ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রেজা সেলিম

মানবিক গ্রামের পথে

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ১২ আগস্ট ২০১৮

 মানবিক গ্রামের পথে

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য অনুষদের অধ্যাপক অনির্বাণ মোস্তাফা ও অধ্যাপক আফরোজা পারভীনের সঙ্গে গত দু’বছরের আলাপচারিতা সামনে রেখে আজ এই রচনায় বাংলাদেশের গ্রাম পরিবর্তনে ও গ্রামের উন্নয়ন রূপান্তর পরিকল্পনায় বসতি প্রযুক্তির ভূমিকা নিয়ে আলোচনা হবে। যারা এই শিক্ষক দম্পতিকে চেনেন বা জানেন তাঁরা অবহিত যে এই দুই উচ্চশিক্ষিত নানা পর্যায়ের ডিগ্রীধারী ও শিক্ষা সমাপনান্তে বিদেশত্যাগী। কেবল শিক্ষাদানের ব্রত নিয়েই তাঁরা বেছে নিয়েছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। পড়ান স্থাপত্যকলা আর ধ্যানে বাংলাদেশ, বাংলাদেশের গ্রাম আর মুক্তিযুদ্ধ। দুইজন-ই ’৭১ প্রজন্ম। অনির্বাণের বাবা শহীদ বুদ্ধিজীবী আনম গোলাম মোস্তাফা। আদি নিবাস দিনাজপুর। আফরোজা গোপালগঞ্জের, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী এক নির্মোহ পরিবারের সন্তান। এই শিক্ষক দম্পতি মনে করেন বাংলাদেশের গ্রামগুলো গ্রামের মতো থাকতে পারলে ভাল হতো কারণ- গ্রামগুলো কাঁচা ও নবীন। যেন অনেকটা রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো করেই বলেন, ‘বাংালাদেশের শৈশব এখনও অতিক্রান্ত হয় নাই’! আফরোজা আর অনির্বাণ স্থাপত্যকলার ছাত্র ও শিক্ষক হিসেবে মনে করেন গ্রামগুলো গ্রামের মতো থাকুক। আমরা শুধু মানবিক সুবিধাগুলো পৌঁছে দেই, তা হলে গ্রামের যে স্বাভাবিক রূপান্তর তা অক্ষুণœ থাকবে সেখানে শহরের মতো জোর-দবরদস্তি পরিকল্পনা করা দরকার হবে না। তখন আমার মনে পড়ে আমার শিক্ষক সমাজবিজ্ঞানী এ কে নাজমুল করীম তার ‘চেঞ্জিং সোসাইটি ইন ইন্ডিয়া, পাকিস্তান এ্যান্ড বাংলাদেশ’ বইয়ে গ্রাম রূপান্তর ‘পর্যবেক্ষণে’ জোর দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, ‘অবশ্যম্ভাবী পরিবর্তন আর স্বাভাবিক রূপান্তরকে যুক্তি দিয়ে মিলিয়ে দেখতে হবে যেন গ্রামের উপর আমরা প্রভাব না খাটাই’। অনির্বাণ বলেন, সে কথাটিই তো আমরা বুঝতে চাই না। আমরা মনে করি শহরের সব সুবিধা গ্রামে গেলে বা গ্রামের মানুষ সেসব সুবিধা পেলেই সে উন্নততর জীবনের অধিকারী হবে। যেমন ধরুন বিদ্যুত সুবিধা। আমরা বিদ্যুতের সুবিধা দিতে গিয়ে গ্রামে যে পোলগুলো স্থাপন করেছি ও তার টেনে যে ঝুঁকি তৈরি করেছি তা বহু বছর থেকে গ্রামকে একটা আরবান ফ্লেভার দিচ্ছে, এটা হয়ত ঠিক আছে কিন্তু গ্রাম মানে কী সেই পোলের তারে বসে থাকা একটি নিঃসঙ্গ কাকের ছবি? আমাদের দৃষ্টি আটকে আছে ওইরকম একটি চিত্রকল্পে, আমরা এ থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না। সবাই বলছেন, এটা স্বাভাবিক উন্নয়ন কিন্তু আমদের বুঝতে হবে এর অবশ্যম্ভাবী প্রভাব কি কি হবে যা দেখে আমরা সঠিক নির্দেশনা দিতে বা নিতে পারব। যে কোন উন্নয়ন পরিকল্পনা কাজের আগে সেই কাজটি আমরা করে নিচ্ছি না। অনির্বাণ আরও বলেন, আমরা বুঝতেই পারছি না সকল উন্নয়নের অবশ্যম্ভাবী প্রভাব প্রথমে পড়ে মানুষের বসতিতে, তার নিত্যদিনের বসবাসে আর অভ্যাসে। কিন্তু গ্রামে তো বিদ্যুত যাবে! যাবে কিন্তু বিদ্যুতের অবকাঠামো এখানে মুখ্য নয়, এখানে সুবিধা মুখ্য। গ্রামের মানুষ কী কী সুবিধা পাচ্ছে তার চিত্র থাকা দরকার আর অনির্বাণ-আফরোজা মনে করেন এই চিত্র বলে বা ব্যাখ্যা করে বোঝানো যাবে না। মানুষের ভেতরের কাঠামোতে, ভাবলোকের যে সাংস্কৃতিক রূপান্তর সেটা আমাদের বসতি পরিকল্পনায় গুরুত্ব পাওয়া উচিত। এই কাজটি হয়নি। অনির্বাণের মতে, আমরা প্ল্যান বা পরিকল্পনা শব্দটিকেই ‘আরবান’ করে ফেলেছি। যেমন ধরুন গ্রামে টেলিভিশন গেছে কিন্তু কন্টেন্ট কি যাচ্ছে? শহরের পরিবেশের সেই ‘আরবান’ কাহিনী নিয়ে নাটক বা গ্রামের মানুষকে ফটকাবাজি সাজিয়ে বা হতাশ জীবনের কল্প-কাহিনী দিয়ে সাজানো নাটক বা সিনেমা। টেলিভিশনের প্রায় সবটাজুড়েই থাকে শহর আর শহরের মোহ তৈরি করার চটকদার বিজ্ঞাপন। গ্রামের মানুষের স্বাভাবিক জীবনের কোথায় এসব কাজে লাগছে? কিছু খবর আর স্বাস্থ্য তথ্য ছাড়া আমরা কি মিডিয়া-কে শিক্ষার বাহন হিসেবে গ্রামে পৌঁছে দিতে পেরেছি? আমি শিখলাম আমাদের গ্রামগুলোর বসতি-প্রযুক্তি নিরাভরণ ও দীর্ঘকালের। নদীকূলের মানুষ বলে আমরা কিছুটা ভাবাবেগী কিন্তু আমরা নিজেদের বসতি-প্রযুক্তি নিজেরাই তৈরি করেছি। নিজেরাই নকশাদার, নিজেরাই কারিগর ও তার মালিক। কিন্তু মাত্র ২০ ভাগ মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরবাসী হয়ে বাকি ৮০ ভাগের সব বসতি গৌরবের মালিকানা কেড়ে নিতে ব্যস্ত। অনির্বাণ মোস্তাফা আর আফরোজা পারভীন সেই গৌরবের মালিকানা যেন গ্রামেই থাকে সেই সংগ্রামের শিক্ষক। আফরোজা বলেন, প্রযুক্তি মানেই হলো যা সুপ্রযুক্ত বা আপ্রোপ্রিয়েট। অর্থাৎ তাকে যথাযথ হতে হবে। দেখুন, এই দেশের বেশিরভাগ মানুষ গ্রামে থাকে আর তাদের শাসন করে শহরের অল্প কিছু মানুষ! শহরের মানুষগুলো তো একদিন গ্রাম থেকেই গেছে আর এরা নগর তৈরি করেছে, সেখানে নানারকম সুবিধাহীনতার উৎপাত, যানজট-জলজট, রাস্তাঘাটের কোন নিয়ম নেই, বাতাসে দূষণ আর সব দোষ যেন গ্রামের। তাই এখন গ্রামগুলো খুঁড়ে শহর বানাতে হবে না হলে তাদের শেষ ইচ্ছা পূরণ হচ্ছে না! সুপ্রযুক্ত কী হবে তার কিছু না ভেবেই গ্রামগুলোকে বদলে দেয়ার এক অদ্ভুত প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে! আসলে কি গ্রাম উন্নয়ন না কি বাজার বাড়ানো? অনির্বাণ মনে করেন বাজার বাড়ানোই এখানে মুখ্য। না হলে মাটির ঘরগুলো টিন বা কংক্রিটের ঘেরাটোপে না ফেলে মজবুত করে হয়ত মাটিতেই রাখা যেত। সে গবেষণা আমরা করিনি, এই নিয়ে কারও সঙ্গে কথাও বলিনি। শহর থেকে বুদ্ধি আর পাইকার এসে আমাদের বসতি-প্রযুক্তি বদলে দিয়ে একটা ঘরের বদলে চারটি ঘরের বসতি আকৃতি গড়ে দিল। মানুষগুলো ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের প্যাঁচে পড়ে গেল। যেমন অতিথি আপ্যায়নে ডাবের পানির জায়গা করে নিল পেপসি বা স্প্রাইট! কারণ এখানে বাজার বাড়ানোই মুখ্য হয়ে গেল! না হলে দু’টো টাকা হাতে এলেই বাড়ির উঠোনের সামনে একটা দালান বানিয়ে সেখানে কয়েকটা দোকান ঘর করা হচ্ছে কেন? কেউ যখন বুঝিয়ে বলছে না কোথায় কী করতে হবে, সেখানে আপনাদের মতো পরিকল্পনা প্রযুক্তিবিদদের কি কিছুই করার নেই? আনির্বাণ বলেন, আমরা তো শহরের শিক্ষক! গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হ’তে পারলেও অন্তত আর যা হোক ‘হয়ত’ মানুষের কাছে থেকে এই কাজগুলো করা যেত। তাই ভাবছি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে রামপাল বা বটিয়াঘাটার দিকে গ্রামে চলে যাব! হেঁয়ালি করে বলা হলেও এর মধ্যে অনির্বাণের একটি দার্শনিক অনুভব আছে। তিনি মনে করেন এই পৃথিবীর সবই ক্ষণস্থায়ী। কোন কিছুই স্থায়ী কিছু নয়। আমার ধারণা তিনি প্রাকৃতিক বিবর্তনের রূপকল্পের ছবি বুকের মধ্যে বিবেচনায় রেখেই নিজের দেশকে ভালবাসেন। ১৯৭১ সালে তাকে কোলছাড়া করে তার বাবাকে চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল হত্যার উদ্দেশে কারণ অনির্বাণের বাবা এই দেশের জন্মের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সে বুদ্ধিজীবী বাবার স্বপ্ন সন্তানের মধ্যে রূপান্তরিত হয়েছে এটাই স্বাভাবিক। সেরা বসতি স্থাপনাবিদ হয়েছেন, আর একজন সেরা সহকর্মী সুপ্রযুক্তি স্থাপনা চিন্তার মানুষের সঙ্গে সেই স্বপ্ন ভাগ করে নেয়ার সুযোগও এই দেশ তাঁকে দিয়েছে। তাঁরা দু’জনই চান বঙ্গবন্ধুর সেই সোনার বাংলার স্বপ্নের মতো করেই গড়ে উঠুক এই ‘মানবিক বাংলাদেশ’। আর বলছেন, সেরকম-ই হতে হবে, সেদিকেই আমরা যাচ্ছি। এখন আমাদের নতুন করে ভুল করা যাবে না কারণ মানবিক বাংলাদেশের গ্রামও থাকবে মানবিক। আফরোজা মনে করেন পরিবর্তনশীল গ্রাম সমাজের যে চাহিদা, বসতি-প্রযুক্তি তাকে বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ, বাংলাদেশের গ্রামগুলো আমাদের ‘বদ্বীপীয় সুখের’ ধনাত্মক অভিব্যক্তি আর এই গ্রামগুলো নিঃশর্ত ভালবাসা এবং প্রাকৃতিক স্নেহ দিয়ে আবৃত। প্রতিটি গ্রাম সামাজিক সংহতির ‘সাংস্কৃতিক আড়াআড়ির বন্ধনে যুক্ত, যেন এক একটি ক্যানভাস ‘মাটি-জল-গাছপালা’, এবং ‘টেকসই বসতি’র নিষ্পত্তি সে করেই রেখেছে। অনির্বাণ আর আমি আমাদের গ্রামগুলোকে তাই ‘গ্রাম নগর’ বলেই মনে করি আর সেখানে তথাকথিত পশ্চিমা ‘শহুরে’ অথবা সে আদলে দুর্বল ‘গ্রামীণ’ বসতি চিন্তা আমাদের ঐতিহ্য বহির্ভূত ও জীবিকার বিপরীতে শুধুই একটি দৃষ্টিভঙ্গি মাত্র; পরিবর্তিত সমাজের প্রয়োজনীয়তা মোকাবেলার জন্য গ্রাম অবকাঠামোয়, সেবা ও সুবিধা অন্তর্ভুক্ত করার ধারণা আমাদের বসতি পরিকল্পনায় থাকতে হবে। শুনতে শুনতে আমার মনে পড়ল রামকৃষ্ণ মুখার্জীর ‘বাংলার ছ’টি গ্রাম’ গবেষণায় তিনি ঠিক এই কথাটিই বলেছিলেন ১৯৪৬ সালে অথচ এখনও আমাদের দেশের জন্য তা কত প্রাসঙ্গিক। বগুড়ার গ্রামগুলো নিয়ে ৪২ থেকে ৪৬ সালের গবেষণা শেষে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যা আফরোজার চিন্তার সঙ্গে মিলে যায়, ‘সন্দেহ নেই মানব সমাজ কেবলমাত্র মানুষের মৌলিক চাহিদার সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট নয়, সুতরাং অতীব প্রয়োজনগুলো পূরণ করে সমাজ প্রায়শই বহুবিধ সুযোগের বিস্তার ঘটায় এবং স্বকীয় সত্তায় বিকশিত হয়। কাজেই কোন গোষ্ঠীর সামাজিক জীবন শুধু মৌলিক অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় (যা প্রকৃতপক্ষে মানুষের মৌলিক চাহিদাকে নির্দেশ করে) বরং এর বাইরেও অধিক কিছু চিন্তা করে থাকে’ (পৃষ্ঠা ৩৬০-৩৬১)। আফরোজা আর অনির্বাণ একে বলেন, কালচারালাইজেশন অফ সেটেলমেন্ট বা ‘বসতি সংস্কৃতায়ন’ যা আমরা গ্রাম বিকাশের বসতি পরিকল্পনায় অগ্রণী বিবেচনা করছি না। আফরোজা বলছেন, আমাদের গ্রামের অভ্যন্তরীণ বাড়ি এবং বসতিগুলো হলো বন্যা ব্যবস্থাপনার উপযোগী, জলবায়ুগত পরিবর্তনের সঙ্গেও সমন্বিত, আমরা যাকে আমাদের বইয়ের ভাষায় বলি ‘অর্গানিক পরিকল্পনা’ তারই ফলাফল। যুগ যুগান্তরে ‘অ-স্থপতি’ গ্রামবাসীদের প্রজন্মের দ্বারাই এই বসতি পরিকল্পিত, নির্মিত এবং নিজে থেকে যখন প্রয়োজন হয়েছে রূপান্তরিত হয়েছে। এই ‘অর্গানিক গ্রামগুলি’-ই, আমার কাছে মানবিক গ্রাম-এর সমতুল্য, যদিও পরিকল্পিত শহরগুলি ‘রোবোটিক্স’ বা মেকানিক্যাল। এখন প্রশ্ন থাকে, আমরা প্রযুক্তিকে মানবিক করে কাজে লাগাতে পারি কী না। আফরোজা যা মনে করেন তা রামকৃষ্ণ মুখার্জীও উপসংহারে লিখেছেন ‘সামগ্রিকভাবে এটা স্বীকার করতেই হবে যে, সমাজে একটা পরিবর্তন ঘটছে। তবে সমস্যা হচ্ছে, এ পরিবর্তনটি আদৌ সুফল বয়ে আনবে কিনা’ (পৃষ্ঠা ৩৬৫)। অনির্বাণের উত্তর অত্যন্ত দৃঢ়- উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তার কারণে, মানবিক গ্রামের জন্যে আমাদের যা করতে হবে তা হচ্ছে ‘জনগণের চালিত’ অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন উদ্যোগের মাধ্যমে এই অর্গানিক পরিকল্পনা প্রক্রিয়া পালন করা। এই ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীতে আমাদের জবাবদিহির জায়গা কিন্তু একটাই তা হলো দেশ। আমি তো ইচ্ছামতো আমার দেশ বা আমার মায়ের রূপ বদলে দিতে পারি না। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্প [email protected]
×