ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বঙ্গবন্ধুর চেতনা মুছে ফেলতেই ঘাতকরা তাকে হত্যা করে

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ১১ আগস্ট ২০১৮

  বঙ্গবন্ধুর চেতনা মুছে ফেলতেই ঘাতকরা তাকে হত্যা করে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ‘বঙ্গবন্ধুর চেতনা বলতে আমরা বুঝি তাঁর চার নীতিকে। আর এই চেতনার জন্যই তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। কারণ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা না করলে ইতিহাস থেকে তাঁর চেতনাকে মুছে ফেলা যেত না, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসও মুছে ফেলা যেত না। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধীদের যে বিচার শুরু করেছিলেন সে বিচার বন্ধ করা যেত না এবং বঙ্গবন্ধুকে হত্যা না করলে তো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশোধ নেয়া যেত না। বঙ্গবন্ধুকে যারা খুন করেছেন তাঁরা নীল নকশা অনুযায়ী কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর চেতনাকে মুছে ফেলতেই ঘাতকরা তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে।’ ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে একক বক্তৃতা প্রদানকালে সাংবাদিক, গবেষক ও চলচ্চিত্রকার শাহরিয়ার কবির এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনীর উদ্যোগে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে শুক্রবার শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে বিকেলে এই বক্তৃতার আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলা ভাষার বিশিষ্ট সাহিত্যিক ড. বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। একক বক্তৃতাকালে শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে যখন বঙ্গবন্ধু সংবিধান প্রণয়ন করেন তখন জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতাÑ এই চারটি মূলনীতি ছিল। এই চার নীতি নিয়ে বঙ্গবন্ধু অসংখ্যবার বলেছেন, আমরা শুধু একটি ভূখন্ড বা পতাকার জন্য যুদ্ধ করিনি বরং কতগুলো মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করার জন্য যুদ্ধ করেছি।’ বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনে দিল্লীতে দেয়া প্রথম ভাষণের বিষয়ে বলেন, ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে স্বদেশে ফিরে আসেন। বাংলাদেশে ফেরার পথে দিল্লীতে যাত্রাবিরতিকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর জন্য এক বিশাল গণসংবর্ধনার আয়োজন করেছিলেন। এই সংবর্ধনা সভায় বঙ্গবন্ধু এবং ইন্দিরা গান্ধী- দু’জনের ভাষণই ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সংক্ষিপ্ত এক ভাষণে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মহান বন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় জনগণের উদ্দেশে বলেছিলেন- আমি আপনাদের তিনটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। আমার প্রথম প্রতিশ্রুতি ছিল বাংলাদেশের শরণার্থীদের আমি সসম্মানে ফেরত পাঠাব। আমার দ্বিতীয় প্রতিশ্রুতি ছিল বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীকে আমি সবরকম সহযোগিতা করব। আমার তৃতীয় প্রতিশ্রুতি ছিল শেখ মুজিবকে আমি পাকিস্তানের কারাগার থেকে বের করে আনব। আমি আমার তিনটি প্রতিশ্রুতিই পূরণ করেছি। শেখ সাহেব তাঁর দেশের জনগণকে একটিই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন- তিনি তাদের স্বাধীনতা এনে দেবেন। তিনি তাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। এর জবাবে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেছিলেন, আমাকে বলা হয়েছে ভারতের সঙ্গে আপনার কিসের এতো মিল? আমি বলেছি ভারতের সঙ্গে আমার মিল হচ্ছে নীতির মিল। আমি বিশ্বাস করি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতায়। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীও তাই বিশ্বাস করেন। আমাদের এই মিল হচ্ছে আদর্শের মিল, বিশ্বশান্তির জন্য। সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু একই দিনে দেশে ফিরে রমনার বিশাল জনসমুদ্রে আবারও বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে আর তার ভিত্তি বিশেষ কোন ধর্মীয়ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।’ এদিন তিনি তার ভাষণে ধর্ম নিরপেক্ষতার ওপর বেশি জোর দেন। শাহরিয়ার কবির বলেন, ৭২-এর সংবিধানে ধর্মের নামে রাজনৈতিক দল গঠন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল কিন্তু ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে ধর্মপালন ও প্রচারের অবাধ স্বাধীনতা ছিল। বাংলাদেশের মতো অনগ্রসর মুসলমানপ্রধান দেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক আদর্শের এই স্বীকৃতি নিঃসন্দেহে ছিল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। স্বাধীন বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যাঁদের ’৭২-এর সংবিধান যাঁরা রচনার দায়িত্ব প্রদান করেছিলেন তাঁদের সামনে ছিল যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, তুরস্ক, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের সংবিধান। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সংবিধানসমূহ তাঁরা অধ্যয়ন করেছেন। তাঁরা পর্যালোচনা করেছেন এই সব সংবিধানের সবলতা ও দুর্বলতা। লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের জন্য শ্রেষ্ঠতম সংবিধানটি তাঁরা রচনা করবেন। বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা সংযোজন করার সময় বঙ্গবন্ধু এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বহুবার বলেছেন, ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ ধর্মহীনতা নয়। প্রত্যেক মানুষের নিজ নিজ ধর্ম পালন ও প্রচারের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে। শুধু রাষ্ট্র ও রাজনীতি ধর্মের ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকবে, কোন বিশেষ ধর্মকে প্রশ্রয় দেবে না। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ধর্মের পবিত্রতা রক্ষা এবং ধর্মের নামে হানাহানি এবং ধর্মব্যবসা বন্ধের জন্যই এই নিষেধাজ্ঞা প্রয়োজন। এতে ধর্ম ও রাষ্ট্র দুই-ই নিরাপদ থাকবে। সেই সময় অনেক বামপন্থী বুদ্ধিজীবী ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাঁদের বক্তব্য ছিল সেক্যুলারিজমের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে- ‘ইহজাগতিকতা’। ইউরোপে যারা নিজেদের সেক্যুলার বলে দাবি করে তারা ঈশ্বর-ভূত-পরলোক কিংবা কোন সংস্কারে বিশ্বাস করে না। বঙ্গবন্ধু কখনও সে ধরনের সেক্যুলারিজম প্রচার করতে চাননি বাংলাদেশে। এ কারণেই বঙ্গবন্ধুকে বলতে হয়েছে- ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ ধর্মহীনতা নয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশের প্রতিটি মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের বদৌলতে ধর্ম কিভাবে গণহত্যা ও ধর্ষণসহ যাবতীয় ধ্বংসযজ্ঞের সমার্থক হতে পারে। যে কারণে ’৭২-এর সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি কারও মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেনি। এভাবেই অনন্য হয়ে উঠেছিল ’৭২-এর সংবিধান। বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতা আর তুরস্কের প্রেসিডেন্ট কামাল আতাতুর্কের ধর্মনিরপেক্ষতা এক নয় বলে মন্তব্য করে শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘১৯২৮ সালে মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক ধর্মনিরপেক্ষতাকে তুরস্কের রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করতে গিয়ে সকল ধর্মীয় দল, প্রতিষ্ঠান এমনকি সুফীদের মাজারও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। মসজিদের সংখ্যা সীমিত করে আরবির বদলে তুর্কি ভাষায় আজান চালু করেছিলেন। আমেরিকার হস্তক্ষেপ ছাড়াও এ নিয়ে তুরস্কের ভেতরও যথেষ্ট ক্ষোভ ছিল, বিশেষভাবে গ্রামাঞ্চলে। কামাল আতাতুর্কের ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল ফ্রান্সের অনুরূপ, যেখানে সরকার ও রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের কোন সম্পর্ক ছিল না। বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা ছিল বাঙালীর হাজার বছরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিনির্ভর। যেখানে রাষ্ট্র ধর্মের ক্ষেত্রে কোন বৈষম্য করবে না, সকল ধর্মকে সমান মর্যাদা দেয়া হবে। মুসলিম বিশ্বে ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে পশ্চিমা জগৎ কামাল আতাতুর্কের কট্টর মতবাদ সম্পর্কে যতটা জানে বঙ্গবন্ধুর উদার মতবাদ সম্পর্কে সে তুলনায় কিছুই জানে না। ধর্মের রাজনীতি বন্ধ করার বিষয়টি বঙ্গবন্ধু সংবিধানে যোগ করেছিলেন। যা আমেরিকান, ফ্রান্স কিংবা ইউরোপের সংবিধানে নেই। এটি বঙ্গবন্ধুর একটি বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত ছিল। শাহরিয়ার কবির বলেন, সমাজতন্ত্র নিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘আমাদের সমাজতন্ত্র মানে শোষণহীন সমাজ। সমাজতন্ত্র আমরা দুনিয়া থেকে হাওলাত করে আনতে চাই না। একেক দেশ একেক পন্থায় সমাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে চলেছে। সমাজতন্ত্রের মূলকথা হলো শোষণহীন সমাজ। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে সেই দেশের কি আবহাওয়া, কি ধরনের অবস্থা, কি ধরনের মনোভাব, কি ধরনের আর্থিক অবস্থা, সবকিছু বিবেচনা করে ক্রমশ এগিয়ে যেতে হয় সমাজতন্ত্রের দিকে এবং তা আজকে স্বীকৃত হয়েছে। রাশিয়া যে পন্থা অবলম্বন করেছে, চীন তা করেনি। তারা নিজ দেশের পরিবেশ নিয়ে, নিজ জাতির পটভূমি নিয়ে সমাজতন্ত্রের অন্য পথে চলেছে। সেজন্য দেশের পরিবেশ, দেশের মানুষের অবস্থা, তাদের মনোবৃত্তি, তাদের রীতিনীতি, তাদের আর্থিক অবস্থা, তাদের মনোভাব, সবকিছু দেখে ক্রমশ এগিয়ে যেতে হয়। একদিনে সমাজতন্ত্র হয় না।’
×