ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মোঃ সাখাওয়াত হোসেন

ভয় নয়, পুলিশকে সহযোগী ভেবে পাশে দাঁড়াতে হবে

প্রকাশিত: ০৫:২২, ১১ আগস্ট ২০১৮

ভয় নয়, পুলিশকে সহযোগী ভেবে পাশে দাঁড়াতে হবে

ঢাকায় এক আত্মীয়ের বাসায় দাওয়াতে গিয়েছিলাম। বাসায় পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পাই, বাসার একমাত্র বাচ্চা ছেলেটা খুব উচ্চৈঃস্বরে কান্নাকাটি করছে। বাসার ভদ্র মহিলা আমার উপস্থিতি টের পেয়ে বাচ্চাটিকে আমার সামনে নিয়ে আসেন। আমাকে দেখিয়ে বলেন, এই যে পুলিশ আঙ্কেল আসছে (আমি পুলিশের একটি প্রতিষ্ঠানে কিছু দিন কাজ করেছি), ধরে নিয়ে যাবে। অবাক করার মতো বিষয়, সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাটির কান্না থেমে যায়। পরবর্তীতে বাসায় অবস্থানকালীন বাচ্চাটিকে কোলে নেয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই। বাচ্চাটির ভয়ার্ত চোখই বলে দিয়েছিল, পুলিশ সম্পর্কে বাসায় কতটা নেতিবাচক আলোচনা হয়! আমি এমনও শুনেছি ছেলে/মেয়েদের খাবারের সময় পুলিশের ভয় দেখিয়ে খাওয়ানো হয়ে থাকে। অর্থাৎ আমাদের সামাজিকীকরণ এবং ছেলে/মেয়েদের বেড়ে ওঠা কিন্তু এভাবেই হচ্ছে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম পুলিশকে ভয়ের চোখে দেখে। পুলিশকে ভয়ের চোখে দেখেই বড় হচ্ছে এক শ্রেণীর প্রজন্ম। তার মানে এমন, পুলিশের কোন কাজই ভাল নয়, তারা যা করছে কিংবা করবে সবকিছুতেই দুর্নীতির লোলুপ ছায়া পড়ে থাকে। অথচ, এখনও পর্যন্ত আমাদের নিরাপত্তার জন্য শেষ আশ্রয়স্থল পুলিশ বাহিনী। রাত ১২টার পরেও বাসায় কোনরূপ ঝামেলা হলে আমরা ঠিকই পুলিশের দ্বারস্থ হই। নতুন চালুকৃত পুলিশের হটলাইন ৯৯৯ তে ফোন দিয়ে যখন তখন সুবিধা গ্রহণ করি। কিন্তু মূল্যায়নের সময়ে পুলিশকে মাইনাসের খাতায় ফেলে রাখি, এটাই বাস্তবতা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের প্রশংসা করার মতো অসংখ্য অর্জন থাকা সত্ত্বেও একটি বিশেষ মহল সর্বদা পুলিশের বিরুদ্ধে তটস্থ থাকে। মহান মুক্তিযুদ্ধে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে রাজারবাগে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলে আমাদের পুলিশ বাহিনী। রাজনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতিতে যেমন পেট্রোলবোমা, জ্বালাও-পোড়াও রাজনীতির উত্তাল মাঠে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করে পুলিশ এবং অনেককে জীবনও দিতে হয়েছে। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় পুলিশকে সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়, সন্ত্রাসীদের রক্তচক্ষ উপেক্ষা করে তদন্তের কাজ চালিয়ে যেতে হয়। পুলিশকে নিয়মিতভাবে পেট্রোলিং করতে হয়, ভিআইপি/ভিভিআইপিদের নিরাপত্তা প্রদান করতে হয়, দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় পুলিশ সদস্যের বিরামহীন দায়িত্ব পালন করতে হয়, জাতীয় দিবসগুলোতে বিশেষ করে ঈদ, দুর্গাপূজা, পহেলা বৈশাখ, বিশ্ব এজতেমার সময়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ছুটি না কাটিয়ে জনগণের জানমালের নিরাপত্তার জন্য দায়িত্ব পালন করতে হয়। জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দমনের জন্য অনেককে জীবনও দিতে হয়েছে। পেশাগত দায়িত্বের পাশাপাশি সামাজিক কর্তব্য হিসেবে আমাদের পুলিশ বাহিনী নানাবিধ দায়িত্ব পালন করে চলেছে। অপরাধ ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, বাল্যবিবাহ রোধকল্পে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থা চালুকরণ ও বাস্তবায়ন কল্পে দায়িত্ব গ্রহণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগে যেমন বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসে দায়িত্ব পালন, অপেন হাউস ডে পালন, রক্তদান কর্মসূচী পালন, ভিক্টিম সাপোর্ট সেন্টারের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা প্রদান ইত্যাদি জনসেবামূলক কাজ করে থাকে বাংলাদেশ পুলিশ। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করে চলেছে আমাদের পুলিশ বাহিনী। ইন্টারপোল, সার্কপোল ইত্যাদি সংস্থাতে বাংলাদেশ পুলিশ সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে চলেছে। পুলিশই একমাত্র বাহিনী যারা ২৪ ঘণ্টা আমাদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকে। অথচ, নিরাপদ সড়ক চাই দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় পুলিশ কর্তৃক এক কিশোর ছেলেকে নির্যাতনের চিত্র ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে পড়ে। প্রকৃতপক্ষে ভাইরাল হওয়া ছবিটি ২০১৩ সালের এবং ওই পুলিশ সদস্য বিভাগীয় শাস্তির আওতায় বর্তমানে চাকরিচ্যুত। তাহলে বোঝা যাচ্ছে একটি মহল পুলিশের বিরুদ্ধে উস্কানি দিতে সবসময়ই অগ্রসরমাণ অবস্থায় থাকে। অর্থাৎ পুলিশকে জনগণের প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখানোই তাদের মূল কাজ হয়ে দাঁড়ায়। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক ও চরিত্রহীনতার কাজ। ভালমন্দ মিলিয়েই মানুষ। দেশে প্রায় দুই লাখ পুলিশ সদস্য রয়েছে। সব পুলিশই কি খারাপ কাজের সঙ্গে যুক্ত? কিছু পুলিশ সদস্যের কারণে পুরো পুলিশ বাহিনীকে দোষারোপ করা সঠিক নয়। তবে একটি বিষয় লক্ষণীয়, পুলিশের খারাপ কাজকে যেভাবে বিজ্ঞাপনের ন্যায় প্রচার করা হয়, ভাল কাজগুলোকে সেভাবে প্রচার করার ব্যবস্থা গ্রহণ করলে নিরপেক্ষভাবে যাচাই করার সুযোগ পাওয়া যেত। ছাত্রছাত্রীদের যৌক্তিক আন্দোলনের সঙ্গে পুলিশ সদস্যরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, ছাত্র/ছাত্রীদের বিভিন্ন জায়গায় জুস/পানি সরবরাহের চিত্রও দেখা গেছে। অথচ পুলিশকে উদ্দেশ করে অশোভন উপায়ে খারাপ উক্তিগুলো ভাইরাল করা হচ্ছে। বিষয়গুলো মোটেই শোভনীয় নয়। পুলিশকে জনগণের সহযোগী হিসেবে ভাবা উচিত এবং পুলিশ নানাবিধ সঙ্কটের মধ্যে থেকেও জনগণের জন্য তাদের সর্বোচ্চটা দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। পান থেকে চুন খসলেই পুলিশের বেতন নিয়ে খোটা দেয়া হয়। সকলেই বলাবলি করে থাকে, জনগণের কষ্টের টাকায় পুলিশের বেতন হয়। প্রজাতন্ত্রের সকল কর্মকর্তা কর্মচারীর বেতন জনগণের টাকায় হয়ে থাকে। বেতনের বিষয়ে পুলিশকে যেভাবে নাজেহাল করা হয়, অন্যান্য সরকারী চাকরিতে যারা আছেন তাদের কিন্তু কোনদিন বেতন নিয়ে কটু কথা বলা হয়নি। তার মানে অন্যান্য সরকারী চাকরিতে যারা আছে তাদের কর্তৃক কোনরূপ খারাপ কাজ সংঘটিত হয় না। তাহলে বাংলাদেশ কিভাবে দুর্নীতিতে পরপর ৫ বার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়? এটা কি শুধুমাত্র পুলিশ বাহিনীর জন্য হয়েছে। অবশ্যই নয়, পাশাপাশি অন্যান্য যে সেক্টরের জন্য দুর্নীতিতে আলোচিত হয়েছি সেসব সেক্টরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কখনও আমরা সেভাবে দাঁড়াইনি। পুলিশ বাহিনীর কতিপয় সদস্য যে ঘুষ লেনদেন/আদান প্রদান ও অন্যান্য গর্হিত কাজের সঙ্গে জড়িত নয় সে কথা কিন্তু বলছি না। এর পেছনে কি আমাদের কোন দায় নেই? অনেকাংশে তো আমরা তাদের সুযোগ করে দিচ্ছি। বিশেষ করে ট্রাফিক পুলিশের ঘুষ লেনদেনের কিছু ছবি পত্রিকার পাতায় দেখতে পাই। আচ্ছা আমরা যদি গাড়ির লাইসেন্স, ড্রাইভিং লাইসেন্স ও সড়কের নির্দেশনা সঠিকভাবে মেনে চলি তাহলে তো পুলিশকে ঘুষ দেয়ার প্রয়োজন হয় না কিংবা পুলিশও ঘুষ গ্রহণের সুযোগ পায় না। এখানে কেউ কেউ বলতে পারেন, আমি কি পুলিশের ঘুষ গ্রহণকে উৎসাহ প্রদান করছি। কখনই না, অনৈতিক কাজকে সমর্থন করার প্রশ্নই আসে না। তবে যেভাবে পুলিশকে অপাঙ্ক্তেয় করা হচ্ছে তার পরিপ্রেক্ষিতে কথাগুলো বলতে হচ্ছে। আবার কিছু কিছু জায়গায় পুলিশ যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছে ও হতে হয়। এক পুলিশ অফিসারের লেখনীর মাধ্যমে জানা যায়, এক সাহসী লেডি ইন্সপেক্টর চট্টগ্রাম থেকে আসা এক অবৈধ সোনা চোরাচালানের চক্রকে গ্রেফতার করার উদ্দেশ্যে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে যান। ফোর্স নিয়ে যাওয়ার কারণে দেরি হওয়ায় অবৈধ চালনাকারীদের গাড়ির পিছু নেন তিনি এবং চালনাকারীদের মূল হোতাকে গ্রেফতার করতে পারলেও মালামাল জব্দ করতে পারেননি। কেননা, মূল হোতা জোর-জবরদস্তি করে তার প্রতিষ্ঠানের লোকজনকে দিয়ে মালামাল জব্দকরণে বাধা দেয়। পরবর্তীতে দেখা যায়, মূল হোতা এতটাই প্রভাবশালী যে, সে সময়ের উপ-রাষ্ট্রপতি আইজিপি বরাবর সুপারিশ করেন মূল হোতার জন্য। ফলে প্রভাবশালী মূল হোতার বিরুদ্ধে কোন মামলাই হলো না তদন্ত তো দূরের কথা এবং সেই সাহসী লেডি ইন্সপেক্টর বরখাস্ত হলেন। এ রকম পরিস্থিতিও মোকাবেলা করে কাজ করতে হয় পুলিশকে। পুলিশকে পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও পারিবারিক চাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তাদের প্রতিপক্ষ মনে না করে যথাযথ কাজের পরিবেশ সৃষ্টি করে পরস্পরের সহযোগী হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। তাহলেই সমাজ থেকে উদ্ভূত যে কোন ধরনের অপরাধ প্রতিকার ও প্রতিরোধ করা সম্ভব নিমিষেই। পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা আমাদের কারও ভাই, কারও চাচা কিংবা যে কোন সূত্র ধরেই আত্মীয়ই হয়ে থাকবে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে তারা আমাদের বাংলা মায়ের সন্তান। কাজেই, তাদের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক এবং হয়রানিমূলক অপপ্রচার বন্ধে সবার সতর্ক ও সচেতন হওয়া জরুরী। আধুনিক ও দক্ষ পুলিশিং ব্যবস্থা চালুকরণের প্রচেষ্টা করতে হবে। শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে পুলিশ বাহিনী থেকে সব রকমের অপকর্ম দূর করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে পুলিশকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে আমরা সমাজের জঞ্জাল সাফ করতে পারব না, পুলিশের সহযোগী হয়ে কাজ করতে হবে আমাদের। তদ্রুপ পুলিশকেও আরও জনবান্ধব পুলিশিং এর জন্য দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। তা না হলে, যত আন্দোলন সংগ্রামই করি না কেন আশানুরূপ কোন ফলাফল আসবে না। লেখক : প্রভাষক, ক্রিমিনোলজি এ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
×