ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পায়রা বিদ্যুত কেন্দ্রের আবাসন দক্ষিণ এশিয়ায় মডেল

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১৪ আগস্ট ২০১৮

পায়রা বিদ্যুত কেন্দ্রের আবাসন দক্ষিণ এশিয়ায় মডেল

রশিদ মামুন, পায়রা থেকে ফিরে ॥ বিদ্যুত কেন্দ্রের পাশের পিচ ঢালা রাস্তা দিয়ে নামতেই খেলার মাঠ। মাঠ পেরলেই স্কুল। পাশেই হাসপাতাল, মসজিদ, পুকুর। পুকুরের পাশে সেই রাস্তা বয়ে চলেছে যার দুই ধারে সারি সারি চার চালা সেমিপাকা টিনশেড ঘর। ঘরগুলোতে লেগেছে বিদ্যুতের তার। রয়েছে লিভিং রুম, ডাইনিং, ড্রয়িং, ব্যালকনি এমনকি স্টোর রুম। ঘরের সামনে এক চিলতে উঠান। রাস্তার দু’ধারে গড়ে তোলা হয়েছে পয়নিষ্কাসন ব্যবস্থা। মানুষের জলের সঙ্কট মেটাতে প্রতি দুটি পরিবারের জন্য একটি করে নলকূপ বসানো হয়েছে। এই হচ্ছে পায়রা তাপ বিদ্যুত কেন্দ্রের ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য আবাসন প্রকল্পর চিত্র। বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের জন্য গ্রামের যে সকল সরল মানুষ নিজেদের ভিটে মাটি দিয়েছে তাদের টেকসই উন্নতির কথা মাথায় রেখে আবার বসতি ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। যাকে বাংলাদেশে তো বটেই দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ‘মডেল আবাসন’ প্রকল্প হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। প্রায় সব কাজ শেষে উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকা আবাসন প্রকল্পে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে উচ্ছাস দেখা গেছে। এদের সকলেই বলছেন নিজের চোখকে বিশ্বাস হয় না। মাঝে মধ্যে অবিশ্বাস্য মনে হয়। প্রাপ্তির আনন্দ এদের হারানোর যন্ত্রণাকে ভুলিয়ে দিয়েছে। সব কাজ শেষ এখন ঘরে উঠবার পালা, চাবি বুঝিয়ে দেয়ার পালা। কবে আসবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এমন প্রশ্নে নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এ এম খোরশেদুল আলম বলেন, আমরা আশা করছি সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এই আবাসন প্রকল্পের চাবি ক্ষতিগ্রস্তদের হাতে তুলে দেবেন। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি বোধ তৈরি হবে। সরকার শুধু নেয় না। তার চেয়ে বহুগুণ ফিরিয়ে দেয়। এতে সাধারণ মানুষ উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য জমি দিতে উৎসাহী হবেন। আর দেশের উন্নতি হলে এই সব প্রান্তিক মানুষের ভাগ্যও বদলে যাবে। তিনি ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা জানিয়ে বলেন, এখানের স্কুলটি আমরা নিজেরা পরিচালনা করব। জোর দেয়া হবে কারিগরি শিক্ষার প্রতি একই সঙ্গে চাকরির সুযোগ রয়েছে এমন কিছু দেশের ভাষাও তাদের শেখানো হবে। তিনি জানান, আমাদের কেন্দ্রের জন্য যেসব শ্রমিক দরকার তাদের এখানেই তৈরি করা হবে। পাশাপাশি দেশের বাইরেও বিদ্যুত কেন্দ্রে কাজ করতে পারেন এমন দক্ষ শ্রমিকের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। যাদের পায়রাতে সম্ভব হবে না তাদের বিদেশে চাকরির সুযোগ করে দেয়া হবে। সাধারণত কোন সরকারী প্রকল্পের জন্য জমি নেয়া হলে জমি, বাড়ি এবং অন্যান্য ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে বাড়ি করার জন্য জমিও দেয়া হয়। কিন্তু এভাবে আধুনিক আবাসন কেউ এর আগে করে দেয়নি। আধুনিক গ্রামের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো যাতে উন্নত জীবন পায় সেজন্য সব আয়োজনই করে দিচ্ছে তাপ বিদ্যুত কেন্দ্র। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ৪৮ বিঘা জমির ওপর এই পুনর্বাসন পল্লীর সব ঘরের নির্মাণ কাজ শেষ। দু’টি ডিজাইনে করা হয়েছে এই সেমিপাকা ঘরগুলো। যেসব পরিবারের ২০ শতকের বেশি জমির বসতি নষ্ট হয়েছে তাদের জন্য সাড়ে সাত শতক জমিতে ১২শ’ বর্গফুট আয়তনের ৮২টি এবং যাদের কম ক্ষতি হয়েছে তাদের জন্য সাড়ে পাঁচ শতক জমিতে এক হাজার বর্গফুট আয়তনের ৪৮টি ঘর করা হয়েছে। সব ঘরগুলো এল টাইপের। দখিনমুখো। এই ঘরের প্রত্যেকটিতে ১৫ দশমিক সাত ফুট আয়তনে বাথরুমসহ একটি মাস্টার বেডরুম ছাড়াও আরও দুইটি ১৫ ফুট আয়তনের বেডরুম রয়েছে। ১০ দশমিক চার ফুট আয়তনের একটি ডাইনিংরুম। ১২ দশমিক দুই ফুটের রান্নাঘর। এছাড়া একটি কমন বাথরুম রয়েছে। সামনের বরান্দা লোহার গ্রিল দিয়ে আটকানো রয়েছে। প্রত্যেকটি ঘরের সামনে একটি খালি জায়গা থাকছে যেখানে শাক-সবজির আবাদ কিংবা গবাদিপশুসহ হাঁস-মুরগি পালনের সুযোগ থাকছে। পুনর্বাসন পল্লীতে ৩৬ হাজার ৯২৯ এবং ২৪ হাজার ৫৫৪ বর্গফুট আয়তনের দুটি পুকুর খনন করা হয়েছে। যার উত্তর-দক্ষিণ দিকে প্রশস্ত সান বাঁধানো ঘাট রয়েছে। পাশে রাখা হয়েছে বেঞ্চ। এই পল্লীতে নিরাপদ পানির জন্য ৪৮টি গভীর নলকূপ বসানো হয়েছে। আধুনিক দ্বিতল মসজিদের কাজ শেষ হয়েছে। ২৩ শতক জমিতে করা হয়েছে মসজিদ। দ্বিতল কমিউনিটি সেন্টারের নির্মাণ কাজও শেষ হয়েছে। এর নিচতলায় থাকবে ক্লিনিক। রাখা হয়েছে খেলার মাঠ। চারটি দোকান করার মতো স্পেস নিয়ে একটি শপিং সেন্টার করা হয়েছে। রয়েছে ঈদগাঁ মাঠ। একটি স্কুল ভবন করা হয়েছে। যেখানে কারিগরি শাখার অগ্রাধিকার থাকছে। ভেতরের পানি নিষ্কাশনের সাড়ে চার কিমি ড্রেনসহ ভেতরের ১২ ফুট প্রস্থ দুই দশমিক সড়ক করা হয়েছে। একটি নির্দিষ্ট কবরস্থান করা হয়েছে। দূর থেকে দেখা এই পল্লী এখন নজরকাড়ে অন্যদেরও। সার্বক্ষণিক বিদ্যুত সুবিধা থাকছে। ইতোমধ্যে বিদ্যুত সংযোগ দেয়া হয়েছে। আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল তাপ বিদ্যুত কেন্দ্রটি নির্মাণ করতে গিয়ে বসতভিটা হারানো ইব্রাহিম গাজী বলছিলেন আমরা কেউ ভাবতেও পারিনি এমন এক পরিকল্পিত আবাসনে থাকার সুযোগ পাব। এমন দৃষ্টিনন্দন মসজিদ, পাকা রাস্তা, মার্কেট, কমিউনিটি সেন্টার, খেলার মাঠ, পুকুর, স্কুল সব কিছুই নির্মাণ করা হয়েছে। এখন আমাদের কাছে হস্তান্তরের পালা। দীর্ঘদিন পর বাড়ি ফেরার আনন্দে আত্মহারা এখানের সাবাই। তাদের অপেক্ষার প্রহর শেষের দিকে। ক্ষতিগ্রস্ত আবু মৃধা জানালেন, তাদের এই প্রাপ্তি অপ্রত্যাশিত ছিল। যখন সব কিছু ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল তখন খুব খারাপ লেগেছে। কিন্তু এখন এসে ভাল লাগছে। তিনি জানান, তাদের গ্রামে আগে মাটির রাস্তা ছিল বর্ষায় এ দিকটাতে আসাই যেত না। এখন পাকা রাস্তা হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে। বিদ্যুতের কথা তাদের চিন্তার মধ্যেও ছিল না। কিন্তু সেই অবস্থা এখন বদলে গেছে। নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানিসূত্রে জানা গেছে, এখান থেকে উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুত বিক্রি থেকে তিন পয়সা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জীবনমানের উন্নয়নে ব্যয় করা হবে। এখানের কারিগরি স্কুলে প্রশিক্ষণ দিয়ে বিদ্যুত কেন্দ্রে কাজ দেয়া হবে। ফলে শুধু থাকা নয় জীবন চালানো নিয়েও কোন চিন্তা থাকবে না। আবুল কালাম মাস্টার জানান, দুই বছর বাড়িঘর জমিজমা হারিয়ে মানবেতর কষ্ট করেছি। এখন পুনর্বাসনের পল্লীর কাজ সম্পন্ন হতে দেখে স্বস্তি এসেছে মনে। তবে তার পরামর্শ এ পল্লীর সঙ্গে মূল ওয়াপদা সড়কের সংযোগ সড়কটি দ্রুত করা প্রয়োজন। এছাড়া এখন কর্মহীন, বর্ষাকাল। শুকনো মৌসুমে পল্লী উদ্বোধন করলে সবার সুবিধা হতো। এছাড়া তার দাবি পল্লীর বাসিন্দাদের দক্ষতা ভিত্তিক কর্মসংস্থানও করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত এসব পরিবারগুলো ২০১৬ সাল থেকে বাড়ি ঘর ছেড়ে যায়। এক সময় উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল এদের এখন সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে। কিছুদিনের মধ্যেই নিজের ঘরটিতে অবস্থান করে স্থায়ী মালিকানার বাস্তবতার স্বাদ পেতে যাচ্ছেন। পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ধানখালী ইউনিয়নের নিশানবাড়িয়া মৌজার ১৩০টি পরিবার শীঘ্রই উঠবেন এই গ্রামে।
×