ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

জাদুঘরে প্রদর্শনের প্রস্তুতি

সিংহ মূর্তি ও কারুকাজ খচিত পালঙ্ক, ভাওয়াল রাজার বলে ধারণা

প্রকাশিত: ০৫:০২, ১৩ আগস্ট ২০১৮

সিংহ মূর্তি ও কারুকাজ খচিত পালঙ্ক, ভাওয়াল রাজার বলে ধারণা

মোরসালিন মিজান ॥ চন্দন পালঙ্কে শুয়ে একা একা কি হবে/জীবনে তোমায় যদি পেলাম না...। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় গেয়েছিলেন। কালজয়ী বাংলা গানে আমরা খুঁজে পাই চন্দন কাঠের পালঙ্ক। সাবিনা ইয়াসমিন দুঃখকেই ‘বাসর রাতের পালঙ্ক’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। সোনার পালঙ্কের কথাও কম শোনা যায়নি। এই যেমন- সোনার পালঙ্কের ঘরে, লিখে রেখে ছিলেম দ্বারে,/যাও পাখি বলো তারে, সে যেন ভুলে না মোরে...। হ্যাঁ, গান কবিতায় রূপকথা গল্পে এমন আরও অনেক পালঙ্কের কথা এসেছে। তবে পিতলেরও যে পালঙ্ক হয়, খুব একটা জানা ছিল না। তাই প্রথম দেখায় বেশ অবাক হতে হলো। বিশাল পালঙ্ক। পুরোটাই পিতলের। পিতলের বটে। সোনার মতো রং। চকচক করছিল। যেখানে আপাতত রাখা হয়েছে সেটি জাতীয় জাদুঘরের স্টোররুম। প্রায়ান্ধকার স্টোররুমটিতে কেমন যেন আলো ছড়াচ্ছিল পুরনো পালঙ্ক। শুধু পুরনো নয়। বহু কালের পুরনো। তবে ঘষে মেজে এটিকে নতুনের মতো করা হয়েছে। অচিরেই দেখা যাবে জাদুঘরের গ্যালারিতে। কারণ এই যে, পালঙ্কটি ভাওয়াল রাজার স্মৃতি নিদর্শন বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। আছে নিদর্শনের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যও। অবিভক্ত ভারতবর্ষের বাংলা প্রদেশের ভাওয়াল এস্টেট বর্তমানের ময়মনসিংহ ও ঢাকা জেলার কিছু অঞ্চল নিয়ে গঠিত। অনেকেরই জানা, ভাওয়াল পরগনার রাজা ভাওয়াল এবং তার বংশধররা বিচিত্র কারণে বিপুল আলোচনার বিষয় হয়ে ছিলেন। চমকিত হওয়ার মতো কত ইতিহাস, গল্প এবং রূপকথার যে জন্ম দিয়েছেন তারা। সেই ভাওয়াল রাজা বা রাজকুমারদের কেউ একজন পালঙ্কটি ব্যবহার করেছিলেন বলে প্রাথমিক তথ্য পেয়েছে জাতীয় জাদুঘর। এ ছাড়া পুরনো পিতলের পালঙ্ক এ অঞ্চলের মানুষের আভিজাত্য উন্নত রুচি ও শয্যাবিলাসের সংস্কৃতিকে তুলে ধরে। অনেক হাত বদলের পর জাদুঘরের সংগ্রহে আসা পালঙ্কটি দেখে মুগ্ধ হতে হয় এখনও। পালঙ্কের দিকে তাকাতেই চোখ চলে যায় সিংহমূর্তিগুলোর দিকে। চার পায়ার নিচের দিকে চারটি সিংহমূর্তি। মেঝে ছুঁয়ে আছে। মুখে অদ্ভুত হুঙ্কার। হুঙ্কারের কারণেই বেশ জীবন্ত মনে হয়। একইসঙ্গে এ হুঙ্কার পালঙ্ক ব্যবহারকারীর শৌর্য-বীর্যের কথা ঘোষণা করে। সিংহমূর্তিগুলোর মস্তকের ওপর চারটি পিলার। এসব পিলারে ভর দিয়ে আছে মূল কাঠামো। চার কোনা কাঠামোর গায়ে কারুকাজ করা হয়েছে। শিরাণার কথা আলাদা করে বলতে হবে। এর পুরোটা জুড়েই কারুকাজ। সেই কবে কোন কালে ধাতু গলিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে লতা পাতা ফুলের নক্সা। এসবের ঠিক মাঝখানে গোলাকার ফ্রেমে বাঁধানো আয়না। আয়নাতে ওই মুখ দেখবে যখন...। কত জনই না এ আয়নাতে মুখ দেখেছেন! পালঙ্কের বিপরীত অংশে সাতটি দ-। পাশাপশি দাঁড় করিয়ে দেয়া দ-ে কলসের মোটিফ ব্যবহার করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা আসমা ফেরদৌসী জানান, পালঙ্কটির দৈর্ঘ্য ২২০ সেমি। প্রস্থ ১৭১ সেমি। ওজনও পরিমাপ করা হয়েছে। মোট ৩০ মণ। ১১ লাখ ৯০ হাজার টাকা ব্যয়ে জাদুঘর পালঙ্কটি কিনেছে বলে জানান তিনি। সংগ্রহের গল্পটিও বেশ মজার। ১৯৮৫ সালে পালঙ্কটি ঢাকায় নিলামে বিক্রি করা হয়। তখন বরিশাল থেকে গাড়ি কিনতে রাজধানীতে এসেছিলেন জনৈক জালাল উদ্দীন। তিনি পালঙ্কটি দেখে এত মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, গাড়ির পরিবর্তে পালঙ্ক কিনে নিয়ে বাড়ি ফেরেন। নিজের হাটখোলা সড়কের বাড়িতে এটি স্থাপন করেন তিনি। শুরু হয় ব্যবহার। ক্রমেই বিশেষ বৈশিষ্ট্য ম-িত পালঙ্কটির কথা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। প্রতিবেশীরা দারুণ কৌতূহল নিয়ে দেখতে আসেন। এভাবে বেশ কয়েক বছর কেটে যায়। কিন্তু গত প্রায় ৮ বছর আগে মৃত্যুবরণ করেন সৌখিন জালাল উদ্দীন। পিতার মৃত্যু হলে পালঙ্কের মালিকানা সন্তানদের হয়। সন্তানদের একজন ফরিদা ইয়াসমিন। ঢাকার উত্তারায় থাকেন। বরিশালে তাদের তেমন যাওয়া হয় না। পালঙ্কটির ওজন বেশি হওয়ায় ঢাকায়ও স্থানান্তর করতে পারেননি। এ অবস্থায় মলিন হতে থাকে পালঙ্কের রং। একটি পা দানি ছিল। হারিয়ে যায়। এরই একপর্যায়ে পালঙ্কটি সংগ্রহ করে জাতীয় জাদুঘর। এর পর কনজারভেশন ল্যাবে অনেকদিন রেখে পূর্বের ঔজ্জ্বল্য ফেরানোর চেষ্টা করা হয়। এখন তাই মোটামুটি নতুনের মতো লাগছে। এ সম্পর্কে জাতিতত্ত্ব ও অলঙ্করণ শিল্পকলা বিভাগের কিপার নূরে নাসরিন জনকণ্ঠকে বলেন, পালঙ্কটির বিস্তারিত আমরা এখনও জানতে পারিনি। তবে বিক্রেতার দেয়া তথ্য মতে, এটি ভাওয়াল রাজার স্মৃতি নিদর্শন। বিস্তারিত গবেষণা শেষে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে বলে জানান তিনি। জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক আব্দুল মান্নান ইলিয়াসও গবেষণার মাধ্যমে বিস্তারিত তথ্য অনুসন্ধানের ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, আমাদের গ্যালারিতে পালঙ্কের একটি সমৃদ্ধ সংগ্রহ রয়েছে। কাঠের কারুকার্য খচিত একাধিক পালঙ্ক বাঙালীর রুচি ও শিল্পবোধের পরিচয় বহন করে। এগুলোর সঙ্গে এবার যুক্ত হচ্ছে পিতলের পালঙ্কটি। এর ফলে সংগ্রহটি আরও সমৃদ্ধ হবে। সব ঠিক থাকলে ২৪ নম্বর গ্যালারিতে পালঙ্কটি প্রদর্শিত হতে পারে বলে জানান তিনি।
×