ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

রুকাইয়া খান অনামিকা

বেঁচে থাকুক বন্ধুত্ব

প্রকাশিত: ০৬:৫০, ১২ আগস্ট ২০১৮

বেঁচে থাকুক বন্ধুত্ব

বন্ধু মানে কি? আদৌ কি বন্ধুত্বের কোন সংজ্ঞা আছে? নাকি আছে কোন ধর্ম, গোত্র, বয়স বা সময়ের কোন সীমারেখা? প্রশ্নগুলোর উত্তর আপেক্ষিক, একেক জনের কাছে একেক রকম। ধারণা করা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে মজবুত এবং দৃঢ় সম্পর্কগুলোর অন্যতম এই বন্ধুত্বের সম্পর্ক। উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের একটা বিখ্যাত উক্তি রয়েছে এই বিষয়ে, ‘কাউকে সারাজীবন কাছে পেতে চাও? তাহলে প্রেম দিয়ে নয় বন্ধুত্ব দিয়ে আগলে রাখ। কারণ প্রেম একদিন হারিয়ে যাবে কিন্তু বন্ধুত্ব কোন দিন হারায় না’ প্রত্যেকটা দিনই বন্ধু দিবস, তবুও আগস্ট মাসের প্রথম রবিবারকে সামগ্রিকভাবে পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশে বন্ধু দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ১৯৫৮ সালে প্যারাগুয়েতে প্রথম বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপন করা হয়। এটি একটি আনুষ্ঠানিকতার দিন। বন্ধুদের হাতে ফ্রেন্ডশিপ ব্যান্ড বেঁধে, চকোলেট, কার্ড, ছোটখাটো উপহার বিনিময় করে দিনটি উদযাপন করে সকল বয়সী বন্ধুরা। এটি একটি আনন্দের দিন। অবশ্য বন্ধু দিবস কি বা বন্ধুত্ব ব্যাপার না কি এসব বোঝার অনেক আগে থেকেই এই সম্পর্কে আমরা জড়িয়ে যাই। একদম ছোটবেলার খেলার সাথী হোক কিংবা স্কুলে পাশাপাশি বসা সহপাঠী আমরা বন্ধু বলতে প্রথমেই খুঁজি তাদের। একজন মানুষকে বন্ধুত্বের কথা বলতেই সর্বপ্রথম তার মনে পড়ে যায় ছোটবেলার সেই নিখাঁদ বন্ধুকে অনেক বছর পরেও যার সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক আগের মতই থেকেই যায়। স্কুল কলেজের বন্ধুত্বে থাকে অনেকটা আশ্বাস। দিনের পর দিন যাদের সঙ্গে পরিচয়ে ভাবতে হয় না কিছুই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুত্বে থাকে অনেকটা আকস্মিকতা। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে নতুন মোড় নিয়ে আসে, এখানে এসে জীবন শুরু হয় নতুনভাবে। ক্যাম্পাসের পরিসর ও ব্যাপ্তি বিশাল হওয়ায় বন্ধুত্বে কোন বাধা থাকে না। সাধারণত একই মানসিকতা বা একই রুচির মানুষ এর মাঝে বন্ধুত্ব হলেও ক্যাম্পাসে এসে এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। কয়েকজন বন্ধু একসঙ্গে চলতে ফিরতে থাকলেও তাদের মাঝের ভিন্নতাগুলোও চোখে পরার মতো। আর সত্যিকার অর্থে ক্যাম্পাস জীবনের বন্ধুত্বের সৌন্দর্যটাই এখানে। ভিন্নতাগুলোই বন্ধুত্বকে গাঢ় করে। ক্লাসে সহপাঠীদের সঙ্গে বন্ধুত্বের শুরুটা হয়ে যায় অজান্তেই। প্রত্যেকদিন তাদের সঙ্গে ক্লাস করা, একই সঙ্গে বসা, আড্ডা, ক্লাসটেস্ট বা প্রেজেন্টেশন দেয়া এসবই বন্ধুত্বের শুরুটা বুঝিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে বন্ধুগুলো আপন মানুষ হয়ে ওঠে পরীক্ষার সময় নোট দেয়া-নেয়ায়, প্রেজেন্টেশনের গ্রুপে বা এসাইনমেন্ট কপি করতে গিয়ে। সহপাঠীর নামগুলো এভাবেই কাছের বন্ধুর তালিকায় আসতে থাকে। তাদের ছাড়া যেন আড্ডাগুলো তখন আর জমে না। হলে থাকতে গিয়ে বা বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনে কাজ করতে গিয়ে পরিচয় হয় নিজের বিভাগ ছাড়াও অন্য বিভাগের ছোট-বড় বা সমবয়সীদের সাথে। ধীরেধীরে পরিসর বেড়ে যায়। পরিচয় থেকে এর রূপ বন্ধুত্বে চলে আসে। বিশ্ববিদ্যালয় এর বিশাল পরিসরে স্বাভাবিকভাবেই ছাত্রছাত্রী দের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ এ সঙ্কীর্ণতার জায়গা বেশ কম। এখানে বন্ধুত্বের রংটা রংধনুর মতো। অনেক ভিন্নতা, ব্যক্তিত্বের বৈপরীত্য সবকিছুর উর্ধে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অনেক সময় এই সম্পর্কে আসে প্রেম, ভালবাসা। যেন আরও নতুন রঙের সমাগম। এবার যদি আসি ক্যাম্পাসে বন্ধু দিবস পালনের কথায় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই মতের বন্ধু পাওয়া যাবে। একপক্ষ মত দেয়, বন্ধু দিবস প্রতিদিনের এই একটা দিনের আনুষ্ঠানিকতা কেন? আরেকপক্ষ বলে একদিন বন্ধুদের জন্য উৎসর্গ করে কার্ড, ফুল, চকোলেট বিনিময়ে সমস্যাটা কোথায়? সে আপনি যে দলেরই অন্তর্ভুক্ত হোন না কেন, বন্ধুত্বের মায়া কমে যাবে না। ক্যাম্পাসে অবশ্য বন্ধু দিবস এর উদযাপন লক্ষ্য করা যায়। অনেকে মিলে আড্ডার ফাঁকে গিটারে ‘তোরা ছিলি, তোরা আছিস, জানি তোরাই থাকবি’ সবার গলা ছেড়ে গেয়ে ওঠা, কেক এনে কেটে বিলি করা যদি ও কেকের বেশিরভাগ অংশই একে অন্যের মুখে লাগিয়ে দিয়েই আসল উদযাপন শুরু হয়। ক্যাম্পাসের বন্ধুত্বের আরেক উদযাপন চলে ছাত্রছাত্রীদের হলগুলোতে। হলের বন্ধুত্ব আত্মার সম্পর্কে রূপ নেয়। ক্যাম্পাসের ৪/৫ বছরের জীবনে সবসময় পাশে থাকে যারা তারাই তো প্রকৃত বন্ধু। বিপদে আপদে, অসুখে বিসুখে এরাই তো থাকে পাশে। কোন একদিন ক্লাস থেকে ফিরতে দেরি হওয়ায় ক্ষুদা নিয়ে যখন আর রান্না করতে ইচ্ছা করে না হলের বড় আপু বা ছোট বোন বা বান্ধবীর থালাতে করে যতœ করে খাবার সাজিয়ে আনাটাই খাঁটি ভালবাসা, সহজ বন্ধুত্ব। বা ছেলেদের হলে নিম্নবিত্ত ছেলেটি যখন কোন সেমিনারে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও টাকা না থাকায় যেতে পারে না, বড় ভাই বা বন্ধু হাতে এসে টিকিটটা ধরিয়ে যখন সঙ্গে যেতে বলে এর নামটাকেই তো বন্ধুত্ব বলে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সেøাগানে যখন মুখরিত ক্যাম্পাস তখন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলা মানুষটাই বন্ধু। মাসের শেষে নিজের চলার অসুবিধা হলেও বন্ধুকে টাকা ধার দেয়াটাই বন্ধুত্ব, কোন অনুষ্ঠানে বান্ধবীর শাড়ি আরেকজনের পরাটাই বন্ধুত্ব। ক্যাম্পাসের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে বন্ধুত্ব। খেলার মাঠে প্রতিপক্ষ হয়ে খেলার পর মাঠ থেকে বেড়িয়ে বন্ধুকে অভিনন্দন জানানোটাকে বন্ধুত্ব বলে। মঞ্চে বন্ধুর নাটক দেখে অভিনয়ে মুগ্ধ হওয়াকে বন্ধুত্ব বলে। একজনের সাফল্যে আরেকজনের গর্বিত হওয়াকে বন্ধুত্ব বলে। বন্ধুত্বের সংজ্ঞাগুলো এভাবেই আসে। বন্ধুত্বের রং রূপ সবার কাছে সব সময় এক না। ক্যাম্পাসের অনেক বন্ধুত্ব প্রেমের সম্পর্কে গড়িয়ে যায়। ব্যর্থতা সফলতা মিলিয়ে হতে থাকে সেসবের পরিণতি। আবেগ অনুভূতি মিশিয়ে চলতে থাকে বন্ধুত্বের আরেক রূপ। দেখা মেলে এক নতুন দিকের। প্রকৃত বন্ধুত্ব স্কুল কলেজে পাওয়া যায়, বিশ্ববিদ্যালয় এ না- এমন কথা কম বেশি অনেকেই শুনেছি বা বলেছি। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই আমাদের চোখের সামনে এমন অনেক মুখ ভেসে আসবে যাদের স্বার্থহীন বন্ধুত্ব আমাদের এই কথার ব্যতিক্রম ভাবতে বাধ্য করবে। সারাজীবন সম্পর্ক থেকে যায় এমন সম্পর্কগুলো ক্যাম্পাসে বিরল নয়। এর এক উদাহরণ আমরা বিভিন্ন বিভাগের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে প্রাক্তনদের আন্তরিক উপস্থিতি, পুরনো স্মৃতি রোমন্থনে দেখতে পাই। আমাদের একবিংশ শতাব্দী তো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের স্বর্ণযুগ, বন্ধুত্বের ব্যাপ্তি এই সকল জায়গাতেও সমানভাবে বিস্তৃত। তাই দূরে চলে গেলেও এখন বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ অনেকটাই সহজ। বন্ধুত্বে আছে ভালবাসা, আছে মনোমালিন্য। ভুল বোঝাবুঝি বা খারাপ লাগা থেকে অনেক সময় অনেক সুন্দর সম্পর্কগুলো নষ্ট হয়ে যায়। ক্যাম্পাসের এই টানাপোড়েন আসে কমবেশি সবার জীবনেই। চলার পথে ছিটকে পড়ে অনেক পরিচিত মুখ। ক্যাম্পাসে বন্ধু দিবস উদযাপন এ আনুষ্ঠানিকতার চেয়ে আন্তরিকতা থাকে বেশি। না ডেকেও বিপদে-আপদে, আনন্দ, উৎসব এ যেসব পরিচিত প্রাণের মানুষগুলোর সরব উপস্থিতি তারা জীবনের ক্যানভাসে এঁকে দেয় একজন মানুষ এর সবচেয়ে সুন্দর সময়ের ছবিটি। এখানেই থাকে ক্যাম্পাসের বন্ধুত্ব উদযাপন এর প্রকৃত সৌন্দর্য।
×