ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

গফরগাঁওয়ের জয়িতা শিবলী আক্তার

কঠোর পরিশ্রম আর আত্মবিশ্বা- অভাব জাদুঘরে

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ১১ আগস্ট ২০১৮

কঠোর পরিশ্রম আর আত্মবিশ্বা- অভাব জাদুঘরে

শেখ আব্দুল আওয়াল ॥ নারীর প্রতি অবহেলা দেখে কবির সেই আক্ষেপ করার এখন আর কোন প্রয়োজন নেই। শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-গরিমায় আজ নারী সমাজ পুরুষের পাশাপাশি সমান যোগ্যতায় অগ্রসর হয়ে চলেছে। সে দিনের সেই অভিশপ্ত নারী ধর্মের গন্ডি থেকে বের হয়ে আজ নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে চায় তার দায়িত্ব ও কর্তব্য ষোলআনা বজায় রেখে। শিক্ষার বিপুল ভোজে পুরুষের সঙ্গে নারীরাও পঙ্গুক্তিভোজের অধিকার রয়েছে। নারী আজ জয়যাত্রার পথে পা বাড়িয়েছে। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বাঙালী নারী সমাজ ছিল অবহেলিত, লাঞ্ছিত ও অধিকারহীন। সমাজ ব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে নারী ছিল খুবই পশ্চাৎপদ। পর্দা প্রথার কঠিন বেড়াজালে তারা ছিল অবরুদ্ধ। পুরুষ শাসিত সমাজে নারীদের মানবিক আকাক্সক্ষাগুলো তখন ছিল পদদলিত। বর্তমানে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নারীর অবস্থান ও মানসিকভাবে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। দেশের উন্নয়ন কাজের সকল স্তরে কাজের অবাধ বিচরণ লক্ষণীয়। দীর্ঘদিনের দাসী মনোভাব পরিহার করে তারা যেন আজ জেগে উঠেছে। এজন্য নারী মহিমায় কবি নজরুল ইসলাম লিখেছেন ‘এ বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল, নারী দিল তাতে রূপ-রস-গন্ধ-সুনির্মল’। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, একুশে ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, বাষট্টি, ছেষট্টি, ঊনসত্তর, একাত্তর, সর্বশেষ নব্বই-এর গণআন্দোলনেও নারীরা তাদের স্মরণীয় অবদান করে রাখছে। তেমনি এক জয়িতা নারী ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার পাগলা থানার কান্দিপাড়া গ্রামের শিবলী আক্তার। অভাব যার নিত্য সঙ্গী। বাবার বাড়ি থেকে সে অভাবকে শাড়ির আঁচলে বেঁধে শ^শুর বাড়িতে যাত্রা তার। ভেবেছিলেন, বাবার বাড়ি থেকে বিদায় হলেই বুঝি অভাবও বিদায় নিবে। কিন্তু না, অভাব পিছু ছাড়েনি! অভাবের রোষানালে পড়ে দিন মজুর স্বামী-সন্তান নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন যাপন করেছিলেন তিনি। আত্মপ্রত্যয়ী ও কর্মঠ মনের অধিকারী হওয়া কিছু একটা করার অদম্য ইচ্ছে তাকে তাড়িয়ে বেড়াত। কিন্তু অর্থ সঙ্কট তার এই অদম্য ইচ্ছাগুলোকে বার বার বাহু বন্দী করে রাখে। বাবার বাড়ি ও স্বামীর অল্প রোজগার থেকে কিছু টাকা জমিয়ে একটি উন্নত জাতের গাভী ক্রয় করেন। সেই থেকে শুরু। তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। মাত্র তিন বছরের অদম্য ইচ্ছা কঠোর পরিশ্রম আর আত্মবিশ^াস অভাবকে যেন জাদুঘরে পাঠিয়েছেন তিনি। আর্থিক সচ্ছলতার পাশাপাশি পরিশ্রম করে এখন তার খামারে দেশী ও উন্নত জাতের ছোট বড় ১৯টি ষাঁড় এবং গাভী গরু রয়েছে। অভাব অনটনের সংসারে ১৫ ভাই বোনের মধ্যে শিবলী আক্তার সপ্তম। পিতার দুই সংসারের কারণে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা শেষ করার আগেই বিয়ে দেন বাবা। এর পর থেকে শুরু হয় তার সংগ্রামী জীবন। স্বামী বাহিরে থাকে তার কাছে ফোন দেয়ার অপরাধে শ^শুর-শাশুড়ি বাড়ি থেকে বের করে দেয়। তার গর্ভে তখন চার মাসের সন্তান। এমনি অবস্থায় গর্ভে সন্তান নিয়ে কি করবে ভেবে পায় না। অনেক বিনয় করে আবারও শ^শুরের বাড়িতে যাই। কিন্তু শ^শুর কয়েকদিন পর আলাদা করে দেয়। শুরু হয় সংগ্রামী জীবন। বাবার বাড়ি, স্বামী এবং হাঁস-মুরগি পালন করে পঁচাশি হাজার টাকা দিয়ে একটি উন্নত জাতের বকনা গরু কেনেন। এক বছর লালন-পালন করার পর দুটি বাছুর জন্মে। ওই উন্নত জাতের গাভী। এখন হাজারও কষ্টের মাঝে দিন দিন আল্লাহর রহমতে আমার খামারে সেই থেকে শুরু। এখন তার ছোট বড় উনিশটি দেশী-বিদেশী ষাঁড় ও গাভী রয়েছে। শিবলী আক্তার বলেন, জীবনে চলার পথে খেয়ে না খেয়ে শ^শুর বাড়ির লাঞ্ছনা-বঞ্চনা সহ্য করে আজ আমি অনেকটাই স্বাবলম্বী। আজ ইচ্ছা করলেই কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে পারবে না। স্বামীকে বিদেশ পাঠিয়েছি, বহুতল খামার করেছি, বাড়িতে বায়ু-গ্যাস প্ল্যান করেছি। নিজের তৈরি গ্যাস দিয়েই রান্না-বান্না করে সংসার চালাচ্ছি এবং ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করাচ্ছি। আশাকরি এইভাবে চলতে পারলে আগামীতে হয়ত গ্যাসও সাপ্লাই দিতে পারব। তবে আমার খামারে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের কাছে বারবার ধর্ণা দিয়েও তাদের খামারে আনতে পারি নাই। আমি মহিলা মানুষ বলেই তারা আমার খামারের দিকে ফিরেও তাকায় না। যদিও কখনও কখনও আসে পারিশ্রমিক হিসেবে তাদেরকে দিতে হয় ১৫শ’ ২০০০ টাকা। আমি গত ১৬ বছর পরিশ্রম করে তিন বছর যাবৎ সফলতার মুখ দেখছি। আজ আমার কাছে অনেক লোক আসে দেখতে, পরামর্শ নিতে, গরু প্রজনন ট্রেনিং প্রাপ্ত সুলভ ফরাজী নামে এক ব্যক্তি আমার খামারে সর্বক্ষণিক গরুগুলো দেখাশোনা করে। প্রয়োজন মতো চিকিৎসা দিয়ে এবং বাহির থেকেও ডাক্তার এনে আমার খামারের উন্নতির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সম্প্রতি আমার একটা গাভী গরু মূল্য প্রায় ৮০-৮৫ হাজার টাকা হবে। অসুস্থ হয়ে পড়লে গফরগাঁও উপজেলা পশু হাসপাতালে বার বার ডাক্তারদের কাছে গিয়ে তাদেরকে আনতে পারিনি। পরে পাশর্^বর্তী হোসেনপুর উপজেলার এক ডাক্তার এনে চিকিৎসা করাই। তবে গরুটি বাঁচাতে পারি নাই। গফরগাঁওয়ের প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের অবহেলার কারণেই আমার মূল্যবান এই সম্পদ মারা গেছে। লংগাইর ইউনিয়নের সুলভ ফরাজী বলেন, তিল তিল করে শিবলী আক্তার জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে আজ কিছুটা স্বপ্নের পথ দেখছে। আমরা এলাকাবাসী অনেকেই শিবলী আক্তারের খামারে গিয়ে তাকে অনুকরণ করি। এবং কয়েকজন ব্যক্তি এই মহিলার খামার দেখে তারাও খামার তৈরি করেছেন। উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ আনিছুর রহমান বলেন, পৌরসভাসহ ১৫টি ইউনিয়নে স্বল্প সংখ্যক লোক দিয়ে সকলের সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। তবুও সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ডাঃ শামীম রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, অসংখ্য প্রতিকূলতা পেরিয়ে শিবলী আক্তারের যে সফলতা অর্জন তা যুব সমাজের জন্য এবং যারা নিজেদের অসহায় ভেবে হতাশ হন তাদের জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক।
×