ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

‘সংগ্রামপুঞ্জিতে’ একদিন

প্রকাশিত: ০৬:৫৭, ১২ আগস্ট ২০১৮

  ‘সংগ্রামপুঞ্জিতে’ একদিন

আসিফ হাসান রাজু ॥ ছন্দরাজ কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তর ‘ঝর্ণার গান’ কবিতার মাধ্যমে ঝর্ণার রূপ ও চলার গতি সম্পর্কে জানার সৌভাগ্য হয়েছিল। ঝর্ণার চঞ্চল পা পুলকিত ও গতিময়। ঝর্ণা স্তব্ধ পাথরের বুকে এঁকে দেয় আনন্দের পদচিহ্ন। পাহাড় থেকে চঞ্চল ও আনন্দময় পদধ্বনিতে নেমে আসে সাদা জলরাশির ধারাময় ঝর্ণা। চমৎকার এর ধ্বনিমাধুর্য ও বর্ণবৈভব। এই জলধারার যে সৌন্দর্য ও অমিয় স্বাদ তা তুলনারহিত। গিরি থেকে পতিত এই অম্বুরাশি পাথরের বুকে আঘাত হেনে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে যে অপূর্ব সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে তা সত্যি মনোমুগ্ধকর। সেই সৌন্দর্যেকে উপভোগ করতে আমরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাবের সাতজন কলম সৈনিক মিলে ছুটে গিয়েছিলাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সিলেটের জাফলং আর মায়াবী ঝর্ণা ‘সংগ্রামপুঞ্জিতে’। আমাদের সিলেট ভ্রমণের যাত্রা শুরু হয়েছিলো ট্রেনের মাধ্যমে। রাজশাহী থেকে যাত্রা শুরু করে ঢাকা হয়ে আমরা সিলেটে পৌছায়। যাবার পথে ট্রেনের উপর পুরোটা সময় ছিল আমাদের আনন্দ আর উল্লাসে কাটানো। বেসুরে গান, গল্প এবং হাসি-তামাশা আর সঙ্গে ট্রেনের ঝঁকঝঁক শব্দ, হাওড়ের মাঝ দিয়ে ছুটে চলা ট্রেন আর হাওড় পেরিয়ে ট্রেন লাইনের দু’পাশে সবুজ চায়ের বাগান সঙ্গে উঁচু উঁচু টিলা আমাদের ভ্রমণ আনন্দকে আরও বেশি মাত্রা যোগ করেছিল। প্রথমত, আমাদের যাত্রার উদ্দেশ্য ছিল সারাদেশ থেকে সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাবের আয়োজনে ক্যাম্পাস জার্নালিজম ফেস্ট ২০১৮ তে যোগ দেয়া। দু’দিনব্যাপী এ মিলনমেলা শেষ করে আমরা বেরিয়ে পড়ি সৌন্দের্যের লীলাভূমি সিলেটের উল্লেখযোগ্য পর্যটন কেন্দ্র জাফলংয়ে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। সেই ছোটবেলা থেকে বোনা স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে শুরু হয় আমাদের ছুটে চলা। সিলেট শহর থেকে একটা লেভুনা গাড়ি ভাড়া করে আমরা ছুটে চললাম জাফলংয়ের পথে। জাফলংয়ের পথে চলতে চলতে চোখে পড়ে আকাশ ছোঁয়া উঁচু উঁচু পাহাড়। দূর থেকে দেখলে এই পাহাড়গুলো মনে হয় আকাশ আর পাহাড় আকাশ মিশে গেছে। তার ওপর দিয়ে ভেসে চলেছে সাদা মেঘরাশি। রাস্তার পাশে চায়ের বাগান সঙ্গে অনেকটা পথ জুড়েই সারি সারি পাহাড় আর মেঘের খেলার এ দৃশ্য যে কাউকে মুগ্ধ করবে। পাহাড়ের গাঁ বেয়ে একটু পর পরই ঝরনার মতো বেয়ে পড়া সাদা রঙের জলের ধারা বেয়ে পড়ছে আর সেই জলের ধারা পাহাড়ের পাদদেশে অবিরাম ছুটে চলেছে। এ দৃশ্যপট মনে করিয়ে দেয় জীবনানন্দের রূপসী বাংলার কথা। এ দৃশ্য অবলকন করতে করতে আমরা সিলেট শহর থেকে ভোলাগঞ্জে যাবার পর পৌঁছে গেলাম বাংলাদেশ সীমানার শেষ প্রান্তে ভারতের খাসিয়া জৈন্তীয়া পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত, প্রকৃতি কন্যা হিসাবে খ্যাত সিলেটের জাফলংয়ে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি এই জাফলং। এর অদূরেই ছিল ধলাই নদীর উজানে অবস্থিত পৃথিবীর সর্বাধিক বৃষ্টিবহুল এলাকা চেরাপুঞ্জি। ওপারে খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়, এপারে নদী। পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে চলছে ঝরনা, আর নদীর বুকে স্তরে স্তরে সাজানো নানা রঙের নুড়ি পাথর। এখানেই শেষ নয় সমতল চা-বাগান, খাসিয়া পল্লী, পানেরো বরজ-কী নেই জাফলংয়ে! সিলেটের জাফলংকে সেজন্য হয়ত বলা হয়ে থাকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। প্রকৃতি যেন নিজ হাতে সাজিয়েছে ভারতের সীমান্তঘেঁষা দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এই জনপদকে। জানা যায় আশির দশকের দিকে ব্যবসায়ীরা পাথরের সন্ধানে নৌপথে জাফলং যেত। কিন্তু আমাদের জাফলং যাত্রা ছিল জাফলংয়ের নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের যে কথা শুনে এসেছি সেই পিপাসা মেটাতে। এখানে পিয়াইন নদীর তীরে স্তরে স্তরে বিছানো পাথরের স্তূপ জাফলংকে করেছে আরও আকর্ষণীয়। সীমান্তের ওপারে ভারতীয় পাহাড়ি টিলা, ডাউকি পাহাড় থেকে অবিরাম ধারায় প্রবাহমান জলপ্রোপাত, ঝুলন্ত ডাউকি ব্রিজ, পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ হিমেল পানি, উঁচু পাহাড়ে গহীন অরণ্য প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দিচ্ছিল ছোটবেলায় বইয়ের পাতায় পড়া সেই অদেখা প্রাকৃতিক লীলাভূমি বর্ণনার কথা। স্রষ্টা কি অপরূপ মায়ায় না সৃজন করেছে এ ভূমিকে? শুধু পাহাড়, ঝর্ণা আর নদীতে সীমাবদ্ধ নয় জাফলংয়ের সৌন্দর্য। জাফলংয়ের সৌন্দর্যের আলাদা মাত্রা যোগ করেছে সেখানকার আদিবাসীদের জীবনধারা। নদী পার হলেই খাসিয়াপুঞ্জি। এখানে গেলে দেখা মিলবে সমতল থেকে ৩-৪ ফুট উঁচুতে বিশেষভাবে তৈরি খাসিয়াদের ঘর। তাদের পান পাতা সংগ্রহ ও খাঁচা ভর্তি করার অভিনব দৃশ্য যে কারো নজরকাড়ে। এ দৃশ্য অবলকন শেষে নয়নাভরিাম পাহাড় বেয়ে পড়া মায়াবী ঝর্ণা ‘সংগ্রামপুঞ্জিতে’ নিজেদের কে ভিজিয়ে অতৃপ্ত মনকে সুপ্ত করে আমাদের সিলেট ভ্রমণের সার্থকতা খুঁজে পায়।
×