ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

অপূর্ব কুমার কুণ্ড

সত্যের চেয়ে সত্য পুতুলনাট্য

প্রকাশিত: ০৭:৫৫, ১০ আগস্ট ২০১৮

সত্যের চেয়ে সত্য পুতুলনাট্য

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই কবেই বলে গেছেন, ‘সত্যের চেয়ে সত্য পুতুলনাট্য’ অথচ কথাটা পুতুলনাট্য পরিবেশনার মধ্যে দিয়ে ভাবগতভাবে আজও কত সত্য। পুতুলনাট্যের রামায়ণ পালায় উচ্চারিত হয়, সীতা সোনার হরিণ এক মায়া, মায়াতেই জীবের বন্ধন। রাজা হরিশ চন্দ্র পালায় চন্ডাল হরিশ চন্দ্রের আক্ষেপ, পিতা হয়ে পুত্রকে চিতায় তোলা এ যে অসম্ভব ওহে পুত্র আমার! পুত্র বিনে বৃথাই এই জীবন ধারণ। বেহুলা লখিন্দর পালায় বেহুলার দৃঢ়তা, বাঁচতে যদি হয় স্বামীকে বাঁচিয়েই বাঁচব। মহুয়ার পালায় স্বামী নদের চাঁদের জন্য সতী মহুয়ার স্বেচ্ছায় আত্মাহুতি। জামাল বাদশা ও জরিনা সুন্দরী পালায় সেই চিরায়ত সত্য, তেল জলে মেলে না যেমন তেমন মেলেনা বাদশা পুত্রের সঙ্গে রজক কন্যার প্রেম। রূপবান-বাছের পালায় প্রেমে বীরত্ব-কৌশল আর আকুতির জয়। কাঠুরিয়াও বাঘ পালায় জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘ বাঁচার স্বার্থে লড়াই বাদ। রবীন্দ্র সাহিত্য আশ্রীত ‘ইচ্ছাপূরণ’ পালায় ব্যাকুলতা আর ইচ্ছাশক্তির কাছে অবশেষে অধরা ধরা দেয়। গীতল পালায় চিরন্তন সত্য উচ্চারিত হয়, আমি তোমার বধূ তুমি আমার স্বামী/খোদার পরে তোমায় আমি বড় বলে জানি। বেড়া পালা বোঝায়, দখলদারি নয় বরং যার যা আছে তাই নিয়ে সুখী হওয়াটাই শ্রেয়। সচেতনতামূলক পালায়, অধিক সন্তান সংসারে অভাব আনে, তাই প্রয়োজন পরিকল্পিত পরিবার। স্বাস্থ্য সচেতনমূলক পালায়, আয়োডিনের অভাবেতে গলগ- হয়/আয়োডিনযুক্ত লবণ খেলে সেই অভাব যায়। মুক্তিযুদ্ধের পালায় পাকা হানাদার বাহিনীর নির্মম নির্যাতন সইতে সইতেও বাঙালী কৃষক বীর কণ্ঠে বলে যায়, মুক্তিযোদ্ধা আছে সকল বাঙালীর বুকের মধ্যে, সকল বাঙালীর চেতনায়। চেতনায় আন্দোলিত করা পুতুলনাট্য হোক সে পৌরাণিক, ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক কিংবা সাহিত্যের বিষয় আশ্রিত তা শেষ পর্যন্ত বিনোদন এবং শিক্ষার সমান্তরাল পথ পরিক্রমায় উপনীত হয় এক পরম সত্যে। যে সত্য প্রত্যক্ষ এবং উপলব্ধি করেই কবিগুরু পুতুলনাট্যের আঙ্গিক ও বিষয়গত দিকের মূল্যায়নে বলেছিলেন, সত্যের চেয়ে সত্য পুতুলনাট্য। পুতুলনাট্যের উষালগ্ন যে ভরতমুনী রচিত নাট্যশাস্ত্রের সমকাল কিংবা তারও প্রাচীন, পুতুলনাট্যের বিচরণ যে ইতালি থেকে ইন্দোনেশিয়া তথা সমগ্র বিশ্বে সেসব কথা যদি সংক্ষিপ্ত পরিসরে মেলে ধরা নাও যায় তবু স্বাধীন বাংলাদেশের পুতুলনাট্য প্রসঙ্গ ভাবতে বসলেই এসে পড়েন আধুনিক পাপেট থিয়েটারের জনক মুস্তাফা মনোয়ার। আর্ট কলেজে অধ্যয়নকালে রাজস্থানি পাপেট প্রদর্শনী দেখে হলেন উদ্বুদ্ধ, টেলিভিশন প্রোগ্রাম প্রডিউসার হিসাবে ‘আজব দেশে’ অনুষ্ঠানে তাঁর নির্মিত পাপেট বাঘা ও মেনী হলো পূর্ব পাকিস্তানে তুমুলভাবে জনপ্রিয়, স্বাধীনতার যুদ্ধে শরণার্থী শিবির আর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে দলগতভাবে পুতুলনাট্য প্রদর্শনের মধ্যে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের করলেন উদ্বুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার কালে অর্থাৎ ১৯৭৪ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মাসব্যাপী পুতুলনাট্য উৎসবে আবিষ্কার করলেন পুতুল নাচিয়ে এবং কথক ধন মিয়াকে এবং যৌথভাবে সুনাম নিয়ে ফিরলেন সোভিয়েন ইউনিয়নের তাসখন্দ অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক পাপেট এ্যান্ড এনিমেশন ফেস্টিভ্যালে অংশগ্রহণ করে। আর বর্তমানে তাঁর নির্মিত টেলিভিশন পাপেট শো সিসিমপুর দেখেনি এমন দর্শক পাওয়া যেমন বিরল ঠিক তেমনি তাঁর এক একটি চরিত্র হালুম, ভূতো, গিট্টু সকল অনুরাগী দর্শকের আদরের। আদরের শিশুদের কল্পনা বাড়াতে, বিনোদনের মধ্য দিয়ে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ারের পরম নির্ভরতা শিল্প মাধ্যম হিসাবে পুতুলনাট্যে। পুতুলনাট্যের বিকাশ প্রকাশ এবং সম্ভাবনাকে মাথায় রেখে এবং নিজের শিল্প দর্শনের আলোকে পুতুলনাট্য মাধ্যমের যথার্থতা নিয়ে শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ারের প্রকাশ ভঙ্গিমা এবং মূল্যায়ন নান্দনিক-ব্যতিক্রমী এবং আনন্দের। তাঁর মতে, ‘জীবন সত্য, শিল্প সত্য। শিল্প মাধ্যমে অন্যান্য মাধ্যমের ভিড়ে পাপেট শিল্প তথা পুতুলনাট্য মাধ্যম সত্যের চেয়ে অধিক সত্য। সত্যের জোর শক্তি প্রকাশে। মানুষের চিন্তা, কল্পনা, অনুভূতি প্রকাশের শক্তিশালী মাধ্যম এই সরাসরি উপস্থাপিত পুতুলনাট্য মাধ্যমে। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, বৈষয়িক বিবর্তন, সভ্যতার উৎকর্ষতা, শিশুমনের কল্পনা, নীতিকথা, সাহিত্যের গভীরতা, সবকিছু হৃদয়ে ধারণ করেই পুতুল নাচিয়ে তার পুতুলনাট্য পরিবেশন করেন। ফলে বাহ্যত মনে হতেই পারে এ বুঝি পুতুলের অঙ্গভঙ্গির নিরর্থক নড়াচড়া। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই অঙ্গভঙ্গির আদলে সচল পাপেট এবং পাপেটারের জীবনবোধ শৈল্পিকভাবে দর্শক সম্মুখে উপস্থাপিত। যারা স্বপ্ন দেখেন এবং স্বল্প বাস্তবে দেখার তীব্র ব্যাকুলতা হৃদয়ে ধারণ করেন তাদের যে কারও প্রকাশ ভঙ্গির হাতিয়ার হতে পারে পাপেট্রি তথা পুতুলনাট্য। হয়ত প্রচার প্রচারণার ডামাডোলে পাপেট তথা পুতুল নাচিয়ে কিংবা কথক থাকেন প্রচারের অলক্ষ্যে-অদৃশ্যে যতটা পাপেট তথা পুতুল দৃশ্যমান হয় প্রদর্শনে। কিন্তু প্রকৃত শিল্পানুরাগীরা যোগ্য পাপেটার তথা পুতুল নাচিয়ে চিনে নিতে ভুল করেন না। দেখা ও শোনার যুগ্ম রসায়নে সমাজ, প্রেম, বিরহ, পৌরাণিক কাহিনী, উপদেশনা, মানবিকতা প্রভৃতি বিষয়ের পাশাপাশি নৃত্য, সঙ্গীত, আলো, প্রপস, সেট, কর্স্টিডম, কণ্ঠস্বরের ভিন্নতা প্রভৃতি শিল্প উপকরণ মিলেমিশে পুতুলনাট্য মাধ্যমকে সমৃদ্ধ করে, শক্তিশালী শিল্পমাধ্যম হিসাবে পুতুলনাট্য মাধ্যম নিজেকে উপস্থাপিত করেছে।’ উপস্থাপনের ক্ষেত্রে পুতুল তো আর মঞ্চনাটকের অভিনেতা-অভিনেত্রী নয় যে নিজে নিজে উপস্থাপিত হবে, পুতুলকে উপস্থাপনা করা হয়। যিনি করেন তিনি পুতুল নাচিয়ে বা পুতুল মাস্টার। পুতুল থাকে দর্শকদের সম্মুখে আর পুতুল নাচিয়ে থাকে পর্দার আড়ালে। মঞ্চনাটকে সূত্রধর যেমন নাটকের কাহিনী পরম্পরা দর্শকদের ধরিয়ে দেন অনেকটা সেভাবে কথক কাহিনী বাচিক অভিনয়ে বলে যান আর পুতুল নাচিয়ে কাহিনীর আদলে পুতুলকে দিয়ে অভিনয় করান। পুতুল আর পুতুল নাচিয়ের প্রদর্শনের সংযুক্তি যেমনিভাবে সুতায় তেমনিভাবে দস্তানায়, রডে, ছায়ায় এবং অন্য উপকরণ সহযোগিতায়। প্রদর্শনে থাকে নয়নাভিরাম সজ্জ্বিত মঞ্চ, সম্মুখ প্রান্তে হারমোনিয়াম মাস্টার ও সহযোগী বাদক দল, নেপথ্যে পুতুল মাস্টার ও তার সহযোগী। থাকে সারিবদ্ধ দর্শকাসন। উপর অংশে থাকে রোদ-বৃষ্টি প্রতিরোধক প্যান্ডেল। টিকেট কাউন্টার এবং প্রবেশ-প্রস্থানের পথও হয় নিয়ন্ত্রিত কিন্তু সুসজ্জিত। পুতুলনাট্য প্রদর্শনের প্রতি পর্বের গড় সময় পঁচিশ থেকে ত্রিশ মিনিট কিন্তু বায়না প্রদর্শনের ক্ষেত্রে এই সময় সীমা হয় বর্ধিত। পুতুল নির্মাণে সাধারণ উপকরণে থাকে মাটি, শোলা, কাঠ, বাঁশের চটা, থার্মোকল, কাগজ, আইকা, রং প্রভৃতি। পোশাকে সিনথেটিক-পলিস্টার-সিল্ক-ছিট কাপড়, লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, ঘাগরা, ওড়না প্রভৃতি। দল ভিন্ন ভিন্ন হলেও সাদৃশ্যের খেলাগুলোর মধ্যে থাকে পুতুলের নৃত্যগীত, পুতুলের যুদ্ধ, বাইচ খেলা, কুমির-চিংড়ির লড়াই, ঘোড়ার দৌড়, কাটুরে-বাঘের লড়াই, সাপের খেলা, বানর নাচ প্রভৃতি। বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে সাধারণভাবে হারমোনিয়াম, ক্যাসিও, ড্রামসেট, বাঁশি, কঙ্গো, মন্দিরা, কাঁসা, তবলা, কী-বোর্ড, জুড়ি-ঝাঁঝ প্রভৃতি। পুতুলনাট্য প্রদর্শনের ক্ষেত্র মূলত বৈশাখী মেলা, বাণিজ্যমেলা, রথমেলা, বিদ্যালয়ে আমন্ত্রণ, জন্মদিনের উদযাপন, পার্বণে আমন্ত্রণ, রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারী সচেতনামূলক কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ প্রভৃতিকে ঘিরে। সরকারী পর্যায়ে মাঝে মাঝে পুতুলনাট্য উৎসবকে ঘিরে সীমিত দলের পুতুলনাট্য প্রদর্শন। পুতুলনাট্য প্রদর্শন, সারাদেশে দলগুলোর অবস্থান, দলীয় শিল্পীদের জীবন জীবিকা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে সারাদেশ ঘুরে ঘুরে এক অর্থে পুতুলনাট্যের ইতিবৃত্ত তুলে ধরার কাজটি করেছেন ‘বিশুকুমারের পুতুলনাচ’ নাটকের নাট্যকার সেলিম আল দীন অনুপ্রাণীত এবং প্রভাবিত পুতুলনাট্য গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. রশীদ হারুন। পুতুল নাট্য শিল্পীদের নিয়ে তাঁর গবেষণা অভিসন্দর্ভ ‘বাংলাদেশের পুতুলনাট্য: বিষয় আঙ্গিক’ একাধারে তাঁকে যেমন পিএইচডি ডিগ্রী পাইয়ে দিয়েছে অপরদিকে ওই গবেষণার পরিবর্ধিত এবং সমসাময়িক তথ্য উপাত্তের সন্নিবেশে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত গ্রন্থ ‘বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পুতুলনাট্য’ বাংলাদেশে পুতুল নাট্যের একটা আশা ব্যঞ্জক মানচিত্র তুলে ধরেছে। লোকশিল্পকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে বিশ্ব আইটি আইএর সাম্মানিক সভাপতি রামেন্দু মজুমদারের বিশ্বাস, ‘পুতুলনাট্যের মতো শিল্প মাধ্যমগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে অধিক কর্মসংস্থানের যেমন বিকল্প নেই তেমনি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা বিশেষভাবে প্রয়োজন’। প্রয়োজনের একটা উদযাপন দেখা যায় ২০০৭ সালে বাংলাদেশের শিল্পকলা একাডেমির নাট্যকলা ও চলচ্চিত্রবিষয়ক বিভাগের আয়োজনে জাতীয় নাট্যশালায় ২০ থেকে ২৩ মোট তিন দিনব্যাপী পুতুলনাচ অনুষ্ঠান ২০০৭ উদযাপনের মধ্যে দিয়ে। শতাধিক প্রবীণ ও নবীন শিল্পীদের অংশগ্রহণে এবং সারাদেশ থেকে আগত এগারোটি পুতুলনাচের দল সেবারের উৎসবে পুতুলনাট্য প্রদর্শন করে। প্রদর্শনের উপর সরকারী নিষেধাজ্ঞা, মেলার সংকোচন, আয়োজক কমিটির দেনা-পাওনার টালবাহানা, পুতুল নির্মাণে গতানুগতিকতা, দলীয় শিল্পীদের প্রাপ্য বেতন নিয়মিত দিতে না পারা, কাহিনী পরিবেশনে সমকালকে সঠিকভাবে উপস্থাপনা করতে না পারা, পুতুল প্রদর্শনকে সামনে রেখে আয়োজকদের বিকৃতি রুচির পরিবেশনা প্রভৃতির কারণে প্রায় পঞ্চাশের অধিক পুতুলনাট্য দল যখন বিলুপ্তির খাদের কিনারায় তখন চোখ ভরা জল নিয়ে অনাগত ভবিষ্যত পানে আশঙ্কার চাহনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রয়েল বীনা পুতুল নাচ দলের প্রতিষ্ঠাতা ও জাতীয় আন্তার্জাতিকভাবে পরিচিতি পাওয়া কিংবদন্তি পুতুলনাট্য শিল্পী ধনমিয়াসহ আরও অনেকের। তাসখন্দ, ব্যাঙ্গালুরুর, হায়দ্রাবাদের সফলতা এবং অর্জিত অভিজ্ঞতা ধনমিয়া কাকে দিয়ে যাবেন যদি না পুতুলনাট্য প্রদর্শনী নিয়মিত না হয়। কি লাভ হলো মানিকগঞ্জের বিশ্বরূপা পুতুলনাচ পার্টির দল প্রধান ও পুতুল নাট্যশিল্পী বলরাম রাজবংশীর সরকারী চাকরিতে যোগ না দিয়ে ভালবেসে পুতুলনাট্যকে আঁকড়ে বাঁচতে চেয়ে, যেখানে শিক্ষিত নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণ বলতে গেলে শূন্য। তাঁর আত্মজিজ্ঞাসা, নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীগুলোতে এত চর কেন! তবু তিনি স্বপ্ন দেখেন পুতুলনাট্যের খরা তথা এই অচলায়তন একদিন সচল হবে। সাংস্কৃতিকবান্ধব সরকার পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে আসবে এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত শিল্পকলা একাডেমি যথাযথ ভূমিকা রাখবে। এই বিশ্বাসের জোরেই তিনি তাঁর পড়ুয়া ছেলে বিকাশ রাজবংশীকে লেখাপড়ার সমান্তরাল প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করান সুন্দর ভবিষ্যত গড়ার লক্ষ্যে। সাতক্ষীরার দি নিজাম পুতুলনাচ দলের দলীয় প্রধান এবং পুতুল নাট্যশিল্পী মোসাম্মদ জরিনা বেগম ভেবে পান না, তিনি তো অক্ষর জ্ঞান শূন্য অথচ যে যতœ ও ভালবাসায় শুধুমাত্র শুনে শুনে অর্ধশত পালা মুখস্থ করেছেন সেসবের ভবিষ্যত কি হবে? শিক্ষিত সমাজ কি এগিয়ে আসবে না দেশের ঐতিহ্য লিপিবদ্ধ করতে কিংবা শিল্পীর উত্তরাধিকারের দাবি নিয়ে! শত সঙ্কট আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ঐতিহ্যবাহী পুতুলনাট্য যখন লুপ্ত প্রায় তখন হাজার বছরের আঁধার ঘরে আলো জ্বললে যেমন সব আঁধার পালিয়ে চারদিক আলোকময় হয় তেমনই আলোক জ্বলল বর্তমান সাংস্কৃতিকবান্ধব সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা আর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির বর্তমান মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর নিরলস পরিশ্রম ও একাডেমির মাধ্যমে যোগ্য নেতৃত্বের সুবাধে। চলচ্চিত্র, নাটক, সার্কাস, যাত্রা, নৃত্য, সঙ্গীত, আবৃত্তি প্রভৃতি শিল্প মাধ্যমের মতো পুতুলনাট্য শিল্প মাধ্যমে আজকে যে জয়যাত্রা তার নেপথ্যের মানুষটি যে লিয়াকত আলী লাকী তার বড় প্রমাণ পুতুলনাট্য নিয়ে তার বিগত কর্ম পরিকল্পনা, পরিকল্পনার বাস্তবায়ন এবং ভবিষ্যতমুখী কার্যের ধারাবাহিকতা নির্ধারণ। নির্ধারিত পথচলাই শুধু নয় বরং সৃজনশীল সংগঠন হিসাবে প্রমাণিত লোক নাট্যদলের প্রাণ পুরুষ লিয়াকত আলী লাকীর গ্রন্থনা-নির্দেশনা এবং অভিনয় সমৃদ্ধ নাটক সোনাই মাধব সম্প্রতি বাংলাদেশ-ভারত হয়ে চীন জয় করল। মহাপরিচালক হিসাবে তার পরিকল্পনায় প্রায় অর্ধ-শতাধিক শিশু-কিশোর বছরব্যাপী চীন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে সার্কাস তথা এ্যাক্রোবেটিক শিল্পে নবজাগরণ আনল। ফলে চীনা প্রবাদটি, ‘তুমি আমার একটি চিংড়ি মাছ দিলে তাতে আমার একবেলা খাওয়া হবে কিন্তু যদি মাছ ধরার নিয়মটা শিখিয়ে দাও তবে আমি আজীবন খেতে পারব’ বড় প্রিয় লিয়াকত আলী লাকীর। এই শিখিয়ে দেয়া, সম্মুখে তুলে ধরা, অধিক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা এবং পুতুলনাট্য দলগুলোকে প্রান্তিক পর্যায় থেকে জাতীয় স্তরে আনা এবং ক্ষেত্রবিশেষ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রেরণ করা কর্মবীর লিয়াকত আলী লাকীর এক অবহেলিত মাধ্যমের প্রতি সৃজনশীল সহযোগিতা। সহযোগিতার পরম্পরায় ২০১০ সাল থেকে নিয়মিত প্রতি বছর পুতুলনাট্য উৎসব, পুতুন নির্মাণ বিষয়ক কর্মশালা, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পুতুলনাট্য চর্চা বিষয়ক সেমিনার, রেপার্টরির আদলে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুতুলনাট্য দল গঠন ও প্রদর্শন, আনন্দ শোভাযাত্রা, ২০১৩ সাল থেকে ২১ মার্চ বিশ্ব পুতুলনাট্য দিবস হিসাবে পালন, আন্তর্জাতিক পুতুলনাট্য উৎসবে বাংলাদেশ থেকে পুতুলনাট্য দল প্রেরণ প্রভৃতি কাজ মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর দিক নির্দেশনায় আন্তরিকভাবে করে চলেছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নাট্যকলা ও চলচ্চিত্র বিভাগ। উৎসবে অংশগ্রহণ করা দলগুলোর মধ্যে আছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রয়েল বীনা পুুতুলনাচ ও বাণী-বীনা পুতুলনাচ, সাতক্ষীরার দি নিউ নিজাম পুতুলনাচ, মানিকগঞ্জের বিশ্বরূপা পুতুলনাচ পার্টি, কুষ্টিয়ার মনহারা পুতুলনাচ, কুড়িগ্রামের মনিকা পুতুলনাচ, বাগেরহাটের দি আজাদ পুুতুলনাচ, দিনাজপুরের সমন্বয় পুুতুলনাচ, ঢাকার জল পাপেট, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পাপেট দল, বাংলাদেশ পুতুলনাট্য গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্র, ঢাকার মাল্টিমিডিয়া পাপেট থিয়েটার দলসহ আরও অনেক দল। সেমিনারে উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধের মধ্যে রয়েছে, বাংলার পুতুলনাচ: একটি নি¤œবর্গের সংস্কৃতি সংগ্রাম, বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পুতুলনাট্য প্রয়োগ ভাবনা, বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পুতুল নাট্যের সম্ভাবনার ক্ষেত্রসমূহ, পুতুলনাট্য শিল্পের উন্নয়নের জন্য কতিপয় প্রস্তাবনা, শিশুর স্বপ্নরাজ্য পুতুলনাট্য সহ অন্যান্য। বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মশালার মধ্যে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্য শিক্ষার্থী, জেলার বিভিন্ন নাট্যদল ও ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন নাট্যদল থেকে ৩৫ জন নাট্যকর্মীকে নিয়ে আধুনিক পাপেট থিয়েটার কর্মশালা, সারাদেশের পুতুলনাচের দলের প্রায় অর্ধশতাধিক শিল্পীদের নিয়ে নব আঙ্গিকে পুতুল নির্মাণ এবং নব বিষয় আশ্রিত কাহিনী বিন্যাস বিষয়ে ঐতিহ্যবাহী পুতুলনাট্য বিষয়ক আবাসিক কর্মশালা। ২০১৩ সালের ২১ মার্চ প্রথমবারের মতো ‘বিশ্ব পুতুলনাট্য দিবস’ পালন করল বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। কোন রকম বিরতি ছাড়া এই দিবসকে কেন্দ্র করে পুতুলনাট্য উৎসব আয়োজন এখন একটি নিয়মিত ঘটনা। আনন্দের ব্যাপার ২১ মার্চ ২০১৩ সাল থেকে পুতুলনাট্যে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ গুণী শিল্পীদের সম্মাননা প্রদান করছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। সম্মাননাপ্রাপ্ত শিল্পীদের মধ্যে রয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার ধন মিয়া, মানিকগঞ্জের বলরাম রাজবংশী, সাতক্ষীরার জরিনা বেগম, ব্রাহ্মণবাড়ীর খেলু মিয়া, দিনাজপুরের মনিদত্ত অধিকারী, কুষ্টিয়ার মোঃ আবদুল কুদ্দুস, বাগেরহাটের মোঃ মোশারফ হোসেন দর্জি। উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে বিশ্ব পুতুলনাট্য দিবসে পুতুলনাট্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি দেশ বরেণ্য শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ারকে আজীবন সম্মাননা প্রদান করেছে। আন্তর্জাতিক পুতুল নাট্য উৎসবে বিগত সময়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পাপেট থিয়েটার অংশগ্রহণ করে কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছে। ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার পুতুলনাট্য আঙ্গিকে। বাংলাদেশের গল্প উপস্থাপনা করে পাপেট দলটি ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় ‘হারমনি ওয়ার্ল্ড পাপেট কার্নিভাল’ ২০১৩ এ এবং সাতক্ষীরার পুতুলনাট্য আঙ্গিকে ‘বেদেকন্যা’ উপস্থাপন করে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক হারমনি ওয়ার্ল্ড পাপেট কার্নিভাল- ২০১৪ এ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিগত সময়ে বাংলাদেশ তার ঐতিহ্যবাহী পুতুলনাট্য নিয়ে ১৯৯৭ সালে নরওয়েতে আন্তর্জাতিক পুতুলনাট্য উৎসব এবং ১৯৯৮ সালে কলকাতায় আন্তর্জাতিক একজিবিশান এবং কনভেনশানে যোগদান করেন। যোগদানের তালিকায় আরও নতুন নতুন পুতুলনাট্য বিষয়ক কর্মসূচী যোগ হতে যাচ্ছে এই আগস্ট মাস থেকে। আগামী মাসের শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের পুতুলনাট্য দলগুলো থেকে অর্ধশতাধিক শিল্পীদের নিয়ে করা হবে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজনে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে আন্তর্জাতিক পুতুলনাট্য কর্মশালা। প্রশিক্ষণ, প্রদর্শন, সম্মাননা প্রদান, প্রকাশন, তথ্যচিত্র নির্মাণ, প্রবন্ধ উপস্থাপনা ইত্যাদি নানা আয়োজন নিয়ে পুতুলনাট্য বিষয়ক এই কর্মশালার আয়োজন। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক, জাতীয় পর্যায়ে লেখক- নাট্যকারদের দিয়ে একাডেমি ইতোমধ্যে পুতুলনাট্য মাধ্যমের জন্য এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে উপজীব্য করে নাটক রচনা সম্পন্ন করেছেন। অতিশীঘ্র সেইসব প্রযোজনা নিয়েও হবে পুতুলনাট্য উৎসব।
×