ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মৎস্য উৎপাদনে সফল বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৭:০০, ১২ আগস্ট ২০১৮

মৎস্য উৎপাদনে সফল বাংলাদেশ

মৎস্য উৎপাদনে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে বাংলাদেশে। জানা গেছে, ২০২২ সাল নাগাদ বিশ্বে যে চারটি দেশ মাছ চাষে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, তার শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশের নাম। বাংলাদেশের পরিবেশ মিঠা পানির মাছ চাষের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান। দেশের জনগণ নিজেদের প্রয়োজনে মাছ চাষের প্রচলিত ধারণা থেকে সরে এসেছেন। নিজেদের পুকুরের মাছ খাওয়ার পাশাপাশি বাজার থেকে মাছ কেনার প্রবণতা বেড়েছে ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (আইএফপিআরআই) সর্বশেষ সমীক্ষা অনুযায়ী উৎপাদিত মাছের ৭৫ শতাংশই এখন বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করছেন মাছ চাষীরা। বাংলাদেশ সরকার ভিশন ২০২১-এ দেশের মাছের উৎপাদন ৪৫.০ লাখ টন নির্ধারণ করা হয়েছে যা বর্তমান উৎপাদনের চেয়ে ১০ লাখ টন বেশি। মিঠা পানির মাছ উৎপাদনের বিপুল সম্ভাবনার পাশাপাশি সামুদ্রিক মাছ আহরণের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। সমুদ্রে মাছ আহরণের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ২৫তম। বঙ্গোপসাগরে ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি ছাড়াও প্রায় ৫০০ প্রজাতির অর্থকরী মাছ রয়েছে। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রজয়ে এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকায় মাছ ধরার আইনগত অধিকার পেয়েছে বাংলাদেশ। ফলে বঙ্গোপসাগর থেকে মৎস্য আহরণ পর্যায়ক্রমে বাড়বে। এক হিসাবে দেখা গেছে, প্রতিবছর অব্যবস্থাপনা ও অবহেলায় উৎপাদিত মাছের একটা বড় অংশ, প্রায় ১০ লাখ টন নষ্ট বা অপচয় হয়ে যায়। এটা রোধ করতে পারলে মাছ উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন সম্ভব হবে। . মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয় মাছ উৎপাদনে সাফল্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। দেশে প্রাণিজ আমিষের প্রায় ৬০ শতাংশ যোগান দেয় মাছ। ২০১৫ ও ২০১৭ সালে বিশ্বে পঞ্চম থেকে চতুর্থ স্থান অর্জন করে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ২০১৮ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয়ে মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয়। বাংলাদেশের আগের দুটি অবস্থানে রয়েছে চীন ও ভারত। দেশে মোট কৃষিজ আয়ের ২৩ দশমিক ৮১ শতাংশ আসে মৎস্য খাত থেকে। জিডিপিতে মৎস্য খাতের অবদান এখন তিন দশমিক ৫৭ শতাংশ। কৃষিজ জিডিপিতে এই খাতের অবদান ২৫ দশমিক ৩০ শতাংশ। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ১১ শতাংশের বেশি ১ দশমিক ৮২ কোটি মানুষ মৎস্য আহরণে সম্পৃক্ত। যার মধ্যে প্রায় ১৫ দশমিক ৫ লাখ নারী। . স্বয়ংসম্পূর্ণ মাছে দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নে মৎস্য সেক্টরের অবদান অসামান্য। ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ মাছে দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’ প্রতিপাদ্য ও স্লোগানে সরকারী-বেসরকারীভাবে দেশব্যাপী ২২-২৮ জুলাই ‘জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ-২০১৮’ উদযাপিত হয়েছে। সম্প্রতি মৎস্য অধিদফতরের সেমিনার হলে সংবাদ সম্মেলনে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র এক বিবৃতিতে বলেছেন, উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ায় দেশের মানুষ গড়ে ৬২ দশমিক ৫৮ গ্রাম মৎস্য গ্রহণ করছেন। জাটকা নিধন ঠেকাতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ায় ২০১৭-১৮ সালে প্রায় পাঁচ লাখ টন ইলিশ উৎপাদিত হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ২০১৭-১৮ সালে প্রায় ৬৯ হাজার টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রফতানি করে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়েছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান সরকারের যথাযথ উদ্যোগে ২০১৬-১৭ অর্থবছর ৬৮ হাজার ৩০৫ টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রফতানির মাধ্যমে আয় হয়েছে ৪ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা। এর আগে, ২০০৮-০৯ অর্থবছর দেশে মাছ উৎপাদন হয়েছিল ২৭ লাখ ৪১ হাজার টন। সরকারের উন্নয়নমুখী বহুবিধ উদ্যোগ ও সেবার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫-১৬ অর্থবছর মাছ উৎপাদন ৩৮ লাখ ৭৮ হাজার টনে উন্নীত হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা বেড়ে হয়েছে ৪০ লাখ ৫০ হাজার টন। আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের মধ্যেই বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারবে বলে প্রত্যাশা সরকারের। . ইলিশে নতুন আশা প্রতিবছরই বাড়ছে ইলিশের উৎপাদন। বিবিএস জরিপ অনুযায়ী, মাছের সামগ্রিক উৎপাদনে দেশে ইলিশের উৎপাদন বাড়ার প্রভাবও পড়ছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল পাঁচ লাখ টন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৮৬-৮৭ সালে দেশে ইলিশ উৎপাদন হতো ১ লাখ ৯৫ হাজার টন। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৯৫ হাজার টন। দেড় দশকের ব্যবধানে এ সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে ২ লাখ টনে। ইলিশ রফতানির মাধ্যমে আসে দেড় শ’ থেকে তিন শ’ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ইলিশের অবদান ১ দশমিক ১৫ শতাংশ। যার অর্থমূল্য আনুমানিক সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা। ওয়ার্ল্ড ফিশের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বিশ্বের মোট ইলিশের ৬০ শতাংশ উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। এছাড়া ভারতে ২০ শতাংশ, মিয়ানমারে ১৫ শতাংশ এবং আরব সাগর, প্রশান্ত মহাসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগরের তীরবর্তী দেশগুলোতে বাকি ৫ শতাংশ ইলিশ ধরা পড়ে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা অনুযায়ী, ১০ বছর আগে দেশের ২১টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যেত। বর্তমানে ১২৫টি উপজেলার নদ-নদীতে এই মাছ পাওয়া যাচ্ছে। . উৎপাদন বৃদ্ধিতে নতুন আশা মাছের উৎপাদন-সাফল্য উৎসাহজনক হলেও উৎপাদন সম্ভাবনা রয়েছে এর চেয়ে বহুগুণ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত এক দশকে মাছের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৫৫ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে লবণাক্ত পানিতে মাছের উৎপাদন ছিল ছয় লাখ ৯৭ হাজার টন, মিঠা পানির মাছের উৎপাদন ছিল ৩৩ লাখ ২০ হাজার টন। আবার মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ সরকারের ভিশন ২০২১-এ দেশের মাছের উৎপাদন ৪৫ লাখ টন নির্ধারণ করা হয়েছে, যা বর্তমান উৎপাদনের চেয়ে ১০ লাখ টন বেশি। বিবিএসের সর্বশেষ অর্থনৈতিক শুমারি অনুযায়ী দেশে গড়ে মাছের বার্ষিক উৎপাদন সাড়ে ৩৫ লাখ টন। যার বাজারমূল্য প্রায় ৫৩ হাজার কোটি টাকা। . সম্ভাবনাময় ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষ চাঁদপুর জেলার ডাকাতিয়া নদীতে থাইল্যান্ডের প্রযুক্তি অনুকরণে ২০০২ সাল থেকে চাঁদপুরের ডাকাতিয়া নদী ও লক্ষ্মীপুর জেলায় মেঘনা নদীর রহমতখালী চ্যানেলে সাড়ে চার শ’ এবং পাঁচ শ’ খাঁচায় মনোসেক্স তেলাপিয়া করা হচ্ছে; যা থেকে উৎপাদিত হচ্ছে বছরে ৭০০ টন রফতানিযোগ্য তেলাপিয়া। আনুমানিক ৭৫০ বছর আগে চীনের ইয়াংঝি নদীতে খাঁচায় মাছ চাষ শুরু হয়। . রফতানি আয়ের অবারিত দিগন্ত মৎস্য উৎপাদন ও রফতানিতে নতুন আশাবাদে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মাছের ফেলে দেয়া অংশ দিয়ে তৈরি স্যুপ বিক্রি হচ্ছে পূর্ব এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের নামী-দামী রেস্তরাঁয়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, অপ্রচলিত এই পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ বছরে আয় করছে শত কোটি টাকা। ইউরোপসহ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এসব অপ্রচলিত পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। রফতানিকারকদের সূত্রে জানা যায়, কার্প জাতীয় মাছের আঁশ, চিংড়ির মাথা ও খোসা, কাঁকড়ার খোলস, মাছের বায়ু থলি, হাঙ্গরের লেজ, ডানা, চামড়াসহ বিভিন্ন পণ্য বাংলাদেশ থেকে রফতানি হচ্ছে- ইতালি, জাপান, কোরিয়া, চীন, জার্মানি, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, হংকংসহ বিভিন্ন দেশে। বাংলাদেশ থেকে চীন ও ভিয়েতনামে প্রতি মাসে প্রায় ১০০ টন চিংড়ির খোসা, মাথা এবং প্রায় ৫০ টন কাঁকড়ার খোলস রফতানি হয়। এছাড়া কোরাল, লাক্কা, ঘোড়া মাছ, আইড়, বোয়াল, কামিলা, রুই, কাতলাসহ বিভিন্ন মাছের বায়ু থলি রফতানি হচ্ছে ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। বাংলাদেশ থেকে গড়ে প্রতি মাসে ১০০ টন মাছের ফোৎনা রফতানি করে আয় করছে ২০ লাখ ডলার। এ ছাড়া প্রায় ২০০ টন মাছের আঁশ রফতানি হচ্ছে ইতালি, জার্মানি, কোরিয়া, চীন ও ভিয়েতনামে। প্রতি মাসে গড়ে ৮টি কন্টেইনারে প্রায় ৮০ টন হাঙ্গর জাত পণ্য রফতানির মাধ্যমে আয় হচ্ছে প্রায় ১৫ লাখ ডলার।
×