ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আওয়ামী লীগ চায় বিজয় ধরে রাখতে, বিএনপি ঘুরে দাঁড়াতে

প্রকাশিত: ০৫:১৭, ১২ আগস্ট ২০১৮

 আওয়ামী লীগ চায় বিজয় ধরে রাখতে, বিএনপি ঘুরে দাঁড়াতে

জালাল চৌধুরী, চাঁদপুর থেকে ॥ একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে জমে উঠেছে ইলিশের জেলা চাঁদপুরের নির্বাচনী রাজনীতি। পদ্মা-মেঘনা-ডাকাতিয়া নদীর তীর ঘেঁষা জেলাটির পাঁচটি নির্বাচনী আসনই সম্ভাব্য প্রার্থীদের পদচারণায় সরগরম হয়ে উঠেছে। সময় যতই ঘনিয়ে আসছে পুরো জেলাতেই নির্বাচনী হাওয়া ততই বাড়ছে। এই পাঁচটি আসনে বড় দলগুলো থেকে কে কে প্রার্থী হচ্ছেন এ নিয়ে মানুষের মধ্যে চলছে আলোচনার ঝড়। নির্বাচনকে সামনে রেখে বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে চলছে নানামুখী উত্তাপ ও উত্তেজনা। প্রার্থিতা নিয়ে পাঁচটি আসনেই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগে তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্ব থাকলেও এবার প্রার্থী বাছাই নিয়ে তেমন কোন সঙ্কট হবে না বলেই দলীয় নেতাকর্মীদের অভিমত। অন্যদিকে বিএনপির অভ্যন্তরীণ বিবাদ ও সাংগঠনিক ভগ্নদশার কারণে প্রত্যেক মনোনয়ন প্রত্যাশীরাই ভুগছেন স্নায়ু উত্তেজনায়। দশম জাতীয় নির্বাচনে জেলার ৫টি আসনেই আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে অপরদিকে বিএনপি আসনগুলো পুনরুদ্ধার করতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে বলে নিজ দলীয় নেতা কর্মীরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। চাঁদপুর-১ (কচুয়া) ॥ এ আসনটি একটি পৌরসভা ও ১২টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর। তিনি ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর টেকনোক্রেট কোটায় পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী হন। ২০০৮ ও পরবর্তীতে ২০১৪ সালে দুবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই কচুয়ার উন্নয়নের নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন। বিশেষ করে অবহেলিত কচুয়ার প্রতিটি প্রান্তে ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন তিনি। যার কারণে মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে আগামী ১শ বছরেও তাঁর অবদানের কথা কচুয়াবাসী স্মরণ রাখবে বলেও মনে করেন দলটির নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। এই উন্নয়ন ধরে রাখার স্বার্থে আবারও ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর এমপিকে প্রার্থী হিসেবে পেতে আগ্রহী তারা। নির্বাচনকে সামনে রেখে তিনি সপ্তাহের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দিন নির্বাচনী এলাকায় ছুটে আসছেন। যোগ দিচ্ছেন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড ও সভা সমাবেশে। অন্যদিকে উপজেলা আওয়ামী লীগের একাংশের নেতাকর্মীদের পছন্দের তালিকায় রয়েছেন এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ও সচিব আলহাজ মোঃ গোলাম হোসেন। দীর্ঘদিন ধরেই দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশায় এলাকায় ভোটারদের সঙ্গে সাক্ষাতের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকা-ে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন। তিনি নিজ এলাকায় প্রতি সপ্তাহে নেতাকর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাত ও সভা সমাবেশ, কর্মিসভা করে নৌকায় ভোট চাচ্ছেন। তিনিও এ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী। অন্যদিকে ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আ ন ম এহসানুল হক মিলন বেশ কিছু মামলার আসামি হয়ে দেশ ছেড়ে বর্তমানে বিদেশে অবস্থান করছেন। বিএনপি দলীয় নেতাকর্মীরা মনে করেন, সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ও বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক আ ন ম এহসানুল হক মিলনের বিকল্প নেই। অন্যদিকে দলের দুর্দিনে ও এহসানুল হক মিলনের অনুপস্থিতিতে মালয়েশিয়া শাখা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও বিএনপি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মোঃ মোশাররফ হোসেন দলীয় নেতাকর্মীদের সার্বিক খোঁজখবর ও মনোনয়ন প্রত্যাশায় পোস্টার লিফলেট ও অন্যভাবে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। দুর্দিনে তৃণমূল নেতাকর্মীদের খোঁজ খবর রাখায় তিনি ধানের শীষ প্রতীকে মনোনয়ন পাবেন বলে তাঁর সমর্থকরা মনে করেন। এছাড়াও উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক পৌর মেয়র মোঃ হুমায়ুন কবির প্রধানও আগামী নির্বাচনে দলের মনোনয়ন চাইবেন বলে জানান। সম্প্রতি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রায়কে কেন্দ্র করে তিনি জেল খেটেছেন। এছাড়া উপজেলা বিএনপির সহ-সভাপতি, প্রকৌশলী আহম মনিরুজ্জামান দেওয়ান মানিক বিএনপি দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশায় দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় প্রচার ও বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন। এ ছাড়াও আ ন ম এহসানুল হক মিলনের স্ত্রী এবং মহিলা দলের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল সংসদের সাবেক সহ-সভাপতি (ভিপি) নাজমুন নাহার বেবী, সাবেক সংসদ সদস্য মরহুম রফিকুল ইসলাম রনির স্ত্রী শামিমা আক্তার রনি, লন্ডন প্রবাসী বিএনপি নেতা মোহাম্মদ খোরশেদ আলম মজুমদারও এ তালিকায় রয়েছেন। এ আসনে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও কচুয়া উপজেলা জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক মোঃ এমদাদুল হক রুমন ও একক মনোনয়ন প্রত্যাশায় দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় প্রচারের পাশাপাশি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে গণসংযোগ করছেন। চাঁদপুর-২ (মতলব উত্তর ও দক্ষিণ) ॥ মতলব উত্তর ও দক্ষিণ উপজেলা নিয়ে চাঁদপুর-২ আসন। এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য হচ্ছেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি দলটির অন্যতম মনোনয়ন প্রত্যাশী। উন্নয়নমূলক কর্মকা-ের বিবেচনায় অন্যদের চেয়ে তিনি সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে চাঁদপুর-২ ও ৩ আসনকে পুনঃসংস্কার করে মতলব উত্তর ও মতলব দক্ষিণ উপজেলাকে চাঁদপুর-২ আসনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর আগে ১৯৭৯ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত মতলব উত্তর ছিল চাঁদপুর-২ আসন। এ আসনে বিএনপির মরহুম নুরুল হুদা তিনবার এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ থেকে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া এমপি হয়ে নৌপরিবহনমন্ত্রী হন। একই সময়ে চাঁদপুর-৩ (মতলব দক্ষিণ) আসনে বিএনপি প্রার্থী আলম খান একবার ও জিএম ফজলু দ্বিতীয়বার এমপি ছিলেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে চাঁদপুর-২ আসনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয় এবং এ আসনে এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এম. রফিকুল ইসলাম এমপি হিসেবে নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। তিনি নিয়মিত নিজ এলাকায় চষে বেড়ালেও প্রতিপক্ষ বিএনপিতে নির্বাচনী তেমন একটা আমেজ নেই। তবে আ’লীগের পক্ষে কয়েকজন নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য প্রাক প্রস্তুতি হিসেবে নানা ধর্মীয় ও জাতীয় আচার-অনুষ্ঠান এবং বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকছেন। মতলববাসীর বহু প্রতিক্ষিত মতলব সেতু বাস্তবায়ন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার অনন্য অবদান। এছাড়া মেঘনার চরে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করার প্রচেষ্টাকেও সাধারণ মানুষ গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন। সর্বোপরি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় মানবপ্রাচীর দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রক্ষা করার বিষয়টিও এলাকার মানুষ শ্রদ্ধার চোখে দেখেন। তিনি ছাড়াও এ আসনে আওয়ামী লীগে মনোনয়ন লাভের দৌড়ে আলোচনায় রয়েছেন সাবেক সাংসদ এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এম রফিকুল ইসলাম ও ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এ্যাডভোকেট নূরুল আমিন রুহুল। এদিকে এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম কোন কারণে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে তিনি তাঁর ছেলে সাজেদুল হোসেন চৌধুরী দীপুর জন্য লবিং করবেন বলে জানা গেছে। কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের অর্থবিষয়ক সম্পাদক আমিরুল ইসলাম পাটওয়ারী খোকা মতলবের বিভিন্ন স্থানে মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছেন। অপরদিকে এ আসনে বিএনপিতে এখনও উত্তাপ না থাকলেও প্রস্তুতি চলছে। দলটির সংগঠনিক অবস্থা কিছুটা দুর্বল। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ড. জালাল উদ্দিন দলের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নিলেও নির্বাচিত হতে পারেননি। এবার দলের কেন্দ্রীয় নেতা ড. জালাল আহমেদ, জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও মতলব দক্ষিণ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এম এ শুক্কুর পাটওয়ারী, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ও ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এ্যাডভোকেট বোরহান উদ্দিন মোল্লা, সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্রদল নেতা মোস্তফা খান সফরী, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের তেজগাঁও এলাকার সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার ও ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোঃ আনোয়ারুজ্জামান আনোয়ার, জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ব্যারিস্টার ওবায়েদুর রহমান টিপু ও সাবেক সংস্থাপন প্রতিমন্ত্রী মরহুম নূরুল হুদার ছেলে তানভীর হুদার নাম শোনা যাচ্ছে। এ আসনে জাতীয় পার্টির সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে জাপার ভাইস চেয়ারম্যান এমরান হোসেন মিয়া ও জেলা জাপার আহ্বায়ক মোঃ মিজানুর রহমান খানের নাম শোনা যাচ্ছে। চাঁদপুর-৩ (সদর-হাইমচর) ॥ ‘ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর’ খ্যাত চাঁদপুর-৩ সংসদীয় আসনটি জেলার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ আসন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী মরহুম মিজানুর রহমান চৌধুরীর পর এ আসনে বরাবরই বিএনপির প্রার্থীরা জয়ী হয়ে আসছেন। দীর্ঘ প্রায় ৩৫ বছর পর আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি এ আসনটি পুনরুদ্ধার করেন। বিএনপির ঘাঁটি তথা ভোট ব্যাংক হিসেবে পরিচিত চাঁদপুর ৩ আসনটি ’৯১ থেকে ২০০১ সালের নির্বাচন পর্যন্ত ছিল তাদের দখলে। আ’লীগ দীর্ঘদিন ধরে তাদের এ আসনটি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেও বারবার হয়েছে ব্যর্থ। ১/১১ পূর্ব মুহূর্তে হঠাৎ করে বিএনপির এ ভোট ব্যাংকে দেখা দেয় ফাটল। আর এ ফাটলকে কাজে লাগিয়ে বিএনপির ভোট ব্যাংকে আঘাত হানে আ’লীগ। ফলে দীর্ঘ ৩৫ বছর পর জনমতের ভিত্তিতে চাঁদপুর-৩ আসনটি নিজেদের করে নেয় আ’লীগ। এ আসনটি কেন্দ্রীয় আ’লীগের বর্তমান যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি ৯ম সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হন। ডাঃ দীপু মনি এমপি নির্বাচিত হওয়ায় পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেন। স্বল্পসময়ে তিনি চাঁদপুর ও হাইমচরকে নদীভাঙ্গন থেকে প্রায় সাড়ে তিনশ’ কোটি টাকা ব্যয়ে চাঁদপুর ও হাইমচর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করে চাঁদপুর ও হাইমচরবাসীর দীর্ঘদিনের দুঃখ লাঘব ও এ নির্বাচনী এলাকার সবচেয়ে বড় সমস্যাটি সমাধান করেন। শুধু তাই নয়, চাঁদপুরে ১শ’ ৫০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ ও চাঁদপুর-লাকসাম রেলপথের কাজসহ বিভিন্ন দাফতরিক উন্নয়নমূলক কাজ দৃশ্যমান করেন। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দলীয় মনোনয়নে ফের নির্বাচিত হন ডাঃ দীপু মনি। তবে দীপু মনির বিপরীতে শক্ত অবস্থানে রয়েছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ও কেন্দ্রীয় আ’লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী। ইতোমধ্যে নির্বাচনী এলাকায় ব্যাপক জনমত গড়তে সক্ষম হয়েছেন তিনি। ২০০৮ সালে তিনি তৃণমূলের সর্বাধিক সমর্থন পেয়েও মনোনয়ন পাননি। এবারও দলীয় নেতা-কর্মীদের পূর্ণ সমর্থন ও জনমত তাঁর পক্ষেই রয়েছে বলে তিনি মনে করেন। তিনি চাঁদপুর ও হাইমচরে বিরামহীনভাবে নির্বাচনী প্রচার চালিয়ে নিজের শক্তিশালী অবস্থান জানান দিচ্ছেন। মাসের বেশির ভাগ সময়ে তিনি এলাকায় সময় দিচ্ছেন। বিভিন্ন মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাঁর অবদান রয়েছে বলে তিনি এসব এলাকার মানুষের কাছে ইতোমধ্যে প্রিয়মুখ হয়ে উঠেছেন। ফলে একাদশ সংসদ নির্বাচনে সুজিত রায় নন্দী মনোনয়ন পেতে পারেন বলেই দৃঢ় আশাবাদী তাঁর সমর্থকরা। এছাড়া সর্বমহলে ক্লিন ইমেজের রাজনৈতিক নেতা হিসেবে পরিচিত চাঁদপুর জেলা আ’লীগের সভাপতি ও চাঁদপুর পৌরসভার দুইবারের মেয়র নাছির উদ্দিন আহমেদও দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে আওয়ামী শিবিরে গুঞ্জন রয়েছে। এদিকে কেন্দ্রীয় মৎস্যজীবী লীগ নেতা আলহাজ রেদওয়ান খান বোরহান মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে দীর্ঘদিন নির্বাচনী প্রচার চালিয়ে আসছেন। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে টকশোতে অংশ নেয়ায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন চাঁদপুর-হাইমচর নির্বাচনী এলাকায়। এদিকে গত ৯ম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন সাবেক সংসদ সদস্য জিএম ফজলুল হক। ডাঃ দীপু মনির সঙ্গে নবম সংসদ নির্বাচনে তার পরাজয় ঘটে। এবার এ আসনে চাঁদপুর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক শেখ ফরিদ আহমেদ মানিক এখন শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি ইতোমধ্যে নিজের অবস্থান নিশ্চিত করতে জেলা বিএনপি এবং অঙ্গ-সংগঠনের মূল নেতৃত্বে তার অনুগত নেতাদের অন্তর্ভুক্ত করে বর্তমানে দলীয়ভাবে শক্ত অবস্থান সৃষ্টি করেছেন। এছাড়া তিনি তারেক রহমানের একান্ত বিশ্বস্ত বলে রাজনীতির মাঠে চাউর আছে। বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন যুবদলের সাবেক সভাপতি চাঁদপুর পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান শফিকুর রহমান ভূঁইয়া। কেন্দ্রঘোষিত কর্মসূচী বাস্তবায়নে তিনি জেলা বিএনপির আহ্বায়কের বাইরে স্বতন্ত্র অবস্থান নিয়ে একটি শক্তিশালী অবস্থান সৃষ্টি করেছেন। এছাড়া বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য এসএম কামাল উদ্দিন, ছাত্রনেতা মোস্তফা খান সফরী ও সংরক্ষিত আসনের সাবেক এমপি রাশেদা বেগম হীরাও মনোনয়ন প্রত্যাশী। এদিকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন মনোনয়ন প্রত্যাশী। গণফোরাম থেকে একক প্রার্থী হিসেবে জেলা সভাপতি ও চাঁদপুর আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এ্যাডভোকেট সেলিম আকবর নিয়মিত গণসংযোগ করে যাচ্ছেন। চাঁদপুর- ৪ (ফরিদগঞ্জ) ॥ চাঁদপুর জেলার ৫টি সংসদীয় আসনের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আসন হিসেবে চিহ্নিত ফরিদগঞ্জ আসনটি। ১৫টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা নিয়ে গঠিত। গত ৯ বছরে এ আসনে ভোটার বেড়েছে প্রায় ১ লাখ। তাই নতুন এই ভোটারাই আগামী নির্বাচনের জন্য টার্নিং পয়েন্ট হবে বলে বড় দুটি দলের ধারণা। এ আসনটিও একসময় বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত থাকলেও বর্তমানে এটি আওয়ামী লীগের দখলে। বর্তমানে আওয়ামী লীগ তাদের অবস্থান ধরে রাখতে চেষ্টা চালিয়ে আসছে আর বিএনপি চাইছে আসনটি পুনরুদ্ধার করতে। অন্যদিকে ২০১৪ সালে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগ এই আসনটি পাওয়ায়, সেই ধারাবাহিকতায় এবারও তারা আটঘাট বেঁধে নামছেন। এ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের অধিকাংশই নিয়মিত চষে বেড়াচ্ছেন নির্বাচনী মাঠ। গত নির্বাচনে এই আসনে প্রথমে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে জাতীয় পার্টির মাইনুল ইসলামকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল। এ সময় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন জমা দিয়েছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি ড. মোহাম্মদ শামছুল হক ভূঁইয়া। পরে জাপা প্রার্থী মাইনুল ইসলামের মনোনয়ন বাতিল হলে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে ৪১ বছর পর সেখান থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন দলের জাতীয় পরিষদের সদস্য ড. মোহাম্মদ শামছুল হক ভুঁইয়া। এর আগে চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি থাকার সুবাদে তিনি ফরিদগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগসহ সকল অঙ্গসংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে মাঠ চষে বেড়িয়েছিলেন। এমপি হওয়ার পর সেই চষে বেড়ানোটা বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। সপ্তাহে শুক্র ও শনিবার ছাড়াও দলীয় ও বিভিন্ন কর্মসূচী থাকলে অন্যদিনও ছুটে আসেন নির্বাচনী এলাকায়। সেই ধারাবাহিকতায় আগামী সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাবেন বলে তাঁর সমর্থিত নেতাকর্মীরা আশাবাদী। অন্যদিকে বিগত ২০০১ ও ২০০৮ সালে এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ও বিশিষ্ট সাংবাদিক মুক্তিযোদ্ধা মুহাম্মদ শফিকুর রহমান। সর্বশেষ জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি হিসেবে বিজয়ী হয়ে শেখ হাসিনার আস্থা অর্জন করায় ব্যক্তিগতভাবে একজন সৎ ও আদর্শবান হিসেবে পরিচিত এই সাংবাদিক নেতা ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত তাঁর নির্বাচনী এলাকায় সুখে-দুঃখে মানুষের পাশে থেকেছেন। এছাড়া সম্প্রতি সরকার মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অত্যন্ত সম্মানজনক সিনেট সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন শফিকুর রহমান। ২০০১ সালের পর বিএনপি-জামায়াত জোটের আমলে দলের নির্যাতিত নেতাকর্মীদের পাশে থেকে তাদের সহযোগিতা করেছেন। এমন একজন সজ্জন ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক নেতা আবারও দলীয় মনোনয়ন পাবেন বলে বিশ্বাস করেন তাঁর সমর্থকরা। তরুণ উদীয়মান নেতা হিসেবে মনোনয়ন প্রত্যাশী চাঁদপুর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এ্যাডভোকেট জাহিদুল ইসলাম রোমান। সাবেক গণপরিষদ সদস্য ও চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি এ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম পাটওয়ারীর সন্তান হিসেবেও পুরো উপজেলায় রয়েছে আলাদা জনপ্রিয়তা। জেলা আওয়ামী লীগের জনসংখ্যা ও স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ও জেলা বিএমএ সাবেক সভাপতি ডাঃ হারুন অর রশীদ সাগরও মনোনয়ন প্রত্যাশী। এছাড়া কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সদস্য সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী এ্যাডভোকেট নূর হোসেন বলাই, বিএমএর কেন্দ্রীয় নেতা ডাঃ এ কে এম মোস্তফা হোসেনসহ অনেকেই দলীয় মনোনয়ন চাইবেন বলে জানা গেছে। অন্যদিকে ১৯৯১ সালে যুবদল নেতা হিসেবে মনোনয়ন পাওয়া মরহুম আলমগীর হায়দার খান টানা চারবার এমপি নির্বাচিত হয়ে এলাকায় বড় ভোট ব্যাংক তৈরি করেছিলেন। যার ফল হিসেবে ২০০৮ সালের নির্বাচনের অল্পদিন আগে মাঠে নেমে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হয়ে আলোড়নের সৃষ্টি করেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক ব্যাংকিং ও রাজস্ব বিষয়ক সম্পাদক ও বর্তমান উপজেলা বিএনপির সভাপতি লায়ন মোঃ হারুন অর রশীদ। এছাড়াও বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসাবে রয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোতাহের হোসেন পটাওয়ারী, বৃহত্তর কুমিল্লা আইনজীবী কল্যাণ সমিতির সভাপতি এ্যাডভোকেট আব্বাস উদ্দিন, জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক দলের কেন্দ্রীয় সভাপতি হুমায়ুন কবির বেপারী, বিশিষ্ট শিল্পপতি ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান এম এ হান্নান। জাতীয় পার্টি থেকে ইতোমধ্যে গ্রিনসিগন্যাল পেয়ে মাঠে নেমেছেন জাতীয় পাটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির তথ্য, গবেষণা ও আইসিটি সম্পাদক মনিরুল ইসলাম মিলন। এছাড়া জাপার কেন্দ্রীয় যুবসংহতির কৃষি বিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা মহানগর উত্তর যুব সংহতির সাবেক সহ-সভাপতি হারুন অর রশীদও মনোনয়ন চান। এদিকে বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল বাসদ (খালেকুজ্জামান) জেলা নেতা আলমগীর হোসেন দুলাল ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় নেতা আল্লামা মুকবুল হোসাইন নিজ নিজ দল থেকে মনোনয়ন চাইবেন বলে জানান। চাঁদপুর-৫ (হাজীগঞ্জ-শাহরাস্তি) ॥ হাজীগঞ্জ-শাহরাস্তি দুই উপজেলা নিয়ে চাঁদপুর-৫ আসন। এ আসনের হেভিওয়েট প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর (অব) রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম। তিনি পূর্ব অবস্থান ধরে রেখে নিজেকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিরলসভাবে কাজ করছেন। একাত্তরের রণাঙ্গনের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিকের রয়েছে দেশব্যাপী পরিচিতি। তবে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে মনোনয়ন নিয়ে একাধিক প্রার্থিতার কারণে কিছুটা বিভেদেও সৃষ্টি হয়েছে। এ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপ-কমিটির সাবেক সহ-সম্পাদক, জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা সদস্য ও বঙ্গবন্ধু টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার্স এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার সফিকুর রহমান দীর্ঘদিন থেকে বঞ্চিত নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়িয়ে মাঠ পর্যায়ে স্থান করে নিতে তাঁর কর্মকা- অব্যাহত রেখেছেন। এছাড়াও জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা সদস্য, পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ হোসাইন কয়েকটি দলীয় সভা ডেকে এ আসনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মাঝে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। অন্যদিকে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য এ্যাডভোকেট নুরজাহান বেগম মুক্তা নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তিনি চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, সাবেক সংসদ বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা আবু জাফর মোঃ মহিদ্দিনের কন্যা। তিনি যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর। তিনি উঠান বৈঠক, অসহায় নেতাকর্মীদের সহযোগিতা ও নিয়মিত সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা অব্যহত রেখেছেন। এ ছাড়াও আওয়ামী লীগ থেকে একেএম ফজলুল হক, অধ্যাপক আবদুর রশিদ মজুমদারসহ আরও কয়েকজন নেতা দৌড়ঝাঁপ দিচ্ছেন। দীর্ঘদিন বিএনপির হাতে থাকা আসনটি পুনরুদ্ধারে মরিয়া হয়ে উঠেছে বিএনপি। চাঁদপুর জেলার বিএনপির সাবেক সভাপতি হাজীগঞ্জ-শাহরাস্তির বিএনপির সমন্বয়ক ইঞ্জিঃ মমিনুল হক রাজনৈতিক মাঠ ধরে রেখেছেন। তিনি ছাড়াও সাবেক এমপি এমএ মতিন মনোনয়ন চাইবেন। এছাড়াও নতুন মুখ হিসেবে কেন্দ্রীয় সাবেক ছাত্রনেতা বিল্লাল হোসেন তারেক মনোয়নের জন্য কেন্দ্রে লবিং করছেন। এ আসনে ইঞ্জিনিয়ার মমিনুল হক শক্ত অবস্থানে রয়েছেন। গত নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে তিনি নির্বাচন করে পরাজিত হয়েছেন। এদিকে হাজীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ড. মোহাম্মদ আলমগীর কবির পাটওয়ারীও মনোনয়ন প্রত্যাশী। দলের দুর্দিনে হাল ধরে হাজীগঞ্জে বিএনপির একটি অবস্থানে ধরে রেখেছেন। এখানে জাতীয় পার্টি থেকে কেন্দ্রীয় জাতীয় পার্টির প্রচার সম্পাদক খোরশেদ আলম খুশু মনোনয়ন চাইবেন। এছাড়াও এ দল থেকে কাজী খায়রুল আলম পারভেজ, মির্জা গিয়াসউদ্দিনও মনোনয়ন চাইবেন।
×