ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জি.এম.জোয়ারদার

এমন দিনে তারে বলা যায়...

প্রকাশিত: ০৭:৫৭, ১০ আগস্ট ২০১৮

এমন দিনে তারে বলা যায়...

বৃষ্টি! এই শব্দটি এমন একটি শব্দ যা আবহমানকাল থেকে মানুষের মনে দাগ কেটে আছে। বৃষ্টি, বর্ষা, বাদল, বর্ষাকাল। এই বর্ষাকালের অনেক পুরান কাহিনী আছে। মানুষের জীবনের সঙ্গে জীববৈচিত্র্যের সঙ্গে, গাছ-গাছালি, প্রাণীকুলের সঙ্গে এর সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমাদের বাংলাদেশ ঋতু বৈচিত্র্যের দেশ। ষড়ঋতুর দেশ। গ্রীষ্মকাল, বর্ষাকাল, শরতকাল, হেমন্তকাল, শীতকাল ও বসন্তকাল। বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ এই দুই মাস গ্রীষ্মকাল, আষাঢ় ও শাবণ এই দুই মাস বর্ষাকাল, ভাদ্র ও আশ্বিন এই দুই মাস শরতকাল, কার্তিক ও অগ্রহায়ণ এই দুই মাস হেমন্তকাল, পৌষ ও মাঘ এই দুই মাস শীতকাল, ফাল্গুন ও চৈত্র এই দুই মাস বসন্তকাল। এই ছয় ঋতুর মধ্যে বসন্তকাল হলো ঋতুরাজ। সব থেকে গুরুত্ববহন করে বর্ষাকাল। মুঘল সম্রাট বাদশা আকবরের আমল থেকে আমাদের বঙ্গাব্দ শতাব্দীর গণনা শুরু হয়। সনাতন হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন ভাল-মন্দের সময় অনুসারে এই বাংলা মাসের এবং দিনের নাম রাখা হয়। বাদশা আকবর ভারতবর্ষের তদানীন্তন সময়ে কৃষকদের সঙ্গে এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। তিনি ওইসব মানুষের বিভিন্ন রকম সুবিধা-অসুবিধাগুলো বুঝলেন এবং রাজ দরবারের সভাসদগণের সঙ্গে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করে ইংরেজী সাল ও আরবী হিজরীর পাশাপাশি নতুন একটি সনের উদ্ভাবন করলেন। আর তা হলো বঙ্গাব্দ। অর্থাৎ বাংলা সনের গণনা শুরু হলো। ষড়ঋতুর মধ্যে বর্ষাকালও একটা কাল। এই বর্ষাকাল আমাদের জীবনের সুখ-দুঃখের, হাসি কান্না ও প্রেম-ভালবাসার অমর সাক্ষী হয়ে আছে। ঘুরে ঘুরে বার বার ফিরে আসে আমাদের জীবনের মাঝে। কবির ভাষায় বলতে হয়Ñ ‘এমন দিনে তারে বলা যায়—-’। এমন দিনে অর্থাৎ ঝরো ঝরো শাওনের সন্ধ্যাকালে হয়ত প্রেমিক-প্রেমিকের একে অপরকে কিছু বলা, ভালবাসার কথা বলার প্রবল আকুতি। পড়ন্ত বিকেলে গোধূলী লগ্নে বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় আপন জনকে কাছে পাবার আকুলতা; ব্যথিত করে তোলে না পাওয়ার প্রবল বেদনা। হয়ত সন্ধ্যায় এমনতর বৃষ্টি না হলে এমনটি মনে হতো না। সেকালে অর্থাৎ বর্তমান সময় থেকে আরো ত্রিশ/চল্লিশ বছর আগে গ্রামের গার্হস্থ বাড়ির দহলিজে (বৈঠকখানা) এই ভর সন্ধ্যাকালে বৃষ্টির সময় কাঁচামরিচ, পেঁয়াজ আর খাটি সরিষার তেল দিয়ে এক ধামা মুড়ি মেখে সারাদিনের পরিশ্রান্ত-ক্লান্ত কৃষকগণ মনের সুখে, বড় আনন্দ ময় হয়ে উঁচু-নিচু ভেদাভেদ ভুলে ওই মুড়ি খেত। এই মুড়ি খাওয়ার মধ্যে অফুরন্ত আনন্দ উপভোগ করত। এর মধ্যে কেউ কেউ আবার ভাটিয়ালি সুরের লহরী তুলে, হাতের করতালি দিয়ে ছন্দে ছন্দে গান গাওয়া হতো। সুর হোক আর বে-সুরও হোক সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনত। আবার কেউ কেউ গলা মিলিয়ে কোরাস গাইত। গ্রামের মানুষের এই যে, ক্লান্তি-অবসাদ কোথায় বিলিন হয়ে যেত। বৃষ্টি বেশি বাড়লে অনেকে ঘর-সংসার ভুলে রূপকথার গল্প ফেঁদে সত্য মিথ্যা মিলিয়ে মজার মজার কথা বলে আনন্দ করত, যা উপস্থিত আগন্তকগণ প্রবল হাস্য-রসের মধ্যে ডুবে যেত। সেসব স্মৃতি আজও মানসপটে ক্ষণে ক্ষণে ভেসে উঠে। আমাদের গ্রামীণ জনপদের সঙ্গে বর্ষাকালের নিবিড় সম্পর্ক, যাকে বলে নাড়ির টান আছে, যা যুগ যুগ ধরে বহেমিয়ান। বর্ষাকাল কখনও কখনও মানে অধিকাংশ সময়ই আমাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেয়। গ্রীষ্মের প্রচ- খরা-তাপের পর একটু বৃষ্টি এলে তপ্ত ধরণী ঠা-া হয়, আবহাওয়া ও পরিবেশ দুটাই পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল, গোলাপ জাম, আনারস প্রভৃতি ফলের গাছে শীতে বৌল আসে। আর মুকুল থেকে ধীরে ধীরে তা ফলে পরিণত হয়। এই সময়টা বৃষ্টি খুবই প্রয়োজন। বৃষ্টি না হলে ছোট ছোট কচি ফলগুলো এমনিতেই গরমে গাছ থেকে ঝরে পড়ে। শীতের জরায় গাছের পাতা সব ঝরে যায়। বৃষ্টি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হালকা সবুজ কচি পাতায় গাছ ভরে ওঠে ও প্রকৃতি সজিব হয়ে ওঠে। কি অপূর্ব ধরণী সাজ সাজ হয়ে ওঠে। বনে-বাদাড়ে কত নাম না জানা ফুল ফোটে, বর্ষার আগমন বার্তা জানান দেয়। কদম, কেতকী ফুল ফোটে আর বর্ষা ঋতুর নাচন ওঠে। ধুয়ে যাক মুছে যাক যত গ্লানি আর ক্লেদ। সত্যই বর্ষা এলে সব ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার হয়ে যায়। গাছেরা নড়ে-চড়ে ওঠে, মনে মনে খুব খুশি হয়। ব্যাঙেরাও কম যায় না। একটু বৃষ্টি হলেই ঘ্যাঙর-ঘ্যাং করে গলা ফাটিয়ে সবাই একত্রে বর্ষা এসেছে বলে জানান দেয়। ওদের আনন্দ দেখে কে! কবিগুরুর ভাষায়- নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তীল ঠাঁই আর নাহিরে ওগো আজ তোরা যাসনে গো তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে আষাঢ়ের মেঘের কথা বলে সবাইকে সাবধান করে দিয়ে ঘরের বাইরে যেতে না করছে। তুমুল বর্ষণে-গর্জনে সব জলমগ্ন হয়ে যাচ্ছে। সব একাকার হয়ে যাচ্ছে। কৃষকের ধান, পাটসহ অন্যান্য ফসল, তলিয়ে পানির নিচে চলে যাচ্ছে সব। গরিব কৃষকের প্রভূত ক্ষতি। এ ক্ষতি পোষাবার নয়। তারপরও বর্ষা মধ্যবিত্ত বাঙালীÑচিত্ত আনন্দে ভরিয়ে দেয়।
×