ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

খুরশীদ আলম বাবু

আধুনিকতা ও সাম্প্রতিকতার সমন্বয়

প্রকাশিত: ০৭:৫৬, ১০ আগস্ট ২০১৮

আধুনিকতা ও সাম্প্রতিকতার সমন্বয়

কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর আবির্ভাবলগ্নে মোহিতলাল মজুমদারের মতো সর্বদা তিতি বিরক্ত (মোজাফ্ফর আহমদ কথিত) কট্টর কবি-সমালোচকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে কবিতার মাধ্যমে, সেই কবিতায় নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী সত্তার পরিচয় মেলে না; বরং সেখানে আমরা লক্ষ্য করি দৃষ্টি- বর্ষণের প্রবহমানতায় একজন রোমান্টিক কবির চিত্তস্পর্শী বর্ণনা। বস্তুত একজন কবি কিংবা লেখক- দুই আয়নার অধিবাসী, যিনি একই সঙ্গে হতে পারেন বহিঃপৃথিবী এবং অন্তঃপৃথিবীর বাসিন্দা; কেননা তিনি যেমন তাঁর (সমাজে) বসবাসকালীন সময়ে অনুভব করেন সামাজিক উদ্ভূত পরিবেশের দোজখের অগ্নিফলার তীব্র আঁচ, পাশাপাশি ব্যাকুলিত হন প্রেমের মৌলিক মধুরতম আহ্বানে। সেটাই স্বাভাবিক। পৃথিবীর অন্যান্য সেরা মহৎ কবির মতোন বাংলা সাহিত্য নজরুল ইসলাম এই দুই পৃথিবীর সুমেরু-কুমেরুর দূরবর্তী নক্ষত্র নন; যদিও তাঁর কাব্যে বিদ্রোহের শরীর নিনাদী স্বর ‘জয়ধ্বনিকর’-এর তালে তাল মিলিয়ে নতুনের আগমন প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছিলেন তাঁর সুবিখ্যাত ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতায়। পক্ষান্তরে তিনিই আবার তাঁর ‘সমরজয়ী অমর তরবারী’ একজন মানস প্রিয়ার হাতে সমর্পণ করতে দ্বিধান্বিত হননি; আপাত দৃষ্টিতে এটাকে কূটাভাসিতার লক্ষণ বলে মনে হলেও এরই মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে একজন পরিপূর্ণতাসম্পন্ন মানবতাবাদী কবির সম্যক আচরণ। কারণ নজরুল ইসলাম কমরেড মোজাফ্্ফর আহমদের দীর্ঘ সান্নিধ্যে-অবস্থানকারীদের একজন হয়েও কমিউনিস্ট হননি, রুশ-বিপ্লবের সফলতায় উদ্দীপ্ত হয়ে পরবর্তীকালে ফিরে গেছেন মানবতাবাদী ইসলাম ধর্মের আশ্রয়ে। ফলত, আধুনিক কালের তথাকথিত মননজীবী বুদ্ধিজীবীরা এই দ্বিধাবিভক্ত আচরণের মধ্যে খুঁজে পান প্রতিক্রিয়াশীলতার অনভিপ্রেত স্থুল অথচ তারা ভুলে যান আধুনিক কবিতায় বিংশ শতাব্দীর অন্যতম কবিপুরুষ টিএস এলিয়টের জীবনচর্চার (কাব্য নয়) আচরণের সূত্রটি বিশেষত আমরা যখন তাঁর মুখে শুনতে পাই ক্যাথলিকদের স্তোত্র-বাক্য-শাসনতন্ত্র, রাজতন্ত্র সমর্থনকারী, ধর্মের অশরীরি-অস্তিত্বের অবস্থানগত বিষয় কতটা আধুনিক শব্দাস্ত্র হতে পারে এলিয়টের ‘ঔড়ঁৎহবু ড়ভ ঃযব সধমর’ পড়লে বোধগম্য হয়। সাম্প্রতিককালে ওপার বাংলার বিশিষ্ট কবি দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সম্পাদিত জীবনানন্দ দাশ : বিকাশ-প্রতিষ্ঠার ইতিবৃত্ত’র মতো স্মরণীয় গ্রন্থ নজরুল ইসলামের কবিতার আড়ালে ‘ধর্মাচারের প্রবণতা’ লক্ষ্য করে আবার একই ভুলের পরিচয় দিয়েছেন। বস্তুত আমাদের বিবেচনায় নজরুলই আবার দ্রোহ কোন অতি সরলীকরণতার নির্দেশিত দিক নয়, বরং তার ‘বিষ জ্বালা বুকের’ ধারণকৃত প্রকাশই আধুনিকতার পরিবাহী যে অর্থে ছিলেন আধুনিক ভারতচন্দ্র। সর্বগ্রাসী বিতৃষ্ণ ও নির্বেদের জনক, সর্বব্যাপী দুঃখ এবং পাপের বোধকে কাব্যে রূপায়িত করলেন যে বোদলেয়ার, তিনিও চূড়ান্ত অর্থে আধুনিক বলে আখ্যায়িত হয়েছেন। সুতরাং দেবীপ্রসাদ বাবুদের মতো সাম্প্রতিক অনেক আধুনিক কবিই- নজরুলের ‘ধর্মাচার’-এর যে প্রাসঙ্গিক তথ্যটি উল্লেখ করেন তা রবীন্দ্রনাথের উপনিষদ চর্চার মতো স্বতন্ত্র সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য-সন্ধান অভিমুখী হওয়ার প্রয়াস। কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যের বিবরে বিদ্রোহের যে প্রচ-তম সত্তা সংগুপ্ত রয়েছে, মূলত তা নির্মিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের পৃথিবী থেকে আলাদা, স্বতন্ত্র ভঙ্গিমায়। এলিয়ট যাকে ‘সেনস্ অব স্পিরিট’ বলে অভিহিত করতেন। বস্তুত নজরুল ইসলাম ছিলেন তারই সার্থক উত্তরাধিকার। বিষয়টি জটিল। যেহেতু এই অভিধা প্রাপ্তি নজরুল ইসলামের জন্য কতখানি যোগ্য তা আলোচনার অবকাশ রাখে। ফলত প্রথমেই নজরুলের আবির্ভাবের জ্যোতিস্মান সময়টি অত্যন্ত তাৎপর্যময়, কেননা বাংলা সাহিত্যে নজরুল কবি-খ্যাতি লাভের পূর্বে সৈনিক জীবনে বসবাস কালে উত্তাল হয়েছিলেন হাফিজের সংরক্তময় অতীন্দ্রিয় প্রেমের কবিতার শিহরণে, যা সৈনিক জীবন সমাপ্তির পর অপূর্ব সৈনিক জীবনে বসবাস কালে উত্তাল হয়েছিলেন হাফিজের সংরক্তময় অতীন্দ্রিয় প্রেমের কবিতার শিহরণে, যা সৈনিক জীবন সমাপ্তির পর অপূর্ব গজলে রূপান্তরিত করেছিলেন অনুবাদের মাধ্যমে। স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর বাংলার সন্ত্রাসবাদী দলের শ্রী অরবিন্দ ঘোষের অনুজ বারিন্দ্র কুমার ঘোষের সংস্পর্শে এসে তিনি বুঝতে সক্ষম হলেন, ‘তার একটি মিশন আছে’ অত্যাচার এবং অবিচারের বিরুদ্ধে গান গাওয়া। নজরুল ইসলাম এই বোধনেই বোধিত হয়ে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণা এই সাগ্নিক পুরুষকে উৎসর্গ করেছিলেন। নজরুলের বিদ্রোহী সত্তার রহস্য উন্মোচনে তাঁর আধুনিকতা আবিষ্কারের প্রয়োজনে তৎকালীন বাঙালীর তথা গোটা ভারতবর্ষের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং ইংরেজ শাসনের বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনা করলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। বেরসিক ইউরোপের তথাকথিত সম্ভ্রান্ত পৃথিবী তখন কম্পিত হয়েছে প্রথম মহাযুদ্ধের তাড়িত-ভয়াবহ আঘাতে। ভারতবর্ষে তার প্রতিক্রিয়া অন্তত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক না হলেও সাহিত্যের কাঠামোর পরিবর্তন আসন্ন হয়ে ওঠে। অথচ রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিশীলতা তখন নতুন দিকে বাঁক নিয়েছে, বলাকার মতো গতি পরিবর্তনশীল কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। সেই সময় নজরুল ইসলামের আবির্ভাব ‘ধূমকেতু’র মতো, যিনি কবিতার পঙ্ক্তিমালায় মৃদুভাষিতার স্বাক্ষর বহন করেননি। বিশ্ব ও স্বদেশের তাবত ঘটনার সচেতন প্রতিক্রিয়া পরিক্রমার মাধ্যমে রচনা করেছেন শুধু কাব্য নয়, গল্প উপন্যাসের চরিত্রসমূহ। ‘কল্লোল কোলাহল’-এ (এ উক্তিটির দাবিদার ডক্টর রবিন পাল) যারা প্রায় ভেসে গিয়েছিলো তাদের অনেকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একজন হয়েও এ কথা অবশ্যই স্বীকার্য যে নজরুলের কোন রাজনৈতিক মতবাদ ছিল না। যা তাকে স্থিরতার কেন্দ্রে আবদ্ধ রাখতে পারত।’ ‘কবি-সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার নজরুলকে সেই কেন্দ্রে আবদ্ধ রাখার চেষ্টা করেছিলেন।’ শ্রদ্ধেয় সৈয়দ আলী আহসান তাঁর ‘সতত স্বাগত’ গ্রন্থে মোহিতলাল প্রসঙ্গে আলোচনাকালে এ মন্তব্য করেছেন। ফলত তিনি যে নতুন বাণী আনছেন, সেই সম্বন্ধে নজরুল অনেকটা সচেতন ছিলেন বলে শ্রদ্ধেয় কবি ও সমালোচক বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘সাহিত্য চর্চা’ গ্রন্থে যেমন মতামত রেখেছেন তা পুরোপুরি সত্যের ধারায় আবদ্ধ না হলেও আংশিক সত্য, কেননা চল্লিশ দশকে তথাকথিত প্রগতি আন্দোলনের (কবি ফররুখ আহমদ প্রথম দিকে এই আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন) জোয়ারে সমগ্র বাংলা সাহিত্য ভাসলেও নজরুল ইসালামের অনুপস্থিতি লক্ষণীয়, আসলে এই সময় তিনি নিমজ্জিত ছিলেন সঙ্গীত রচনায়। তবে এই প্রসঙ্গে একটি প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, সমগ্র বাংলাকাব্য ক্ষেত্রে নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী সত্তা কোথায়? বিষয়টির গভীরে প্রবেশ প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথের একটি স্থির আদর্শ থাকা সত্ত্বেও জীবনের শেষ প্রান্ত এসে তিনি লিখতে কেন বাধ্য হলেন, ‘সভ্যতার সঙ্কট’। অন্নদা শঙ্কর রায় নজরুলের আকস্মিক বধিরতায় হতবাক হয়ে লিখলেন, ‘সৈনিক কখনও মৈনাক হয় না।’ বলা বাহুল্য, নজরুলের বিদ্রোহী সত্তার টকটকে লাল কষ্টধারার জন্মভূমি আমাদের সমাজেই, তার অস্তিত্ব আজও স্বাদেশিকভাবে বিদ্যমান। নজরুল জানতেন : ‘সংঘাতে তিনি এক পক্ষের নায়ক, প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সংগ্রামে শক্তির প্রয়োজন।’ প্রসঙ্গত স্বরণীয় রুশ বরেণ্য সাহিত্যিক টলস্টয় অহিংসবাদী হয়েও মহাত্মা গান্ধীর কাছে এক চিঠিতে জানিয়েছিলেন; ‘এত কোটি লোক থাকা সত্ত্বেও যে দেশ ইংরেজদের দ্বারা শাসিত হতে পারে তার জন্য প্রয়োজন ধিক্কার, সশস্ত্র সংগ্রামের।’ আসলে নজরুল জানতেন বৃহত্তের মধ্যে নিজেকে ব্যাপ্ত করার জন্য প্রয়োজন শক্তির সাধনা। অথচ ভীরুতা ছিল সে সমাজের বৈশিষ্ট্য। ‘এই বৃহত্তের মধ্যে নিজেকে ব্যাপ্ত করার’ মানসিকতাকে স্বকীয় চেতনার নতুন পথের সন্ধানকারী একজন আত্মস্থ করলেন বিদ্রোহীর বেশে। বাংলা কাব্যে তাঁর অবদান সুদূরপ্রসারী হয়ে পড়ে বহুল আলোচিত ‘বিদ্রোহী’ কবিতার অভিনব বক্তব্য এবং আঙ্গিকময়তার কারণে। শ্রেণীর দিক থেকে সর্বহারা শ্রেণীর (নিশ্চিত সমাজতন্ত্র নয়), একাত্মবোধের পরিপ্লাবিত ছিল যা পরবর্তীকালে সাধারণ মানুষের বিষয়বস্তুর টেনে আনার অসাধারণ প্রচেষ্টা বলে গণ্য হয়েছে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আঙ্গিকগত মতামত নিয়ে আলোচনা বস্তুত বক্তব্যের বৈচিত্র্য খুবই কম; কাজী আবদুল ওদুদ এবং ড. মুস্তাফা নূরউল ইসলামের মতে অস্বাভাবিক দীর্ঘ। পক্ষান্তরে বুদ্ধদেব বসুর ধারণা, ‘বিদ্রোহী’ খুব উঁচু মানের কবিতা নয়, তবে রবীন্দ্র প্রভাব মুক্ত এই ধরনের কবিতা লেখা উৎসাহব্যঞ্জক মনে হয়। বুদ্ধদেব বসু কোন ক্ষেত্রময় বিশ্বাসে প্রভাবিত হয়ে এই মন্তব্য করেছেন তা বোধগম্য না হওয়া স্বাভাবিক। বুদ্ধদেব বসুর কাছে যা উৎসাহময় বস্তু, নজরুলের কাছে কোন অংশে তা অস্বাভাবাবিক নয়। ‘শুধু সাহিত্যিক চিন্তাকে এই বিদ্রোহের ভঙ্গী আবদ্ধ হয়েছে তা নয়- প্রকাশরূপে তার উদ্দাম ও বিচিত্র ছাপ সমস্ত যুগেও ভাস্বর হয়ে রয়েছে। এক কথায় ‘বোহেমিয়ান সেজে তিনি বিদ্রোহী নন, তিনি বিদ্রোহী বলেই বোহেমিয়ান।’ এই সূত্রে আমরা একটি সূত্র যোগ করতে চাই, তা হলো এই যে বোহেমিয়ানতা আধুনিক কিনা তা বিতর্কের বিষয়বস্তু। বিশ্বসাহিত্যে অনেক বোহেমিয়ানতা সাহিত্যিক রয়েছেন। বোদলেয়ার থেকে এডগার এলান পোর নাম নির্দ্বিধায় বলা যায়। এখন আমাদের আলোচ্য বিষয় এই যে নজরুলী দ্রোহে আধুনিকতার অস্তিত্ব কোথায়? আধুনিকতার সংজ্ঞা নির্মাণ করা একটি দুঃসাহসিক কাজ। মনে রাখা প্রয়োজন আধুনিকতাকে সংজ্ঞায় নির্ণীত করার প্রয়োজনে পূর্বের কবিদের রচনাবলী বাতিল করা যায় না, তেমন ভাবে কোন মতবাদের অভিধায় একে চিহ্নিত করা ভুল প্রচেষ্টা বলে গণ্য হবে। শব্দ পরিকীর্ণতা ভঙ্গিমায় আধুনিকতার একটি অংশ মাত্র। দেগাকে (বিখ্যাত ফরাসী চিত্রকর) দেয়া একটি চিঠিতে মালার্মে বলেছিলেন : ‘ঙহব সধশবং ঢ়ড়বঃৎু রিঃয সড়ড়ফ হড়ঃ রিঃয রফবধ;’ পক্ষান্তরে এলিয়ট বলেন, ‘বোধগম্য হবার আগেই আধুনিক কবিতা সঞ্চারিত হয়’- এলিয়ট যে সঞ্চারিত হওয়াকে আধুনিকতার স্বাক্ষর গণ্য করেন নজরুল ইসলামের কবিতায় শক্তিশালী তার লক্ষণ পাওয়া অসম্ভব নয়। নজরুলের কবিতায় বুদ্ধির চর্চা অবশ্যই কম; তার অর্থ এই নয় যে, তা দর্শনশূন্য। মানবিকতার চির কল্যাণময় চেতনা তার কাব্যে কখনও দ্রোহ (তা সমাজদ্রোহ), আবার কখনও প্রেমিকতার ভাবালুতা; এই দুই চেতনায় নিমজ্জিত হওয়ার ফলশ্রুতিতে কিছু অর্বাচিন সমালোচক খুঁজে পেয়েছেন প্রতিক্রিয়াশীলতার আরচণ, যেমন পেয়েছিলেন প্রয়াত হুমায়ুন আজাদ। অথচ কবি- ঈশ্বরও হতে পারেন, শয়তানও হতে পারেন তার কবিতায়। নজরুল ইসলাম জাগরসূচক কবিতার যেমন উচ্চনিনাদী, প্রেমের কবিতায় তেমনি ইন্দ্রিয়ময়। চিত্রকল্পের ব্যবহারে এই দ্বৈত সমন্বয় বিস্ময়কর। বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলামের একমাত্র সমকক্ষ কৃতিত্বের দাবিদার জীবনানন্দ দাশ। অথচ এঁদের চিত্রকল্প কেবল চিত্রকল্প নয়, তার ভেতরে সংগুপ্ত রয়েছে দ্রোহের তীব্র দাহ। ফলত ‘আধুনিক’ শব্দ নির্বিকার ভালবাসার মানসিকতা। রবীন্দ্রনাথ একে বলেছেন : ‘এটা কালের কথা ততটা নয়- যতটা ভাবের কথা।’ দার্শনিক রেনানোর মতামত অনেকটা তাই। রবীন্দ্রযুগে বাস করে নজরুল ইসলাম ছিলেন প্রথম রবীন্দ্র প্রভাবমুক্ত আধুনিক কবি। তাঁর সমকালে মোহিতলাল মজুমদার এবং যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত পারস্পরিক প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে চেষ্টিত হয়েছিলেন রবীন্দ্র-রচিত মায়াজাল ছিঁড়ে খুঁড়ে বেরিয়ে আসতে; এই দুই কবি দ্রোহের টান-টান আধুনিকতার পথিক হয়ে। নজরুল ইসলাম সম্পর্কে আধুনিক সমালোচকেরা দ্বিধাবিভক্ত তা বলা বাহুল্য। বুদ্ধদেব বসুর মতে, ‘নজরুল ইসলাম রবীন্দ্রনাথের পর প্রথম মৌলিক কবি’ (সাহিত্য চর্চা) পক্ষান্তরে দিপ্তী ত্রিপাঠি তাঁর ‘আধুনিক বাংলাকাব্য পরিচয়’ গ্রন্থে সাম্প্রতিক কবি বলে নজরুল ইসলামকে তাঁর আধুনিকতা থেকে খারিজ করেছেন। নজরুল ইসলামকে বোধহয় তাঁর জীবৎকালে এই ধরনের অপবাদ সহ্য করতে হয়েছিল। বিখ্যাত ‘কৈফিয়ত’ কবিতার শেষ চার পঙ্ক্তিমালার বিবরে প্রবেশ করলে তা বোঝায় সম্ভব- রক্ত ঝরাতে পারি নাকো একা তাই লিখে যাই এ রক্ত লেখা বড় কথা, বড় ভাব আসো নাকো মাথায় বন্ধু বড় দুঃখে অমর কাব্য তোমরা লিখিও যারা আছো মহাসুখে। এ ভঙ্গী অনেকটা চারণকবির মতো। আত্ম স্বীকারোক্তির চার পঙ্ক্তির শীর্ষমালায় দাঁড়ালে কবির ভাবনায় কোন রহস্যময়তা নেই। এই গুণটি আয়ত্ত করেছেন হাফিজের অতন্দ্রীময় গজল থেকে। এই ব্যর্থতার জন্য দায়ী দারিদ্র্যতা না ব্যর্থতা? পাশাপাশি তিরিশের কবি বিষ্ণু দের বিখ্যাত ‘ঘোড়াসওয়ার’কে উদাহরণের রেখায় টেনে পার্থক্য দেখানো সম্ভব। এই মননশীলতা ছিল কতটা আয়াসসাধ্য- পাহাড় এখানে হালকা হাওয়া বোনে হিম শিলাপাত ঝঞ্ঝার আশা মনে আমার কামনা ছায়ামূর্তির বেশে পায়ে পায়ে চলে তোমার শরীর ঘেঁষে। (ঘোড়সওয়ার, চোরাবালি) পঙ্ক্তিটির উল্লেখ এই কারণেই- প্রেম ও দ্রোহ এখানে মিশেছে এলিয়টি কাঠিন্যে; যদিও শ্রদ্ধেয় মান্নান সৈয়দ একে বলেছেন : ‘সমৃদ্ধ মানবচিত্র বিপ্রতীপের লীলাভূমি’- পরবর্তী বাক্যাংশে অনেকটা এই মতামত বিষ্ণু দের ঘোড়সওয়ারের পদে পদে সেই বিমিশ্রের ধ্বনি উঠেছে গন্তব্য প্রেয়সী আর বিপ্লব একাকার। সত্যিই বলতে কি নজরুল ইসলামই ছিলেন বাংলা কবিতায় এ ধারার ¯্রষ্টা। যা আমাদের মতাদর্শের দাসত্বে আক্রান্ত সমালোচকরা স্বীকার করতে চান না। শ্রদ্ধেয় মান্নান সৈয়দের এই মন্তব্য মূল্যবান মনে হলেও তা খ-িত। কেননা তিনি খেয়াল করেননি নজরুল ইসলাম রোমান্টিক কবি হয়েও ‘ফরিয়াদ’-এর মতো কবিতা রচনা করলেন- অথচ এ গতির পূর্ণতা পেল চল্লিশের মাঝামাঝি হঠাৎ গজিয়ে ওঠা বিশাল সমাজচেতনমূলক কবিদের হাতে।’ এই সময়ের মূল্যায়নে সরোজ বন্দ্যোপ্যাধায় ঠিকই বলেছেন, ‘তিনি (আবু সয়ীদ আইয়ুব) প্রথম উচ্চারণ করেছিলেন আধুনিক বাংলা কবিতা থেকে রোমান্টিক মনোভাব তখনও অন্তর্হিত নিশ্চয় হয়নি তবে অন্তর্ধানের পথে।’ (কবিতার কালান্তর, পৃষ্ঠা সংখ্যা-৪) প্রসঙ্গত এটা অবশ্যই স্মরণযোগ্য, নজরুলের জাগরণমূলক কবিতার সফলতা পূর্ণতা লাভ করেনি; কিন্তু তিনি এ পথের বিশিষ্ট পথিক রূপে চিহ্নিত হয়ে থাকবেন- যা তাঁকে চিরকাল বাংলাসাহিত্যে স্মরণীয় করে রাখবে। তাঁর কবিত্বশক্তি সম্পর্কে বুদ্ধদেবের মন্তব্য নিয়ে নয়, বাংলা কাব্যসাহিত্যে নতুন দর্শনের আধুনিকতা আনয়নের জন্য। এতক্ষণ আমরা নজরুলের আধুনিকতা এবং দ্রোহ প্রসঙ্গে যে আলোচনা করলাম তাতে করে এটা সুস্পষ্ট আধুনিকতা বিষয়ে নজরুলের একটা চিরায়ত ধারণা বিদ্যমান ছিল। এ কথা ঠিক যে, নজরুলের জীবৎকালীন অর্র্থাৎ ত্রিশ দশক থেকে বাংলা কবিতায় আধুনিকতার যোগমাত্রা করার আপোসহীন সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন- তাতে নজরুলের নিবিড় সংশ্রব ছিল না। তিনি এদের ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন এমন তথ্য তাঁর জীবনিকাররা দেননি। কেবলমাত্র এ বিষয়ে বুদ্ধদেব বসু ব্যতিক্রমী অধ্যায় সৃজন করেন। উপরন্তু আমরা লক্ষ্য করব আধুনিক কবিতার গদ্যভঙ্গিকে সমালোচনা করে ব্যঙ্গ কবিতাও সৃজন করেছিলেন; যার পাঠযোগ্যতা আজও অপসারিত হয়নি। তার প্রতিটি পঙ্ক্তিমালা আমোদযোগ্য বটে। সাম্প্রাতিককালের কবিতার বিষয়বস্তুর সঙ্গে নজরুলের কবিতার রচনাশৈলীর বিস্তর ফারাক সৃষ্টি হয়েছে। তিরিশের পাঁচ কবির যা লক্ষ্য ছিলো তাও ইতোমধ্যে উপার্জিত হয়েছে। অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি যে, নজরুলের কবিতার বাণী সাম্প্রতিককালের তরুণদের আকর্ষণ করবে না সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা যেন ভুলে না যাই নজরুলের কবিতা পাঠে তিরিশের পাঁচ কবির অন্যতম নক্ষত্র জীবনানন্দ দাশও উপকৃত হয়েছিলেন। এ বিষয়ে আমি কবি অরুণ কুমার সরকারের তিরিশের কবিতা এবং পরবর্তী প্রবন্ধগ্রন্থের প্রথম ‘তিরিশের কবিতা এবং পরবর্তী’ শীর্ষক প্রবন্ধটি পাঠ করার জন্য অনুরোধ করব। এ কথা অবশ্যই ঠিক যে আজকের কবিতার রচনাশৈলী পরবর্তী দশকে পুরনো মনে হতে পারে। তার অর্থ এই নয় যে তিনি পাঠযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছেন। আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস নজরুলের কবিতা পাঠে সাম্প্রতিককালের তরুণরাও উপকৃত হতে পারেন। এর এটাও নজরুলের কবিতার সাম্প্রতিকতাকে জয় করার অন্যতম গুণাবলী। নজরুল অবশ্য তাঁর কালকে টুসকি মেরেছেন এই বলে, তিনি বর্তমানের কবি, ভবিষ্যতের কবি নন। মূলত এরই মধ্যে প্রকাশ ঘটেছে একজন প্রতিভাধর কবির মতোন স্বাধীন দীপ্ততা মাখা মতামত, যা আজকের উল্লেখযোগ্য কবির বিষয়বস্তুর সঙ্গে মেলে না, মিলবার কথা নয়। জীবনানন্দ দাশ তার নজরুল বিষয় একটি প্রবন্ধে মতামত রেখেছিলেন এই বলে, তার কবিতা চকৎকার কিন্তু মননগত দিক থেকে উত্তীর্ণ নয়। আমার ব্যক্তিগত ধারণা এই বক্তব্যের ভেতর দেশে রয়েছে প্রচ্ছন্ন বিরোধিতার সুর- এই রকম দ্বিচারিতার আভাসও পাচ্ছি। প্রথমত নজরুলের কবিতার শক্তিময়তাকে স্বীকার করেছেন, পাশাপাশি মনোগত দিত থেকে চিন্তাহীনতার কথা বলেছেন। তার অর্থ অত্যন্ত পরিষ্কার-আধুনিক কালের জটিল ধ্যান-ধারণার চর্চা করার পক্ষপাতি তিনি ছিলেন না। তথ্য হিসেবে আপত দৃষ্টে সত্য মনে হলেও প্রকৃত অর্থে তার বিপরীত বৃত্তে নজরুল অবস্থান করছেন। এই প্রসঙ্গে আমি সবাইকে নজরুলের উপর জীবনানন্দ দাশের কবিতা যার নামকরণ এই রকম “এই শতাব্দী সন্ধিতে মৃত্যু” প্রকাশিত হয়েছিলো “পরিক্রমা” শারদীয় সংখ্যা, আশ্বিন ১৩৫০ পাঠ করার অনুরোধ করবো।” তবে কি সাম্প্রতিককালের কবিতায় দ্রোহের বিষয়টি অনুপস্থিত? আসলে আগের কবিতার চেয়ে সাম্প্রতিক কালের কবিরা জনগণের ভাষায় কেউ লেখার পক্ষপাতি নন। তাতে কি কবিতার উদ্দেশ্য সাধিত হচ্ছে? তারই অতি বাস্তব স্বীকারোক্তি পাচ্ছি চল্লিশের কবি চঞ্চল কুমার চট্টোপাধ্যায় এর মুখে। তাঁর মতামত এই রকম, “আমি মনে করি নজরুলের মতো আমরা একটি কবিতাও লিখতে পারিনি; স্বাধীনতা আন্দোলনে নজরুলের কবিতা অনেকের মনে স্পন্দন এনে দিয়েছিলো। আমরা যারা নিজেদের মার্কসীয় মনে করি, মনে হয় সেরকম কোন কবিতা লিখতে পারিনি, সুকান্ত খানিকটা, সুভাস খানিকটা লিখেছে।’ (চঞ্চল কুমার চট্টোপাধ্যায়ের সাক্ষাতকার, সুজিত ঘোষ সম্পাদিত বিষ্ণু দে স্মরণ সংখ্যা, ফাল্গুন ১৩৯৬ বঙ্গাব্দ।) সাম্প্রতিককালের কবিতার ভেতর দেশে-সময়ের দায়-দেনা মিটাবার প্রবল আকাক্সক্ষা থাকলেও কবিরা খুব বেশি কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছেন না। যদিও কোন কোন কবি মাঝে মাঝে ঝলসে উঠছেন। সাম্প্রতিককালে আমাদের আকাক্সক্ষাও এক অভ্রভেদী কবি যিনি কুখ্যাত ছন্দবদ্ধ চিৎকারে না হলেও কিছুটা তার সমতা রেখে কবিতা লেখার কথঅ ভাবতে পারবেন। কেননা আজকের কবিতা মূলত চিন্তহীন অনর্গলতার দিন এবং তার সঙ্গে মিশেছে রাজনৈতিক ডামাডোলের রঙের কালিমা।
×