ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সাপে-নেউলে সম্পর্ক চউক ও চসিকের

চট্টগ্রামে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় কিছু মহলের দ্বন্দ্ব

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ১১ আগস্ট ২০১৮

চট্টগ্রামে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় কিছু মহলের দ্বন্দ্ব

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ ভৌগোলিকভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকার কারণে চট্টগ্রাম মহানগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামজুড়ে বর্তমান সরকার বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয়ে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এসব প্রকল্প সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হলে এর সুফল শুধু চট্টগ্রামবাসী নয়, দেশ ও জাতির জন্যও ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি করবে। এসব প্রকল্পের বেশকিছু ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে। কিছু বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় রয়েছে। আর কিছু বাস্তবায়নে তোড়জোড় চলছে। এসব প্রকল্পের বড় একটি অংশ চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) ওপর অর্পিত হয়েছে। যেখানে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) কার্যক্রমের বড় একটি অংশও সরকার চউককে প্রদান করেছে। বিষয়টি নিয়ে বর্তমানে চউক ও চসিকের মধ্যে ব্যাপক দ্বন্দ্ব দিন দিন ঘনীভূত হচ্ছে। প্রকাশ্যে না হলেও এই দুই সংস্থা একে অপরের মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। এর সঙ্গে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে চট্টগ্রাম ফোরাম নামের একটি সংগঠন। এ সংগঠনের পক্ষে ইতোমধ্যে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে গৃহীত মেগা প্রকল্পের প্রতিটি কাজ জনসাধারণকে অবহিত করার দাবি উত্থাপন করা হয়েছে। যা আদৌ কারও পক্ষে সম্ভব কিনা তা নিয়েও নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। পাশাপাশি সেনাবাহিনী দিয়ে নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন কর্মকা- চালানো তাদের মতে ঠিক হচ্ছে না বলে দাবি করা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, সরকার পক্ষে সিদ্ধান্ত দিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প চউকের ওপর অর্পণ করেছে। এসব প্রকল্পের বেশ কয়েকটি চসিকের পক্ষ থেকেও পেশ করা হয়েছিল। কিন্তু সরকারের নীতি নির্ধারক মহল চসিকের প্রদত্ত প্রকল্প নাকচ করে দিয়ে একই ধরনের চউক প্রদত্ত প্রকল্প গ্রহণ করে অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে। মূলত এসব নিয়েই এই দুই সংস্থার মধ্যে এখন দ্বান্দ্বিক অবস্থা। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, চসিক মেয়র নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। আর চউক চেয়ারম্যান একই সংগঠনের কোষাধ্যক্ষ পদে অধিষ্ঠিত। চউক সূত্র জানায়, ছোট ছোট প্রকল্পসহ চট্টগ্রামের জন্য কয়েক হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। তার মতে, সত্যিকার অর্থেই বর্তমান সরকারের নির্দেশে এই এক বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পাদিত হচ্ছে। এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে ২০০৯ সাল থেকে। সূত্র মতে, ইতোমধ্যে বিভিন্ন প্রকল্প সম্পন্ন হয়েছে। কিছু চলমান রয়েছে, আর কিছু প্রকল্প শুরুর প্রক্রিয়ায় রয়েছে। গৃহীত মেগা প্রকল্পসমূহ সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হলে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম পঞ্চাশ বছর এগিয়ে যাবে সূত্র জানায়। চউকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ইতোমধ্যে চারটি ফ্লাইওভারসহ অভ্যন্তরীণ রোড নেটওয়ার্কের কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া আবাসন প্রকল্প, ফ্ল্যাট নির্মাণ, ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম কলেজের অবকাঠামো উন্নয়ন, স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা, মহিলা ডরমেটরি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। চউক চেয়ারম্যান আরও জানান, চট্টগ্রামে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগের বিষয়টি বিবেচনায় এনে সংস্থার পক্ষ থেকে পরিকল্পিতভাবে অবকাঠামোগত উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে সাগরিকা রোড ঢাকা ট্রাংক রোড, পাঠানটুলি রোড, সদরঘাট রোড, ফিরিঙ্গীবাজার রোড, আন্দরকিল্লা জংশন থেকে লালদীঘি পর্যন্ত রোড, সিরাজ-উদ-দৌলা রোড, বহদ্দারহাট থেকে গনি বেকারি রোড, অলি খাঁ মসজিদ থেকে অক্সিজেন পর্যন্ত রোড, বায়েজিদ বোস্তামী রোড, অক্সিজেন থেকে কুয়াইশ পর্যন্ত রোড, বহদ্দারহাট থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত রোড, নক্সাস শিল্প এলাকা রোড, মোহরা রোডের সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন কর্ম ইতোমধ্যে সম্পাদিত হয়েছে। এছাড়া প্যারেড ময়দানের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বহদ্দারহাট জংশনে ও দেওয়ান জংশনে ওভারপাস নির্মাণ, কদমতলী জংশনে ফ্লাইওভার নির্মাণ, অন্যান্য, কল্পলোক, সিলিমপুর আবাসিক এলাকার প্রকল্পের কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া চউক মেহেদীবাগ অফিসার্স কোয়ার্টার, নিউ মার্কেটের বি ব্লকে নতুন ভবন, চউক পাবলিক স্কুল এ্যান্ড কলেজ, চউক গার্লস স্কুল ভবন নির্মাণ, বাকলিয়া ডিসি রোডের সম্প্রসারণ, কাজির দেউড়ির কাঁচাবাজার ও এপার্টমেন্ট নির্মাণ, কুয়াইশ জংশনে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল প্রতিষ্ঠা সফরভাবে সম্পন্ন হয়েছে। চউক চেয়ারম্যান দাবি করেছেন, বহদ্দারহাট এমএ মান্নান ফ্লাইওভারের সুফল পাচ্ছে চান্দগাঁও, বোয়ালখালী, বৃহত্তর বাকলিয়াসহ উত্তর-দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিপুলসংখ্যক মানুষ। চট্টগ্রামের বিভিন্ন পয়েন্টে সঙ্কীর্ণ সংযোগ সড়ক এক লেন থেকে চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে। নির্মিত হয়েছে কদমতলী ফ্লাইওভার ও দেওয়ানহাট ওভারপাস। এটি আভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্কের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। গৃহীত প্রকল্পের মধ্যে মুরাদপুর থেকে লালখান বাজার ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আবার পতেঙ্গা থেকে সিটি আউটার রিং রোড নির্মাণ, বায়েজিদ বোস্তামী থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত বাইপাস রোড নির্মাণ, সিডিএ স্কয়ার ফ্ল্যাট প্রকল্প, দেওয়ানহাট ফ্ল্যাট প্রকল্প, সল্টগোলায় শপিংমলসহ বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ, কনস্ট্রাকশন অব এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে- যা হবে লালখান বাজার থেকে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর পর্যন্ত বিস্তৃত। এছাড়া নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রথম পর্যায়ে ৩৬টি খালের সংস্কার ও উন্নয়ন কাজে হাত দেয়া হয়েছে। এছাড়া ননরেসিডেন্ট বাংলাদেশীদের জন্য অনন্যা উপশহর প্রকল্পে ৩ হাজার প্লট সৃষ্টি করা হয়েছে। সিরাজ-উদ-দৌলা রোড থেকে শাহ আমানত ব্রিজ পর্যন্ত বাকলিয়া এক্সেস রোডও নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলেছে। চউক সূত্র আরও জানায়, ভবিষ্যত উন্নয়নের দ্বার হিসেবে সরকার চট্টগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, শিল্প পার্ক, বিদ্যুত পল্লী, গভীর সমুদ্রবন্দর, পর্যটন শিল্প খাতে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়ে এসব প্রকল্পের কাজও শুরু হয়েছে। পতেঙ্গা সাগর পাড়ে প্রায় ৫শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে বিশ্বমানের পর্যটন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। এসব প্রকল্প চউকসহ বিভিন্ন সংস্থার ওপর অর্পিত হয়েছে। ফলে চসিক বড় ধরনের কোন প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ পায়নি। কেন পায়নি এ নিয়ে নানা আলোচনা সমালোচনার ডাল বিস্তৃত রয়েছে। চউক সূত্র মতে, বিষয়টি সরকারের উচ্চ মহলের সিদ্ধান্তের ফলশ্রুতি। চসিকের পক্ষ থেকেও তাদের দীর্ঘদিনের বিভিন্ন কার্যক্রম প্রকল্প অন্য সংস্থার হাতে অর্পিত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে নাখোশ। সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন ইতোমধ্যে জানান দিয়েছেন, চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসন নিয়ে তার সংস্থার কোন কাজ এখন আর নেই। এরই মধ্যে পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরাম নামের সংস্থার পক্ষ থেকে গত মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করে বিভিন্ন দাবি দাওয়া পেশ করেছে। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জলাবদ্ধতা নিরসনের কর্মকা- সেনাবাহিনী দিয়ে সম্পাদন করার বিষয়টি ঠিক নয় বলে তাদের অভিমত। এছাড়া প্রতিটি কর্মকা- কিভাবে সম্পাদিত হচ্ছে তা জনগণকে অবহিত করারও দাবি জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে বিস্ময় প্রকাশ করে জানানো হয়েছে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপিত হলে তা নিয়ে করণীয় সম্পাদনের প্রক্রিয়া রয়েছে। তারা যেভাবে প্রতিটি কর্মকা-ের বিষয় কিভাবে সম্পাদিত হচ্ছে তা জনগণের কাছে প্রকাশ করার যে দাবি জানানো হয়েছে তা ঢালাও বক্তব্য। ফোরামের সভাপতি প্রফেসর মু. সিকান্দার খান সংবাদ সম্মেলনে সুনির্দিষ্টভাবে বলেছেন, কাজের দায়িত্ব আর্মিকে দেয়া হয়েছে বলে চুপ করে থাকলে হবে না। সব কাজে আর্মিকে জড়ানো কি ঠিক-তিনি প্রশ্ন রাখেন। এসব নিয়ে বুধবার চউক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালামের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে জনকণ্ঠকে জানান, সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে সংস্থার ওপর যেসব দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে তা সুচারুরূপে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এক্ষেত্রে সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে নানা বক্তব্য আসা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারণ, উন্নয়ন কর্মকা- নিয়ে নানা মহলের নানা মত থাকতেই পারে। তিনি সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সব মহলের আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করেন। তিনি জানান, ইতোমধ্যে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে তার সুফল জনগণ ভোগ করছেন। তবে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে নাগরিকদের স্বাভাবিক চলাচল ব্যবস্থায় সাময়িক দুর্ভোগ যে হয়েছে তা অস্বীকার করার কোন জো নেই। তার মতে, দীর্ঘদিনের জঞ্ঝাল সংস্কার এবং নতুন নতুন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গেলে বহুক্ষেত্রে যে দুর্ভোগ নেমে আসে তাও সাময়িক। কিন্তু সফলতা দীর্ঘ সময়ের জন্য। এটি সকলকে মানতেই হবে। বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে ইতোমধ্যে যেসব অভিযোগ রয়েছে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে পাওয়া গেলে অবশ্যই তা খতিয়ে দেখা হবে। এছাড়া সরকারী বিভিন্ন সংস্থার নজরদারিত রয়েছেই। সঙ্গত কারণে এসব নিয়ে অগ্রহণযোগ্য বক্তব্য দিয়ে অনাহূত বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার কোন সুযোগ নেই। তিনি জানান, চউক একটি সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থা। বোর্ড দিয়ে পরিচালিত। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কাউকে পাস কাটিয়ে কিছু করার একক ক্ষমতা চেয়ারম্যান বা অন্য কারও নেই। আর যেহেতু সরকারী পক্ষেই নগরীর বিভিন্ন জঞ্ঝাল, বিশেষ করে খালসহ বিভিন্ন সংস্থার কার্যক্রম চউককে দিয়ে বরাদ্দও প্রদান করা হয়েছে, সেক্ষেত্রে সেসব প্রকল্প বাস্তবায়নে চউক বদ্ধপরিকর। তার মতে, খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না, যখন এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের পর চট্টগ্রামের চেহারায় আমূল পরিবর্তন আসবে। জলাবদ্ধতা চট্টগ্রামের দীর্ঘদিনের নাগরিক সমস্যা এ সমস্যা থেকে উত্তরণে যে উদ্যোগ ও প্রকল্প নেয়া হয়েছে তার সুফলও আগামী দুয়েক বছরের মধ্যেই নগরবাসী পাবে বলে তিনি দৃঢ় মত ব্যক্ত করেন।
×