ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

একটি আবেগময়ী আন্দোলনের অপমৃত্যু

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ১২ আগস্ট ২০১৮

 একটি আবেগময়ী আন্দোলনের অপমৃত্যু

কোমলমতি স্কুল ছাত্রদের একটি সম্পূর্ণ সামাজিক, অরাজনৈতিক ও আবেগের আন্দোলনকে কিভাবে বিএনপি-জামায়াত তাদের হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য হাইজ্যাক করেছে সেটা দেখলাম আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীর ফোনালাপে। ইতোমধ্যে ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনা সেটাই প্রমাণ করছে। ছাত্রদের এই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পূর্ণ একাত্মতা প্রকাশ করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তিনি যৌক্তিকতা বিবেচনায় তাদের নয়টি দাবির প্রতিটিই মেনে নিয়েছেন। এর মধ্যে যেগুলো অল্প সময়ে বাস্তবায়নযোগ্য সেগুলো তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবায়ন করেছেন। সরকারের পক্ষ থেকে এই কয়েকদিনে যা যা করণীয় তার সবটুকুই করা হয়েছে। আর যেগুলো কোনভাবেই এই মুহূর্তে করা যাচ্ছে না, যেমন আইন প্রণয়ন, পলিসি প্রণয়ন, সেগুলোও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দ্রুততম সময়ে শেষ করার জন্য ইতোমধ্যে নির্দেশ দিয়েছেন। সেজন্য পরিবহন সংক্রান্ত খসড়া আইন কেবিনেট সভায় উত্থাপিত হয়েছে এবং আশা করা যাচ্ছে এটি সংসদে উপস্থাপনের জন্য কেবিনেট কর্তৃক অনুমোদিত হবে। ছাত্রদের এই নয়টি দাবির বাস্তবায়নের অগ্রগতি গণমাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে। অতীতে কোন সরকার কি এত মানবিকভাবে এই সকল বিষয় এড্রেস করেছে? তারা কি এত দ্রুততার সঙ্গে কোন সিদ্ধান্ত দিতে পেরেছে? একটা বিষয় আমরা ভুলে যাচ্ছি, পরিবহন সেক্টরের সমস্যাগুলো বহু বছরের পুঞ্জীভূত সমস্যা। এটি এই সরকারের আমলে সৃষ্ট কোন সমস্যা নয়। তবে গণপরিবহন ব্যবস্থা ও ট্রাফিক সমস্যার উন্নয়নের জন্য এই সরকার অনেক যুগান্তকারী প্রকল্প গ্রহণ করেছে যার সুফল এদেশের মানুষ অল্প সময়ের মধ্যেই পাবেন। ইতোমধ্যে ঢাকাসহ একাধিক নগরীতে বহু ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে যার সুফল মানুষ পাচ্ছে। ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, নতুন হাইওয়ে নির্মাণ এ বিষয়গুলো একমাত্র শেখ হাসিনার সরকার ছাড়া আর কার আমলে শুনেছি? এগুলো এখন আর কথার কথা নয়, এগুলো এখন বাস্তবতা। এগুলোর কাজ এগিয়ে চলছে। এই সকল প্রকল্প পরিপূর্ণ বাস্তবায়িত হলে রাজধানীসহ সারাদেশে গণপরিবহন সেক্টরে অভূতপূর্ব পরিবর্তন আসবে। মানুষ দীর্ঘ মেয়াদে এর সুফল পাবে। আমার বিশ্বাস একমাত্র তিনিই এদেশের গণপরিবহন ব্যবস্থার বহু বছরের পুঞ্জীভূত জঞ্জাল নিরসন করতে পারবেন। কারণ জননেত্রী যে সেক্টরেই হাত দিয়েছেন, সেখানেই সফলতা দেখিয়েছেন। একমাত্র তিনিই আমাদের আলোর দিশারী। আপনারা তাঁর ওপর আস্থা রাখুন। একটা বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে, ঢাকাসহ দেশে পরিবহন ও ট্রাফিক ব্যবস্থায় বহু বছরের যে অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খলা বিরাজমান তার মূল কারণ হচ্ছে এদেশে দীর্ঘ দিনের আইন না মানার সংস্কৃতি। আমরা কেউই ট্রাফিক আইন মানতে চাই না। ট্র্রাফিক আইন নিয়ে যারা কাজ করছেন তাদের দুই একজন আমাকে দায়িত্ব নিয়ে বলেছেন যে, ঢাকায় আমরা সবাই যদি ট্র্রাফিক আইন পরিপূর্ণভাবে মেনে চলি তাহলে ট্রাফিক সমস্যার প্রায় পঁচাশি ভাগ আর থাকবে না। ঢাকার প্রায় পঁচানব্বই ভাগ রাস্তায় অবৈধ পার্কিং রয়েছে যার ফলে রাস্তার প্রায় অর্ধেকেরও বেশি পার্কিং-এর নামে দখল হয়ে থাকে। কোন কোন রাস্তায় এই রকম দখল রাস্তার প্রায় দুই তৃতীয়াংশ জুড়ে। আমরা সবাই আইন মানার সংস্কৃতি গড়ে তুললে এই সমস্যা থাকবে না। এই কাজ শুধু সরকার আর পুলিশ দিয়ে হবে না। পৃথিবীর কোন দেশেই এটি হয়নি। আমি যুক্তরাজ্যে প্রায় সাত বছর ছিলাম। সেখানে দেখেছি রাস্তায় কোন পুলিশ নেই অথচ মানুষ চব্বিশ ঘণ্টায়ই ট্রাফিক আইন মানছে। ট্র্রাফিক আইন মানার ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থা আমাদের চেয়ে অনেক ভাল। আমাদের কোমলমতি ছাত্রদের উচিত আইন মানার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে একটি সামাজিক আন্দোলন হিসেবে গ্রহণ করা যার শুরুটা হবে তার পরিবার থেকে। স্কুলেও তাদেরকে এই বিষয়ে পাঠদান করার প্রয়োজন হবে। আমরা দেখলাম স্কুল শিশুদের একটা মহৎ সামাজিক ও আবেগের আন্দোলনকে নির্লজ্জ ও পরাজিত ‘লুসিফার’ বিএনপি-জামায়াত তাদের হীন রাজনৈতিক স্বার্থে কিভাবে হাইজ্যাক করল। তাই এই আন্দোলনের আর কোন নৈতিক অবস্থান নেই। এটি এখন অরাজকতা আর বিশৃঙ্খলার একটা নতুন কৌশল। অবিলম্বে এই অরাজকতা বন্ধ করা হোক। ঢাকার বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষক এবং অভিভাবকেরা তাদের দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। একটি স্বার্থান্বেষী মহলের প্ররোচনায় এদেশের একটি জেনারেশনকে ধ্বংসের দায়দায়িত্ব তাদের নিতে হবে। এই শিশুদেরকে শেখানো হচ্ছে কিভাবে আইন নিজের হাতে তুলে নিতে হয়- কিভাবে গাড়ি ভাঙতে হয়- কিভাবে বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করতে হয়- কিভাবে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকের পতাকাবাহী গাড়িতে হামলা করতে হয়- কিভাবে গাড়ির চাবি কেড়ে নিতে হয়। আশির দশকের শুরুর দিকে আমরা দেখেছিলাম জেনারেল জিয়া কিভাবে মেধাবী তরুণদের হিজবুল বাহারে নিয়ে পথভ্রষ্ট করেছিল। এই বিএনপি এদেশে তরুণ-যুবকদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছিল, ড্রাগ দিয়েছিল, এদেশে অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছিল। আর এইবার তারা শিশু-কিশোরদেরকে পথভ্রষ্ট করার নতুন কৌশল নিল। আমরা দেখলাম পাড়া মহল্লার চিহ্নিত সন্ত্রাসীদেরকে স্কুলের সাদা ইউনিফর্ম পড়িয়ে রাস্তায় নামানো হচ্ছে। কয়েকটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি রাতারাতি ইউনিফর্ম বানাচ্ছে আর সাপ্লাই দিচ্ছে। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর দলীয় কার্যালয়ে হামলা করেছে ইউনিফর্মের আড়ালে সন্ত্রাসীরা। বিএনপি জামায়াতের রাজনীতির ইতিহাসে এটি আরেকটি কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে এই জন্য যে, তারা তাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব ঘুচাবার জন্য শিশুদের ব্যবহার করতেও ছাড়ল না। আরেকটি বিষয় আমরা দেখলাম, কিছু কিছু ব্যক্তি যাদের বেশির ভাগ উচ্চশিক্ষিত, তারা ইনিয়ে বিনিয়ে এটা বলার চেষ্টা করছে যে, এটা ম্যাগনাকার্টা জাতীয় কিছু একটা- একটা ‘কিশোর বিপ্লব’। কা-জ্ঞানহীন এই লোকগুলো যাদের অনেকেরই গোপন রাজনৈতিক এজেন্ডা রয়েছে। তারা বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়াতে নানা রকম উস্কানি দিয়ে যাচ্ছে। এই সকল লোকদের চিহ্নিত করা উচিত। আমার ভয় হচ্ছে এই ভেবে যে, বিএনপি এই সরকারকে বিপদে ফেলার জন্য অনেক নাশকতা/ সাবোটাজ করতে পারে যার বলি হতে পারে এই নিষ্পাপ শিশুরা। এই কাজ তারা ইতোমধ্যে শুরু করে দিয়েছে। ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় তারা নাশকতা চালাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে- স্কুল পড়ুয়া ছাত্রের একজন বাবা হিসেবে সকল ছেলে-মেয়ের বাবা-মাকে বলছি, আপনারা নিজেদের বাচ্চাদের কিছু রাজনৈতিক দলের এই নোংরা ও ঘৃণ্য রাজনৈতিক খেলার বলি বানাবেন না। এদেশের সকল শিশু-কিশোর নিরাপদে থাকুক। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। লেখক : শিক্ষক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
×