ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বায়ু বিদ্যুত উৎপাদনে নতুন সম্ভাবনা পায়রা ॥ উইন্ড ম্যাপিংয়ে সুদিনের আভাস

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ১৩ আগস্ট ২০১৮

   বায়ু বিদ্যুত উৎপাদনে নতুন সম্ভাবনা পায়রা ॥ উইন্ড ম্যাপিংয়ে সুদিনের আভাস

রশিদ মামুন, পায়রা থেকে ফিরে ॥ বায়ু বিদ্যুত উৎপাদনের বড় আশা জাগাচ্ছে পটুয়াখালীর পায়রা। বায়ু মানচিত্র বা উইন্ড ম্যাপিংয়ের শুরুতেই বায়ু বিদ্যুতে পায়রা সুদিনের আভাস দিচ্ছে। বাংলাদেশে সব চেয়ে বেশি বাতাসের গতিবেগ রয়েছে পায়রায়। উইন্ড ম্যাপিংয়ের শুরুর দিনগুলোর ফলাফল বিশ্লেষণ করে বলা হচ্ছে ৫০ থেকে ১০০ মিটার উচ্চতায় বায়ু প্রবাহের গতি প্রতি সেকেন্ডে আট থেকে ১৩ মিটার। বাংলাদেশের মধ্যে যাকে সর্বোচ্চ হিসেবেই বিবেচনা করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে বায়ু বিদ্যুত উৎপাদনের সম্ভাবনারই জানান দিচ্ছে এই চিত্র। জীবাশ্ম জ্বালানি (ফসিল ফুয়েল) দ্রুত ফুরিয়ে আসায় সারাবিশ্ব এখন বিকল্প চিন্তা করতে শুরু করেছে। সমুদ্র উপকূল এবং সমুদ্রের ২০ কিলোমিটারের মধ্যেও বায়ু বিদ্যুত উৎপাদন করছে উন্নত বিশ্ব। সেখানে বাংলাদেশ অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে। সরকার সম্প্রতি দেশের কিছু এলাকায় উইন্ড ম্যাপিংয়ের কাজ শেষ করেছে। কিন্তু এখনও বায়ু বিদ্যুতের বড় কোন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়নি। ইউরোপীয় দেশগুলো ব্যাপকভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিদ্যুত উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছে। এর মধ্যে বায়ু জল এবং সৌর বিদ্যুত উৎপাদনকে গুরুত্ব দিচ্ছে উন্নত বিশ্ব। প্রতিবেশী দেশ ভারতও তাদের দেশে ৩২ হাজার মেগাওয়াট বায়ু বিদ্যুত উৎপাদনের প্রকল্প গ্রহণ করেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে এক হাজার ২০০ কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকা রয়েছে। সেখানে বায়ু বিদ্যুত উৎপাদনের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও কাজে লাগানো যাচ্ছে না। বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি বলছে, পায়রা বিদ্যুত কেন্দ্রের মধ্যে ৫০ মেগাওয়াটর বায়ু বিদ্যুত উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে তারা কাজ করছে। মূলত এ কারণেই উইন্ড ম্যাপিং করা হচ্ছে। তবে এত ভাল ফল পাওয়া যাবে তা কেউ আশা করেনি। পায়রা বিদ্যুত কেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক এবং প্রধান প্রকৌশলী শাহ আব্দুল মওলা বলেন, আমরা এখানে ভাল ফল পাচ্ছি। তবে এই প্রক্রিয়ায় এক বছরের বায়ু প্রবাহের গড় চিত্র রেকর্ড করা হচ্ছে। এরপরই চূড়ান্ত ফলাফল বিশ্লেষণ করা সম্ভব হবে। পায়রাতে উইন্ড ম্যাপিংয়ের জন্য যে টাওয়ার বসানো হয়েছে তাতে ১০০ থেকে ১২০ মিটারের মধ্যে ১৩ মিটার/সেকেন্ড, ৮০ মিটার উচ্চতায় ১১ মিটার/সেকেন্ড এবং ৫০ মিটার উচ্চতায় ১০ মিটার/সেকেন্ড বায়ুর গড় প্রবাহ রেকর্ড করা হয়েছে। এক সময় মনে করা হতো বাংলাদেশে বায়ু বিদ্যুত উৎপাদন সম্ভব না। তবে এই ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে। আমেরিকার ন্যাশনাল রিনিউয়েবল এনার্জি ল্যাবরেটরি (এনআরইএল) বলছে, বাংলাদেশের উপকূলে অন্তত ১০ হাজার মেগাওয়াট বায়ু বিদ্যুত উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। দেশের নয়টি স্থানের ২৪ থেকে ৪৩ মাসব্যাপী বায়ু প্রবাহের যে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ওই তথ্য পর্যবেক্ষণ করে এনআরইএল। এনআরইএল পর্যবেক্ষণে বলছে, বাংলাদেশের নয়টি এলাকার বাতাসের গড় গতিবেগ ৫ থেকে ৬ মিটার/সেকেন্ড। বায়ু বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের জন্য যাকে আদর্শ বলছে মার্কিন প্রতিষ্ঠানটি। সাধারণত ২ দশমিক ৩ থেকে ২ দশমিক ৫ মিটার/সেকেন্ড হলেই বায়ু বিদ্যুত উৎপাদন করা সম্ভব সেক্ষেত্রে বিদ্যুতের দাম বেশি পড়ে। কিন্তু ৫ থেকে ৬ মিটার/সেকেন্ড বাতাসের গতিবেগ হলে বিদ্যুত উৎপাদন অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক করা সম্ভব। এখন আধুনিক প্রযুক্তি এসেছে একটি টারবাইন দিয়ে ৬ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করা সম্ভব। সেখানে পায়রায় ৫০ থেকে ১০০ মিটার উচ্চতায় বাতাসের এই গতি দ্বিগুণ। পটুয়াখালীর পায়রায় সন্তোষজনক ফল পেলে পায়রার উপকূল ঘেষে শত শত উইন্ড মিল স্থাপন করা যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শক্তি বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক সাইফুল হক বলেন, এটা বাংলাদেশের জন্য একটি সুখবর। এমন বাতাসের পকেট পাওয়া গেলে সেখানে উইন্ড ফার্ম অর্থাৎ এক জায়গাতে অনেকগুলো উইন্ড মিল বসানো যাবে। আমরা অনেক দিন ধরেই বায়ু বিদ্যুতের চিন্তা করছিলাম কিন্তু ম্যাপিং না থাকায় অগ্রসর হওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। সৌর এবং বায়ু বিদ্যুত উৎপাদনের প্রধান পার্থক্য হচ্ছে দিনে রাতে সব সময়ই বায়ু বিদ্যুত পাওয়া যায়। অন্যদিকে দেশে গড়ে সাড়ে ৪ চার ঘণ্টার বেশি সৌর বিদ্যুত পাওয়া সম্ভব নয়। মোটামুটি দেশে নবেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি বায়ু প্রবাহ কম থাকায় বিদ্যুত উৎপাদন কম হয়। বাকি আট মাস দিন রাতে বায়ু বিদ্যুত উৎপাদন সম্ভব। বিদ্যুত কেন্দ্রের ব্যয় হিসেবে বায়ু বিদ্যুত উৎপাদনে মেগাওয়াট প্রতি ১৫ থেকে ১৬ কোটি টাকা প্রয়োজন হয়। অন্যদিকে তেল ও গ্যাস চালিত বিদ্যুত উৎপাদনে মেগাওয়াট প্রতি ৮ কোটি টাকা, কয়লায় ১২ কোটি টাকা এবং সোলারে ১১ কোটি টাকা প্রয়োজন হয়। তবে সুবিধা হচ্ছে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিদ্যুত উৎপাদন খরচ একেবারে কম। এখানে জ্বালানি ব্যয় শূন্য। কেবল রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ে কেন্দ্র পরিচালনা করা যায়। পায়রার পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এ এম খোরশেদুল আলম বলেন, আমরা ৫০ মেগাওয়াটের উইন্ড মিল স্থাপন করব। তবে শুরুতে আড়াই মেগাওয়াটের চারটি উইন্ড মিল স্থাপন করা হবে। তিনি বলেন, আমাদের ম্যাপিংয়ের কাজ শেষ হলেও অন্যরাও এই তথ্যর ভিত্তিতে উপকূলীয় এলাকায় বায়ু বিদ্যুত উৎপাদন করতে পারে। যা দেশের জন্য বড় সুফল বয়ে আনবে। এর আগে দেশের ৯টি স্থানে টাওয়ার স্থাপন করে বায়ু প্রবাহর তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এক বছর থেকে ৪৩ মাস পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়। নয়টি স্থানের মধ্যে ২০১৪ সালে ৫টি এবং ২০১৫ সালে ৪টি টাওয়ার স্থাপন করা হয়। টাওয়ারগুলোর মধ্যে ৪৩ মাস ধরে নাটোরের লালপুরের বায়ু প্রবাহের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। সেখানে ৮০ মিটার উচ্চতায় বাতাসের একটানা গতিবেগ পর্যালোচনা করা হয়। একইভাবে ৪৩ মাস ধরে চাঁদপুর সদরের জাফরাবাদে টাওয়ার স্থাপন করে বায়ু প্রবাহের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। সেখানে ৬০ মিটার উচ্চতায় টাওয়ার স্থাপন করা হয়েছিল। ২০১৪ সালের জুলাই মাসে কক্সবাজারের ইনানি বিচে স্থাপন করা টাওয়ার দিয়ে ৪০ থেকে ২০০ মিটার পর্যন্ত বাতাসের অবস্থা পর্যালোচনা করা হয়। এখানে ১২ মাসের গতিবেগ পরীক্ষা করা হয়। সীতাকু-ে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ৮০ মিটারের একটি টাওয়ার স্থাপন করা হয়। সেখানে ২৪ মাস ধরে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। একই সময়ে পার্কি বিচে একই উচ্চতার একটি টাওয়ার স্থাপন করা হয়। সেখানে ৩৬ মাস ধরে পরীক্ষা চলে। বদরগঞ্জে ২০ থেকে ২০০ মিটারের নানা ধরনের টাওয়ার স্থাপন করা হয়। ২০১৫ সালের আগস্টে স্থাপন করা এইসব টাওয়ার থেকে ২৪ মাসের তথ্য নেয়া হয়। একই সময়ে ময়মনসিংহের গৌরিপুর এলাকায় ৮০ মিটারের টাওয়ার স্থাপন করে ২৯ মাসের তথ্য নেয়া হয়। হবিগঞ্জের মধুপুর চা বাগারে ২০১৫ সালের অক্টোবরে ৮০ মিটার উচ্চতার টাওয়ার স্থাপন করা হয়। সেখানে ২৬ মাস ধরে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। একই সময়ে খুলনার দাকোপে ৮০ মিটার উচ্চতার টাওয়ার স্থাপন করা হয়। এটিও ২৬ মাস ধরে তথ্য বাছাই করা হয়েছে। ৯টি স্থান থেকে তথ্য যাচাই-বাছাই করে সংগ্রহ করা হয়েছে। সাউন্ড ডিটেকটিভ এ্যান্ড রেঞ্জিং (এসওডিএআর) পদ্ধতিতে এইসব তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তথ্য বাছাইয়ের পর মডেলিং ওয়ার্কের কাজ করে এনআরইএল। এনআরইএল-এর প্রকল্প পরিচালক মার্ক জ্যাকবসন বলছেন, বাংলাদেশের বায়ুর প্রবাহ বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য উপযোগী। স্বাভাবিকভাবে দেশের উপকূলীয় এলাকায় ১০ হাজার মেগাওয়াট বায়ু বিদ্যুত উৎপাদন সম্ভব। তবে এর পরিমাণ উপকূলে বাড়িয়ে ২০ হাজার মেগাওয়াট করা যেতে পারে। আর সারাদেশে বায়ু বিদ্যুত উৎপাদনের পরিকল্পনা নিলে ৮২ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত তা বৃদ্ধি পেতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশের কুতুবদিয়া ও ফেনীতে বায়ু বিদ্যুতের দুটি পাইলট প্রকল্প চালু আছে। কুতুবদিয়ায় এক মেগাওয়াট করে দুটি এবং ফেনীতে এক মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি কেন্দ্র রয়েছে। তবে এই পাইলট প্রকল্প দুটিই অনেক আগের পুরাতন প্রযুক্তির।
×