ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দেশের প্রথম বড় বিদ্যুত কেন্দ্র উৎপাদনে আসার দিনক্ষণ ঠিক আগামী বছরের ১৯ এপ্রিল

নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন জেগেছে পায়রায় ॥ সমৃদ্ধ বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৫:১২, ১২ আগস্ট ২০১৮

 নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন জেগেছে পায়রায় ॥ সমৃদ্ধ বাংলাদেশ

রশিদ মামুন, পায়রা থেকে ফিরে ॥ পায়রা বিদ্যুত কেন্দ্রর প্রথম ইউনিটের বয়লার হাউসের মূল ইস্পাত কাঠামোর ৮৬ মিটারের মধ্যে ৮৪ দশমিক পাঁচ মিটারের কাজ শেষ হয়েছে। দিন রাত ২৪ ঘণ্টা খন্ড খন্ড ইস্পাত একটার সঙ্গে একটা জুড়ে নির্মাণ চলছে। বিদ্যুত কেন্দ্রের দৃশ্যমান এই অগ্রগতি দেখে যে কেউ ভাবতেই পারেন নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখাচ্ছে পায়রা বিদ্যুত কেন্দ্র। মাত্র দশ বছর আগের কথা একটি ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি থাকত সকলের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে। বিপুল আয়োজন এবং উৎসাহে সরকারের পক্ষ থেকে এসব খবরও প্রচার করা হতো। এ চিন্তার একটু একটু করে পরিবর্তন ঘটেছে। এখন বাংলাদেশ এক হাজার মেগাওয়াট বা তার চেয়ে আরও বড় বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের বিষয়ে পরিকল্পনা করে। গত ১০ বছরে বড় বড় প্রকল্প গ্রহণের ফলে অন্যান্য খাতের মতো বিদ্যুত খাতেরও বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে। যা বদলে যাওয়া বাংলাদেশের আভাস দিচ্ছে। পায়রা বিদ্যুত কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে প্রথম ইউনিটের সঙ্গে দ্বিতীয় ইউনিটের কংক্রিটিং, কুলিং টাওয়ার, চিমনি, জেটি নির্মাণসহ অন্য সব অবকাঠামো নির্মাণের বিশাল এক কর্মযজ্ঞ। লক্ষ্য ১৯ এপ্রিল ২০১৯, ওই দিন দেশের প্রথম বড় বিদ্যুত কেন্দ্র উৎপাদনে আসার কথা এর মধ্যে ঘোষণা করেছে সরকার। উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান বলছে সরকারের এই ঘোষণাকে বাস্তবে রূপ দিতে দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছে তারা। আশা করছে নির্দিষ্ট সময়ে বিদ্যুত কেন্দ্রটি উৎপাদন শুরু করবে। একই সঙ্গে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের আরও একটি বিদ্যুত কেন্দ্রর নির্মাণ কাজ খুব শীঘ্রই শুরু করা হচ্ছে। এককভাবে কোন সরকারী বিদ্যুত কোম্পানির সব থেকে বড় হাব হচ্ছে পায়রা বিদ্যুত কেন্দ্র। শুরুতে রাষ্ট্রীয় নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি (এনডব্লিউপিজিসিএল) এবং চীনের ন্যাশলাল মেশিনারি এক্সপোর্ট এ্যান্ড ইমপোর্ট (সিএমসি) মিলে যৌথ উদ্যোগে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। যে কেন্দ্রটির অর্ধেক কাজ এর মধ্যে শেষ হয়েছে। এনডব্লিউপিজিসিএল এবং সিএমসির যৌথ মূলধনী কোম্পানি বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি (বিসিপিসিএল) এখানে আরও একটি এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করবে। এ ছাড়া জার্মানীর সিমেন্সের সঙ্গে এনডব্লিউপিজিসিএল আরও ৩ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করবে। এখানে ১০০ মেগাওয়াটের সৌর এবং ৫০ মেগাওয়াটের বায়ু বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। সব মিলিয়ে ৬ হাজার ৩৯০ মেগাওয়াট বিদ্যুত পাওয়া যাবে এখান থেকে। বাংলাদেশের একক কোন জায়গায় যা সর্বোচ্চ উৎপাদন। সম্প্রতি চীনের বেজিংয়ে এ ডাটাং পাওয়ার প্ল্যান্টে গিয়ে দেখা গেছে পরিবেশ বজায় রেখে বিদ্যুত কেন্দ্রটি পরিচালনা করা হচ্চে। ডাটাং কোম্পানি পায়রা বিদ্যুত কেন্দ্রের রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিচালনা করবে। ডাটাং এর ভাইস প্রেসিডেন্ট ডাইং ইয়াং বলেন, আমরা সব থেকে বেশি গুরুত্ব দেই পরিবেশকে। আন্তর্জাতিক মানদ- ঠিক রেখেই কাজ করা হয় এখানে। কোন ক্ষেত্রে যাতে ব্যত্যয় না ঘটে সে বিষয়ে সব সময় সরকার নজরদারি করে। আমরা যেমন পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে বাতাসে এ্যাশ বা ছাই ছাড়ি না ঠিক একই ভাবে কার্বন ধরে উচ্চদামে বিক্রি করি। একইভাবে এখানের ‘হিট’ (গরম বাতাস) শিল্প কারখানার কাছে বিক্রি করা হয়। ইয়াং বলছিলেন তারা বাংলাদেশের পায়রা বিদ্যুত কেন্দ্রের পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণ করবেন। পায়রাতেও সব মানদ- ঠিক রেখে কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে বলে জানান তিনি। চীনের ডাটাং আর পায়রা বিদ্যুত কেন্দ্রের মধ্যে তুলনা করতে বললে, এনডব্লিপিজিসিএল এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) প্রকৌশলী এ এম খোরশেদুল আলম বলেন, আমরা ডাটাং বিদ্যুত কেন্দ্রের চেয়ে আরও আধুনিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করছি। তিনি উদাহরণ হিসেবে বলেন, আমরা সব ক্ষেত্রে সবশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করছি। কাজেই বিদ্যুত কেন্দ্রটি সর্বাধুনিক হওয়াটা স্বাভাবিক। কয়লা যাতে পরিবেশের জন্য কোন ক্ষতিকর প্রভাব না ফেলে সে জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। দেশের বাইরে অনেক বিদ্যুত কেন্দ্রে কয়লা উন্মুক্ত স্থানে রাখা হয়। কিন্তু আমাদের কয়লা রাখার স্থানটিও ঢেকে রাখা হবে। সঙ্গত কারণে ব্যবহারের পরে যেভাবে ছাই বা এ্যাশ নিয়ন্ত্রণ করা হবে ঠিক একই ভাবে ব্যবহারের আগেও কয়লা থেকে যাতে কোন ডাস্ট বাতাসে না ছড়ায় তা খেয়াল রাখা হবে। সরকার ২০০৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর বড় প্রকল্প নির্মাণে উদ্যোগী হয়। এর মধ্যে অবকাঠামো এবং বিদ্যুত উৎপাদনকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র ছাড়াও কয়লা চালিত বড় বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। দেশের বড় সব প্রকল্পের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছে পায়রা বিদ্যুত কেন্দ্র। প্রকল্পের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিসিপিসিএলের সহকারী প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলাম বলেন, আমরা প্রথম এবং দ্বিতীয় ইউনিট মিলিয়ে এক সঙ্গে হিসেব করি। যাতে প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৫০ ভাগের মতো। আর এককভাবে প্রথম ইউনিটের হিসেব করলে অগ্রগতি ৭০ ভাগের কাছাকাছি। প্রথম ইউনিট নির্মাণের সঙ্গে দ্বিতীয় ইউনিটের প্রায় ৭০ ভাগ কাজ হয়ে যায়। ভৌত অগ্রগতি সম্পর্কে তিনি জানান ৮৬ মিটারের মূল বয়লার হাউসের মধ্যে ৮৪ দশমিক ৫ মিটারের কাজ শেষ হয়েছে। ছয়টা কোল ইয়ার্ডের মধ্যে প্রথম ইউনিটের সঙ্গে চারটির কাজ শেষ করা হবে। এর মধ্যে একটির কাজ শীঘ্রই শেষ হবে। বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য কুলিং টাওয়ারের পাইলিং শেষ হয়েছে। নদী থেকে পানি আনার জন্য পাইপলাইন বসানো হয়ে গেছে। এখন পাম্প বসানোর কাজ চলছে। চলছে বিদ্যুত কেন্দ্রের জন্য স্থায়ী জেটি নির্মাণের কাজ যেখানে বিদ্যুত কেন্দ্রের কয়লা খালাস হবে। চীনের আর্থিক সহায়তায় বিদ্যুত কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হচ্ছে। চীনের এক্সিম ব্যাংক কেন্দ্র নির্মাণে ঋণ প্রদান করেছে। তবে চীন এবং ইউরোপীয় বিনিয়োগ মিলিয়ে পায়রাতে মোট ১২ বিলিয়ন ডলার বা ৯৬ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হবে। যদিও এত সব আশার মধ্যে হতাশার খবর হচ্ছে বিদ্যুত কেন্দ্রের কাজ এগিয়ে চললেও এখনও সঞ্চালনে সাবস্টেশন নির্মাণ কাজ শুরু করতে পারেনি পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি (পিজিসিবি)। বিদ্যুত কেন্দ্র উৎপাদনে আসার সঙ্গে সঙ্গে সঞ্চালন লাইন শেষ হলেও চালু হবে না গোপালগঞ্জ সাবস্টেশন। বিদ্যুত বিভাগ থেকে ইতোমধ্যে পিজিসিবিকে এ বিষয়ে তাগিদ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিদ্যুত কেন্দ্রে কয়লা পরিবহনে বড় জাহাজ আনার জন্য যে ড্রাফট প্রয়োজন হয় তাও পায়রা বন্দরের নেই। ফলে শুরুতে ছোট জাহাজে করে কয়লা এনে কেন্দ্র পরিচালনা করতে হবে। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। বিদ্যুত কেন্দ্রের প্রধান প্রকৌশলী এবং প্রকল্প পরিচালক শাহ আবুল মওলা বলেন, এখন সাড়ে ৪ মিটার ড্রাফট আছে। এতে করে ২০ হাজার টনের জাহাজ আমাদের জেটিতে নোঙ্গর করতে পারবে। সব মিলিয়ে ২০ হাজার টন কয়লা দিয়ে বিদ্যুত কেন্দ্রটি দেড় দিন চলবে। তবে এখানে ৫০ হাজার টনের কয়লার জাহাজ আনা সম্ভব হলে সাড়ে চারদিন বিদ্যুত কেন্দ্র চালানো যাবে। বড় জাহাজ জেটিতে ভেড়ানো সম্ভব হলে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ ইউনিট প্রতি ১৫ পয়সা কমে আসবে। তিনি বলেন, বিদ্যুত কেন্দ্রটি হবে আল্ট্রা সুপারক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির। পরিবেশ রক্ষায় সকল মানদন্ড ঠিক রেখেই কেন্দ্রটি পরিচালনা করা হবে। বিদ্যুত কেন্দ্রটির জন্য আপাতত কয়লা আসবে ইন্দোনেশিয়া থেকে। আগামী বছরের শুরুর দিকেই কয়লা আমদানি শুরু হবে। বিদ্যুত কেন্দ্রটি এপ্রিলে চালু করার জন্য আগেভাগে মজুদ তৈরি করা হবে। সেই লক্ষ্য সামনে রেখে কেন্দ্রের জন্য স্থায়ী জেটি নির্মাণের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে।
×