টিপনদের বাসাটা বেশ বড়। বারান্দাটাও বেশ বড়। টিপন মাঝে মাঝে বোন রিমুর সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলে। বারান্দার পাশে একটি গাছ। সে গাছে অনেক ডালপালা। সেগুলো বারান্দাটাকে অনেকখানি ছায়া দিয়ে রেখেছে। ছোট ফুপি শাহানা বলেছিল, ‘ভাবি গাছটা কেটে ফেলে দাও।’ টিপনের মা বলেছে, ‘নারে কাটা যাবে না। গাছটাকে টিপন বেশ পছন্দ করে।’ ফুপির কথা শুনে টিপন বলেছে, ‘ফুপি, যদি তুমি গাছ কাট তাহলে তোমার লম্বা চুল আমি কেটে দেব। একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখবে তোমার সুন্দর চুলগুলো আর নেই। তখন তোমাকে দেখাবে ন্যাড়া মাথা রবোট সোফিয়ার মতো।’ ফুপি বলেছে, ‘থাক বাবা। আমার গাছ কাটার দরকার নেই।’
একদিন বিকেলে রিমু আর টিপন ব্যাডমিন্টন খেলছিল বারান্দায়। হঠাৎ টিপন চিৎকার করে উঠল।
‘আপু দেখ দুটো ডিম।’
‘তাই তো ডিম এলো কোত্থেকে?’ রিমুর প্রশ্ন।
‘আপু এ দুটো তো মুরগির ডিম না। বেশ ছোট পাখির ডিম হবে নিশ্চয়।’ টিপন বলে।
ওদের দুজনের কথা বার্তা শুনে ছোট ফুপি শাহানা চলে আসে।
‘আরে, তাই তো ডিম এলো কোত্থেকে? চল, এ দুটোকে ভেজে নিয়ে মজা করে খাই।’
টিপন চিৎকার করে বলে, ‘না, না। এ ডিম খেতে পারবে না। তোমার ইচ্ছে করে ফ্রিজ থেকে ডিম ভেজে খাও।’
বারান্দায় টিপনের দিদা এলেন। বললেন, ‘নিশ্চয় এ দুটো শালিক পাখির ডিম। আমি দুটো শালিককে গাছে বাসা বানাতে দেখেছি।’
রিমু বলল, ‘না, না। এগুলো কাকের ডিম হতে পারে।’
ছোট ফুপি বলল, ‘না, না। এগুলো চড়–ই পাখির ডিম।’
একটা ছোট বাটির মধ্যে করে টিপন ডিম দুটো ড্রয়িং রুমে নিয়ে এলো।
‘বাবা, দেখে তো এগুলো কোন্ পাখির ডিম?’ টিপন প্রশ্ন করে।
বাবা রেগে বলেন, ‘এটা তোমার ঠিক হয়নি। পাখির বাসা থেকে ডিম আনা ঠিক হয়নি।’
দিদা বলেন, ‘না রে ফিরোজ। ও বাসা থেকে ডিম আনতে যাবে কেন। ডিম দুটো বারান্দায় পড়েছিল।’
‘মা, আমি এত কথা শুনতে চাই না। ও যেখান থেকে ডিম এনেছে, ডিম দুটো সেখানে রেখে আসুক।’
ছোট ফুপু হেসে বলে, ‘চল টিপন। আমরা ডিম দুটো বারান্দায় রেখে আসি।’
টিপনের বাবা শাহানার দিকে তাকিয়ে দাঁত কটমট করে তাকালেন। ভাইয়ের রাগ দেখে শাহানা হেসে দিল।
মা এসে বললেন, ‘ডিম কোথা থেকে এলো?’
শাহান বলল, ‘ভাবি, দুটো পাখি ডিম দুটো আমাদের বারান্দায় রেখে গেল। আর বলল, আমাদের সময় নেই। ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা তোলার। ডিমে বসে বসে তা দেয়ারও সময় নেই। আমরা দুজনই চাকরি করি।’
ভাবি ক্ষেপে গেলেন শাহানার কথায়। বললেন, ‘তাহলে এক কাজ কর। তুই ডিমে তা দে। তুই অনেক দুষ্টু হয়েছিস শাহানা।’
দিদা বললেন, ‘শাহানা এক কাজ কর। তুলা নিয়ে আয়। নরম ন্যাকড়া নিয়ে আয়।’
টিপন আর শাহানা ন্যাকড়া আর তুলা নিয়ে এলো। তারপর দিদা সেগুলো একটা ছোট ঝুড়িতে রাখল। দিদা খুব যতœ করে ডিম দুটো তুলো দিয়ে ঢেকে দিল। তার উপর ন্যাকড়া রাখল।
টিপন জানতে চায়, ‘এখন কী হবে দিদা?’
‘এখন কি হবে বুঝিস না? এখন ডিম ফুটে বাচ্চা হবে।’ কথা শুনে টিপন আনন্দে লাফিয়ে উঠে।
প্রতিদিনই টিপন ঝুড়িতে উঁকি দিয়ে দেখে বাচ্চা ফুটেছে কিনা। দিদাও উঁকি দেয়।
শাহানা টিপনের মাও ঝুড়ির দিকে এগিয়ে যায়।
ফিরোজ সাহেবও লক্ষ রাখছেন বাচ্চা হচ্ছে কিনা।
একদিন ভোরে চিঁ চিঁ শব্দ পেল টিপন। সে বিছানা থেকে উঠে দৌড়ে গেল ঝুড়ির কাছে। সে দেখল ডিম থেকে দুটি বাচ্চা গলা বের করে আছে। ডিমের ভেতর থেকে বাকি শরীর বের করার চেষ্টা করছে।
টিপন ডাকল, ‘দিদা, আম্মু, ফুপি, বাবা দেখে যাও।’ সবাই তখন ঘুমিয়েছিল। তাদের সবার ঘুম ভেঙে গেল। তারা দৌড়ে এলো ঝুড়ির কাছে।
বাচ্চা দেখে সবাই খুশি।
ধীরে ধীরে বাচ্চা দুটি বড় হচ্ছে। দিদা বললেন, ‘এটা শালিক পাখির বাচ্চাই হবে।’
বাবা বললেন, ‘আমার এ বিষয়ে কোন ধারণা নেই।’
টিপনের মা বলল, ‘উট পাখির বাচ্চা হতে পারে।’ তার এই বোকামির কথা শুনে সবাই হেসে দিল।
শাহানা বলল, ‘আমি ফাইনাল। এ দুটো চড়–ই পাখির বাচ্চা।’
টিপন বলল, ‘আমি আরও চিন্তা করি বলি।’
কাজের বুয়া এসে বলল, ‘এত চিন্তা কিসের। আর একটু বড় হইলেই বোঝা যাইব। হেরা কাক না ঘুঘুর বাচ্চা।’
রাতের বেলা টিপন দিদাকে বলল, ‘দিদা দুটো দোয়েল পাখি বসে আছে গাছে। মনে হয় ওরা দোয়েল পাখির বাবা-মা। চল টর্চ দিয়ে দেখে আসি।’
দিদা আর টিপন গেল বারান্দায়। টিপন টর্চ ধরল পাখিদের উপর। পাখি দুটো নড়েচড়ে বসল।
দিদা বললেন, ‘সত্যিই তো দোয়েল পাখি।’
পাখি দুটো আরও বড় হলো।
‘ও মা এ যে শালিক পাখির বাচ্চা।’
সত্যি প্রমাণিত হলো দুটোই শালিক পাখির বাচ্চা। টিপনের মন খারাপ হলো। সে যা ভেবেছিল তা হলো না। ওরা দোয়েল পাখির বাচ্চা না।
বাবা নীলখেত থেকে খাঁচা কিনে আনলেন। তারপর সে দুটিকে বারান্দায় ঝুলিয়ে দিলেন।
ছোট খালা এলেন খুলনা থেকে। তিনি শুনে বললেন, ‘হায় হায় পাখি দুটিকে খাঁচায় রাখছ কেন। এরা তো এখানে জন্মেছে। ওরা তো আর উড়ে যাবে না।’
সত্যি পাখি দুটিকে ছেড়ে দেয়া হলো। পাখি দুটি বাসাতেই থাকে। ঘরের মধ্যে উড়ে বেড়ায়। বারান্দায় গিয়ে বসে।
বিকেল বেলা ছোট খালা যাবেন বেড়াতে। বেশ সাজুগুজু করেছেন। হঠাৎ একটি শালিক পাখি তার মাথায় এসে বসল।
টিপন বলল, ‘খালামণি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক। আমি একটা ছবি তুলব। সে মোবাইলটা আনতে আনতে পাখিটা পুচ করে বাথরুম করে দিল তার মাথায়। তার পুরো কাপড়েও ছড়িয়ে গেল।
কা- দেখে সবাই হাসাহাসি করছে। দিদাও হাসছেন। খালামণি মন খারাপ করলেন। তারপরও তিনি হাসলেন।
রাতে খালু এলেন। টিপুকে বললেন, ‘টিপু ওরা কিন্তু কথা বলতে পারে। তোমাকে এক কাজ করতে হবে। এদের সঙ্গে প্রতিদিন কথা বলতে হবে। অন্তত এক ঘণ্টা। তাহলে দেখবে ওরা কথা শিখে গেছে।’
সেই রাত থেকেই টিপন লেগে গেল কথা বলার কাজে। সে শালিক পাখিদের নানা কথা শোনায়। কার নাম কি সেটা বলে। প্রতিদিন সে এই কাজ করে। স্কুল থেকে ফিরেই পাখিদের কথা বলানোর চেষ্টা করে।
বাবা বললেন, ‘টিপনের মা। অবস্থা তো খারাপ। টিপন তো সারাক্ষণ পাখি দুটির সঙ্গেই থাকে। পড়াশোনায় মন নাই। কি করা যায় বলত?’
মা বললেন, ‘চল পাখি দুটোকে ধরে খাঁচায় ভরি। তারপর দূরে কোন জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে আসি।’
সকালে স্কুলে চলে গেল টিপন। তারপর টিপনের মা পাখি দুটিকে ধরে খাঁচায় ভরল।
টিপনের বাবা আর মা পাখি দুটিকে ছেড়ে দিলেন। তাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মীরপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনে। পাখি দুটি গাছের উঁচু ডালে গিয়ে বসল। তারপর টিপনের মা-বাবা শ্যামলীর বাসায় চলে এলো।
স্কুল থেকে বাসায় ফিরেই টিপন কান্নাকাটি শুরু করল। দিদা টিপনকে সান্ত¡না দিল। কিন্তু টিপনের কান্না থামেই না।
বাবা বললেন, ‘টিপন ভালই হয়েছে। ওরা এখন নিজেদের মতো থাকবে। গাছে বাসা বানাবে। আকাশে উড়ে বেড়াবে।
অনেক রাতে টিপন না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ল। হঠাৎ পাখির ডাকে তার ঘুম ভেঙে গেল।
পাখি দুটি ডাকছে-
‘টিপন। টি প ন...।’
টিপন লাফিয়ে উঠল। সে দৌড়ে গেল বারান্দায়। ওরা বসে ছিল বারান্দার রেলিংয়ে। টিপনকে দেখেই ওরা উড়ে এসে বসল তার হাতে।
বারান্দা থেকে ঘরে এসে টিপন সবাইকে ডাকল।
দিদা উঠে এলেন বিছানা থেকে।
একটি পাখি বলল, ‘দিদা, দিদা।’ দিদা অবাক।
শাহানা এলো।
আরেকটা পাখি বলল, ‘শানা ফুপি, শানা ফুপি।’
হৈচৈ শুনে বাবা-মাও উঠে এলেন। পাখি দুটো একসঙ্গে বলল, ‘বাবা, বাবা। আম্মু, আম্মু।’
টিপন পাখি দুটোকে বুকে জড়িয়ে ধরল।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: