ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

১৫ আগস্টের দুঃসহ স্মৃতি

‘যে শিশু মায়ের কোলে উঠতে চেয়েছিল তার নিথর দেহ চোখের সামনে’

প্রকাশিত: ০৫:০৮, ১২ আগস্ট ২০১৮

  ‘যে শিশু মায়ের কোলে উঠতে চেয়েছিল তার নিথর দেহ চোখের সামনে’

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভয়াল কাল রাতে স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতকের নির্মম বুলেটে শহীদদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ এমপি ও বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সাহান আরা বেগমের অতি আদরের বড় পুত্র সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাত। ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট ঘাতকের সামনে মা সাহান আরা বেগমের কোলে উঠতে চেয়েছিল চার বছরের শিশু সুকান্ত বাবু। কিন্তু তাকে আর কোলে নিতে পারেননি হতভাগ্য মা। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘাতকের ছোড়া বুলেটে নিহত বাবুর নিথর দেহ দেখতে পান গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণে বেঁচে যাওয়া মা সাহান আরা বেগম। ৪৩ বছর পরেও সেই স্মৃতি আজও ভুলতে পারেননি এই হতভাগ্য মা। স্মৃতি হাতড়ে সাহান আরা বেগম বলেন, সব শোক সইবার নয়। আজও বাবুর কথা মনে করে ডুকরে কাঁদি। সূত্র মতে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভয়াল রাতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ির সঙ্গে সঙ্গে মিন্টো রোডের ২৭ নম্বরে তাঁর (বঙ্গবন্ধু) বোন জামাতা ও তৎকালীন পানিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতেও হামলা করে ঘাতকরা। যেখানে খুনীরা নির্মমভাবে হত্যা করে আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, তার ভাইয়ের ছেলে সাংবাদিক শহীদ সেরনিয়াবাত, মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, ছেলে আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাত এবং বরিশালের ক্রিডেন্স শিল্পীগোষ্ঠীর সদস্য আব্দুর নঈম খান রিন্টুকে। এছাড়াও ওই ঘটনায় আহত হন আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের সহধর্মিণী ও বঙ্গবন্ধুর বোন আমেনা বেগম, পুত্রবধূ বেগম সাহান আরা বেগম, কন্যা বিউটি সেরনিয়াবাত, হেনা সেরনিয়াবাত, পুত্র আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত, ক্রিডেন্স শিল্পীগোষ্ঠীর সদস্য খ.ম জিল্লুর রহমান, ললিত দাস, রফিকুল ইসলাম ও সৈয়দ মাহমুদ। সে দিনের বিভীষিকাময় রাতের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ এমপি’র সহধর্মিণী সাহান আরা বেগম বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ফজরের সময় অতর্কিত হামলায় কেঁপে উঠে ঢাকার ২৭ নম্বরের মিন্টো রোডের বাড়ি। সেদিন ফজরের আযানের সময় গুলির প্রচন্ড শব্দে হঠাৎ আমাদের ঘুম ভেঙে যায়। আমার শাশুড়ি (বঙ্গবন্ধুর বোন আমেনা বেগম) বলেন, বাড়িতে ডাকাত পড়েছে, আমার ভাইকে (বঙ্গবন্ধু) ফোন দাও। তখন আমার শ্বশুর আব্দুর রব সেরনিয়াবাত বঙ্গবন্ধুকে ফোন করেছিলেন। কিন্তু কি কথা হয় তা আমরা জানি না। সাহান আরা বেগম আরও বলেন, এরই মধ্যে আমি শেখ ফজলুল হক মণি ভাইকে ফোন করলাম। ফোনে তাকে বললাম, আমাদের বাড়ির দিকে কারা যেন গুলি করতে করতে আসছে বুঝতে পারছি না। মণি ভাই বলেন, কারা গুলি করছে দেখ। বললাম বৃষ্টির মতো গুলি হচ্ছে, দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ আমাদের দরজা ভাঙ্গার শব্দ পেলাম। ঘাতকরা বাড়ির দরজা ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করে। তারা রুমে প্রবেশ করে হ্যান্ডস আপ বলে আমাদের সবাইকে কর্ডন করে নিচ তলার ড্রইংরুমে সারিবদ্ধ করে দাঁড় করিয়ে রাখে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে সাহান আরা বেগম বলেন. সিঁড়ির অর্ধেক নেমেই বাবু (সুকান্ত বাবু) বলে, মা আমি তোমার কোলে উঠব। আমি ওকে কোলে নিতে পারলাম না। পরে নিচে নামার পর অস্ত্র ঠেকিয়ে ওরা আমাকে জিজ্ঞাসা করে, ওপরে আর কে কে আছে? এমন সময় আমার শ্বশুর আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন তার চোখের ইশারায় আমি বললাম, ওপরে আর কেউ নেই। যে কারণে ওপরের রুমগুলো তল্লাশি না হওয়ায় আমার স্বামীকে (আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ) খুঁজে পায়নি ঘাতকরা। তিনি আরও বলেন, আমার শ্বশুর ঘাতকদের বলেছিল, তোমাদের কমান্ডিং অফিসার কে? কিন্তু উত্তরে ওরা বলে, আমাদের কোন কমান্ডিং অফিসার নেই। এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই ঘাতকরা ব্রাশ ফায়ার শুরু করে। আমরা মাটিতে পরে যাই। আমি আমার শ্বশুরের পেছনে ছিলাম, আমার কোমরে গুলি লাগে। ব্রাশ ফায়ারে ছয়জন মারা যায়। আমরা গুলিবিদ্ধ হয়ে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে কয়েকজন কাতরাচ্ছিলাম। এর মধ্যে আবার একদল লোক গাড়ি নিয়ে আসে। তখন ভাবলাম এই বুঝি শেষ। কিন্তু পরে দেখি রমনা থানার পুলিশ এসেছে। পুলিশ আসার পর বাবুকে শহীদ ভাইয়ের বুকের নিচ থেকে উঠানো হলো। দেখলাম ওর নাক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। কিছু সময় আগে যে সন্তান আমার কোলে উঠতে চেয়েছিল, তাকে কোলে নিতে পারি নাই। সেই আদরের সন্তানের নিথর দেহ আমার চোখের সামনে। বলেই কান্নাজুড়ে দেন হতভাগ্য মা সাহান আরা বেগম। সাহান আরা বেগমের ঘনিষ্ঠজন জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান সৈয়দা মনিরুন নাহার মেরী জানান, সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাতের জন্ম একাত্তরের ২২ জুন। সে সময় আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ মুজিব বাহিনীর প্রধান হিসেব মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। মা সাহান আরা বেগম শিশু সুকান্ত বাবুকে নিয়ে প্রাণের ভয়ে গ্রামকে গ্রাম পাড়ি দিয়েছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। সুকান্ত বাবুর পরিবারে খুশি নেমে আসে। এরই মধ্যে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট হঠাৎ ঘাতকের আগমনে চার বছরের শিশুটি অনেকটাই ভয় পেয়ে আশ্রয় চায় মা সাহান আরা বেগমের কোলে। কিন্তু মমতাময়ী মা তার আদরের ছোট্ট শিশুপুত্রকে আর কোলে নিতে পারেননি। তার আগেই ঘাতকের তপ্ত বুলেটের আঘাতে মায়ের চোখের সামনেই নির্মমভাবে হত্যা করা হয় সুকান্ত বাবুকে। একজন গর্ভধারিণী মায়ের কাছে এর চাইতে কষ্টকর, বেদনাদায়ক আর কি হতে পারে। সেইদিন ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ। সন্তানের মুখটা শেষবারের মতো দেখারও সুযোগ হয়নি তার। সেই কষ্ট এখনও তাড়িয়ে ফেরে হতভাগ্য পিতা আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহকে। তিনি (মেরী) আরও বলেন, সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাত জন্মগ্রহণ করেছিলেন ’৭১ সালের ২২ জুন। বাংলাদেশ স্বাধীনও হয়েছিল ১৯৭১ সালে। সুকান্ত বাবুর জন্মের সময় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল। নয় মাসের যুদ্ধে আমরা পেয়েছিলাম নতুন স্বাধীন দেশ। সুকান্তও দেখেছিল নতুন বাংলাদেশকে। কিন্তু নতুন দেশের গর্বিত নাগরিক হিসেবে বেড়ে উঠা হয়নি তার। স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে স্বাধীন দেশ থেকে চিরতরে চলে যেতে হয়েছে চার বছরের শিশু সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাতকে।
×