদ্রাসা শিক্ষায় বোর্ডের মতো কাজ করবে। সেটাকে অনেকটা এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। এটি দশটি ধারার একটি আইন। খসড়া আইনে বিভিন্ন বিষয়ে সংজ্ঞা দেয়া আছে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, কওমির সংজ্ঞায় বলা হয়েছে- আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত ও দারুল উলুম দেওবন্দের আদর্শ মূলনীতি ও মতপথের অনুসরণে মুসলিম জনসাধারণের আর্থিক সহায়তায় ওলামায়ে-কেরামের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত ইলমে ওহীর শিক্ষা কেন্দ্র। কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিস সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রী সমমান দেয়ার বিষয়টি আগেই হয়ে আসছে জানিয়ে শফিউল আলম বলেন, এখন সেটাকে আইনের কাঠামোতে নিয়ে আসা হয়েছে। এখানে একটা বোর্ডের বিষয় রয়েছে। এটার নাম হচ্ছে আল হাইয়্যাতুল উলিয়ালিল জামিয়াতুল কাওমিয়া বাংলাদেশ। এখন ছয়টি কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড আছে ওনাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায়। একেক এলাকায় একেকটি। বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ, বেফাকুল মাদারিসিল কওমিয়া গওহরডাঙ্গা বাংলাদেশ, আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিসিল বাংলাদেশ, আজাদ দ্বীনি এদারায়ে তা’লীম বাংলাদেশ, তানজিমুল মাদারিসল দ্বীনিয়া বাংলাদেশ ও জাতীয় দ্বীনি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বাংলাদেশ। বাংলাদেশে যত কওমি মাদ্রাসা আছে, সেগুলোকে এই ছয়টি বোর্ড নিয়ন্ত্রণ করে। এই ছয়টি বোর্ড নিয়ে আল হাইয়্যাতুল উলিয়ালিল জামিয়াতুল কাওমিয়া বাংলাদেশ গঠন করা হবে। এটাই হবে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড। এর কার্যালয় হবে ঢাকায়। হাইয়্যাতুল উলিয়ালিল জামিয়াতুল কাওমিয়া বাংলাদেশের কমিটিতে ৯ ধরনের ব্যক্তি থাকবেন জানিয়ে শফিউল আলম বলেন, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের চেয়ারম্যান হবেন কমিটির সভাপতি। কো-চেয়ারম্যান হবেন বেফাকুল মাদারিসিলের সিনিয়র সহসভাপতি। বেফাকের আরও ৫ সদস্য, এটা পদাধিকারবলে বেফাকের মহাসচিব বা বোর্ড নির্ধারণ করে দেবে। এছাড়া কমিটিতে বেফাকুল মাদারিসিল কওমিয়া গওহরডাঙ্গার ২ সদস্য, আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিসিল কওমিয়ার ২ সদস্য, আযাদ দ্বীনি এদারায়ে তা’লিমের ২ সদস্য, তানজিমুল মাদারিসিল কওমিয়ার ২ সদস্য, জাতীয় দ্বীনি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বাংলাদেশের ২ সদস্য কমিটিতে থাকবেন। চেয়ারম্যান ইচ্ছা করলে কমিটিতে যে কোন সদস্য অন্তর্ভুক্ত করতে পারবেন। তবে সেই সংখ্যা ১৫ জনের বেশি হবে না। ইতোমধ্যে যত সনদকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে সবই এই আইন অনুযায়ী হয়েছে বলে গণ্য করা হবে বলে খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে। শফিউল আলম বলেন, আল হাইয়্যাতুল উলিয়ালিল জামিয়াতুল কাওমিয়া বাংলাদেশের অধীন বোর্ডগুলো আইনানুযায়ী গঠিত কমিটির মাধ্যমে নিবন্ধন কওমি মাদ্রাসাগুলো দারুল উলুম দেওবন্দের নীতি, আদর্শ ও নেসাব বা পাঠ্যসূচী অনুযায়ী দাওরায়ে হাদিস শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করবে। খসড়া আইনে কমিটির কার্যক্রম ও কার্যকাল সম্পর্কে বলা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এই কমিটি সনদ বিষয়ে যাবতীয় কার্যক্রমের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী বলে বিবেচিত হবে। এই কমিটির মাধ্যমে নিবন্ধিত মাদ্রাসাগুলো দাওরায়ে হাদিসের সনদ মাস্টার্স (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবী) সমমান বিবেচিত হবে। দাওরায়ে হাদিসের সিলেবাস প্রণয়ন, পরীক্ষা পদ্ধতি, পরীক্ষার সময় নির্ধারণ, অভিন্ন প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, উত্তরপত্র মূল্যায়ন, ফলাফল ও সনদ তৈরিসহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এক বা একাধিক উপকমিটি গঠন করতে পারবে। কমিটি বিষয়গুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জানাবে। এই কমিটির এক-তৃতীয়াংশ বা ১১ জনের উপস্থিতিতে কোরাম পূর্ণ হবে। এই কমিটি দলীয় রাজনীতির উর্ধে থাকবে বলেও খসড়া আইনে উল্লেখ করা হয়েছে। এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণে বিধি ও সংবিধি প্রণয়ন করা যাবে। কমিটিতে সরকারের কোন প্রতিনিধি নেই- এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, এটা আসলে কমিটি যেটা ছিল সেটাকে বোর্ড আকারে নিয়ে আসা হয়েছে। ছয়টি বোর্ডকে একীভূত করে বোর্ড করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যাফিলিয়েশন ছাড়া মাস্টার্স ডিগ্রী কীভাবে দেয়া হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে শফিউল আলম বলেন, এটা একটি ব্যতিক্রমী বিষয়। এটা হলো মূলত কওমি মাদ্রাসায় পড়ালেখা করা প্রায় ১৫ লাখ শিক্ষার্থীকে মূল ধারায় নিয়ে আসা। সরকারের এই কাঠামোতে নিয়ে আসার বিষয়টি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এরা কিন্তু সবাই সরকারের আওতার বাইরে। ইসলামিক আরবী বিশ্ববিদ্যালয় আছে। সনদ দেয়ার দায়িত্ব তাদের দেয়া যেত- এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, আইনে এ বিষয়ে কিছু বলা নেই, ভবিষ্যতে হয়ত বিবেচনায় আসতে পারে। মাস্টার্সের আগের ডিগ্রীগুলোর স্বীকৃতি না দিয়ে সর্বোচ্চ ডিগ্রীকে কেন স্বীকৃতি দেয়া হলো জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, এটা গবর্নমেন্টের পলিসি, আইনের বাইরে আমাদের ব্যাখ্যা দেয়ার সুযোগ নেই। ওখানে দাওরায়ে হাদিসটাকে চূড়ান্ত শিক্ষা সমাপনী হিসেবে গণ্য করা হয়। প্রধানমন্ত্রীকে হেফাজত আমিরের অভিনন্দন ॥ এদিকে আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদন করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন হেফাজত আমির ও আল-হাইয়াতুল উলইয়ার চেয়ারম্যান শাহ্ আহমদ শফী। দ্রুত সময়ের মধ্যে সংসদে আইন পাসের মাধ্যমে তা চূড়ান্ত হবে-এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে আহমদ শফী সোমবার এক বিবৃতিতে বলেন, বিশেষত কওমি মাদ্রাসা অনুসৃত মূলনীতি অক্ষুন্ন রাখা এবং কোন রকম প্রশাসনিক কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত রেখে মান দেয়ার ব্যবস্থা এগিয়ে নেয়ার প্রশ্নটিতে প্রধানমন্ত্রী পরিপূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ সিদ্ধান্ত যুগান্তকারী ও ঐতিহাসিক বলে মন্তব্য করে আহমদ শফী বলেন, এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশের কোরানী শিক্ষা ও কওমি অঙ্গনের অসংখ্য ছাত্র/ছাত্রী উপকৃত হবেন। দিনের তালিম, দাওয়াত, শিক্ষা বিস্তার, জাতির মানবিক ও নৈতিক সেবার ক্ষেত্রে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য এ মান দেয়ার বিষয়টি অনেক আনন্দদায়ক ও খুশির খবর। এর মাধ্যমে কওমি শিক্ষার্থীদের দ্বীনি খেদমতের পরিধি আরও বিস্তৃত হবে। আজকের এই অনুমোদনে সারাদেশের সর্বস্তরের আলেম ও শিক্ষার্থীরা আনন্দিত ও উৎফুল্ল।
×