ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. আরএম দেবনাথ

ঋণ সস্তা কিন্তু মানুষের সুদ-আয় অর্ধেক

প্রকাশিত: ০৬:১১, ১০ আগস্ট ২০১৮

ঋণ সস্তা কিন্তু মানুষের সুদ-আয় অর্ধেক

নিম্ন মধ্যবিত্ত একটি সংসারের কথা দিয়েই আজকের নিবন্ধটি শুরু করা যাক। স্বামী-স্ত্রী, দুই শিশুপুত্র এবং বাবা-মা সব মিলে ছয়জনের সংসার। তাদের সাকল্যে মাসিক আয় ৬০ হাজার টাকা। আর বৃদ্ধ বাবার কিছু সুদ আয়। এটা তার চাকরি জীবন শেষে প্রাপ্ত টাকা থেকে আয়। মাসিক ৬০ হাজার টাকার মধ্যে ২২ হাজার টাকা বাড়িভাড়া। এর সঙ্গে যোগ হয় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের টাকা। হাতে যে টাকা থাকে তা দিয়ে কোন মতে তারা তাদের সংসার চালায়। দুই শিশুপুত্রের স্কুলের খরচই মাসে পনেরো হাজার টাকার মতো। এই খরচের মধ্যে রিক্সাভাড়াও আছে। কথাচ্ছলে যা বুঝলাম তারা এখন বড় সঙ্কটে বাবাকে নিয়ে। মা-বাবার চিকিৎসা-পথ্য খরচ দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। অথচ তার কোন নিয়মিত আয় নেই। ছোট চাকরি শেষে ২০ লাখ টাকার মতো অবসরকালীন ভাতা পেয়েছিলেন। তা রাখা আছে সঞ্চয়পত্রে এবং মেয়াদী আমানতে। সঞ্চয়পত্র থেকে মাসে মাসে কিছু সুদ পায়। কিন্তু মেয়াদী আমানতে সুদের হার অর্ধেকে নেমেছে। আবার শোনা যাচ্ছে সঞ্চয়পত্রের সুদ হার হ্রাস পাবে। এই পরিবারটির সঙ্গে কথা হয় মাঝে মাঝে। আমার খুবই পরিচিত। তাদের সংসার চলে না। সর্বশেষ যে কাজটি তারা করেছে তা হচ্ছে দুধ রাখা অর্ধেক করে ফেলেছে। আরও প্রতিদিন অর্ধেক কিলো দুধ রাখত। গোয়ালা বাড়িতে ফিরে যেত। এখন তাকে বলা হয়েছে একদিন পর পর দুধ দিতে। এতে মাসে বারো শ’ টাকার স্থলে খরচ হবে ৬০০ টাকা। বুঝলাম পরিবারটি তাদের ভোগ্যপণ্য ক্রয় নিয়ন্ত্রণ করছে। ভাড়া বাড়ি খরচ কমানোর জন্য বদলাতে পারছে না বাচ্চাদের স্কুলের কারণে। দেশের বাড়িতে কিছু সম্পত্তি আছে। কিন্তু তা থেকে কিছু পাওয়া যায় না। বিক্রিও নানাভাবে বাধাগ্রস্ত। পরিবারটি দারুণ অনিশ্চয়তার মধ্যে তাদের জীবনযাপন করছে। সবচেয়ে বেশি শঙ্কিত তারা বাচ্চাদের ভবিষ্যত নিয়ে। আরেক দুশ্চিন্তা চাকরি নিয়ে। চারদিকে চাকরি যাচ্ছে লোকের। বলাবাহুল্য, এ ধরনের পরিবারের সংখ্যা কত তা কেউ আমরা সঠিক জানি না। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্য বিধান করতে করতে যে পরিবারগুলো ধীরে ধীরে নিম্নগামী হচ্ছে অর্থনৈতিকভাবে তা এখন পরিষ্কার। ইদানীংকালে এ ঘটনা বাড়ছে। এর কারণ ব্যাংকের সুদহার হ্রাস। সরকারী সিদ্ধান্তে ব্যাংকগুলো এখন মেয়াদী আমানতে শতকরা মাত্র ছয় শতাংশ সুদ দিচ্ছে। অথচ কিছুদিন আগেও এই সুদের হার ছিল দশ থেকে বারো শতাংশ। কোন কোন ব্যাংক দিত ১০ শতাংশ। আবার এমন ব্যাংকও ছিল যারা দিত ১২ শতাংশ। সেই তুলনায় এখন তিনমাস মেয়াদী আমানতে সুদের হার মাত্র ছয় শতাংশ। এই সুদহার সকল ব্যাংকে। কোথাও কমবেশি নেই। বাধ্যতামূলকভাবে সকল ব্যাংক এখন ছয় শতাংশ হারে সুদ দিচ্ছে। তবে কথা আছে ‘সঞ্চয়ী হিসাবে’ সেভিংস এ্যাকাউন্ট) সুদের হার ২-৩-৪ শতাংশ। এসব হিসাবে ব্যাংকগুলো কোন সুদ দিতে চায় না। আবার নানা রকম নিয়ম করে অবস্থা এমন করা হয় যাতে সঞ্চয়ী আমানতে কোন সুদ না দিতে হয়। তার অর্থ কী দাঁড়াল? অর্থ হচ্ছে সুদের হার মূল্যস্ফীতির হারের তুলনায়ও কম করা ছিল। মূল্যস্ফীতির গড় এখন ছয় শতাংশের মতো। খাদ্য মূল্যস্ফীতি অবশ্য আরও বেশি। এর অর্থ ব্যাংকে টাকা রাখা মানে টাকার পরিমাণ হ্রাস পাওয়া। কারণ সুদের হার মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে কম। অবশ্য ‘অগ্রিম আয়কর’ কাটার বিষয়টি বিবেচনায় নিলে পরিস্থিতিটি আরও ভয়াবহ হয়। সুদ নির্বিশেষে ১০ শতাংশ হারে ‘ট্যাক্স’ কাটা হয়। যদি ‘ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার’ (টিআইএন) না থাকে তাহলে ১৫ শতাংশ। বলা বাহুল্য, ছোট ও মাঝারি আমানতকারীদের অধিকাংশেরই ‘টিআইএন’ নেই। তার অর্থ হচ্ছে একটাই। প্রকৃত সুদপ্রাপ্তি ৫ শতাংশেরও কম। ভয়াবহ ঘটনা। সঞ্চয়কারী লোকজন, অবসরপ্রাপ্ত লোকজন, বেওয়া, বিধবা, মুক্তিযোদ্ধা, ছোট-মাঝারি চাকরিজীবী, অসহায় নারী, শিক্ষক ইত্যাদি শ্রেণীর লাখ লাখ লোকের সুদ আয় অর্ধেকে হ্রাস পেয়েছে। উল্লেখ্য, এই শ্রেণীর লোকদের প্রধানতম আয়ই হচ্ছে সুদ আয়। তাদের কোন বেতন আয় নেই। আবার কিছু লোক আছেন যাদের ‘বেতন আয়’- এর সঙ্গে ‘সুদ আয়’ও যুক্ত হয়। তারা সংসার চালান। এখন দেখা যাচ্ছে সবার সামনেই বিপদ। ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে গিয়ে লাখ লাখ লোকের আয় এখন অর্ধেক। ব্যবসায়ীরা সস্তায় ঋণ চাচ্ছিলেন বহুদিন থেকে। সস্তায় মানে ‘সিঙ্গেল ডিজিটে’। অর্থাৎ ১০ শতাংশের নিচে বর্তমানে যা কোন কোন ক্ষেত্রে ১৬-১৭-১৮ শতাংশ। এর অর্থ তাদের জন্য সুদের হার হতে হবে অর্ধেক। এটা সরকার করেছে কিন্তু এর উল্টোপৃষ্ঠে যে কাজটি করা হয়েছে তা হচ্ছে আমানতে সুদ হ্রাস, ব্যাপকভাবে হ্রাস। সব ব্যাংকে, এমন কী লিজিং কোম্পানিগুলোতেও। তার মানে সঞ্চয়কারীদের, অবসরপ্রাপ্তদের আয় অর্ধেকে হ্রাস পেয়েছে। অথচ মূল্যস্ফীতি চলমান। বাজারে কোন জিনিসের দামই পড়ন্ত নয়। কারও খরচ কমতির দিকে নয়। লেখাপড়া, বাড়ি ভাড়া, যাতায়াত খরচ, ভোগ্যপণ্যের খরচ, মাছ-মাংস-ডিম, তরিতরকারি সবকিছুর দামই উর্ধমুখী। তার মানে কী? তার মানে খরচ বেশি, আয় কম, এই সমস্যার সঙ্গে যোগ হচ্ছে বেকারত্ব, চাকরিচ্যুতি। প্রতি মাসেই কোন না কোন খাতে লোকের চাকরি যাচ্ছে। গত এক মাসের মধ্যে দুটি ওষুধ কোম্পানির খবর পাওয়া গেছে যেখানে লোকের চাকরি গেছে। এর মধ্যে একটি বিদেশী কোম্পানি। চাকরিচ্যুতি, মধ্যবয়সে চাকরিচ্যুতি এখন নিয়মিত ঘটনা। এসব আবার অনেক ক্ষেত্রেই কোন সুযোগ-সুবিধা ব্যতিরেকেই। আরও দেখা যাচ্ছে নতুন চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। অর্থমন্ত্রী কিছুদিন আগে ‘জবলেস গ্রোথ’-এর কথা স্বীকার করে এ বিষয়ে গবেষণার আহ্বান জানিয়েছেন। সবচেয়ে বড় চাকরিদাতা-পোশাক খাতে নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি হচ্ছে না। প্রতিযোগিতা সামলাতে তথা ‘রোবট’ বসাচ্ছে। মানুষের কাজ যন্ত্র করবে। তারপরও দেখা যাচ্ছে ব্যাংকে ঋণখেলাপীদের মধ্যে তারাই এক নম্বর। এসবেরই মধ্যে অর্থনীতি চলছে। এই মুহূর্তে নতুন উৎপাত-আয় হ্রাস। এখানে বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে কয়েকটি। প্রথমত সঞ্চয়ও বিনিয়োগ ব্যাংকে আমানত রেখে যদি আয় হ্রাস হয় তাহলে কী সঞ্চয় বাড়বে? আর সঞ্চয় যদি না বাড়ে তাহলে কী বিনিয়োগ বাড়বে? পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ব্যাংক আমানতে সুদ নিয়ে অস্থিতিশীলতার কারণে বিগত দুই-তিন বছর যাবত আমানতের প্রবৃদ্ধির হার কম। বিপরীতে ঋণের প্রবৃদ্ধি বেশি। এখানেও প্রশ্ন ঋণ সস্তা করা হলো কিন্তু ঋণ দেয়া হবে কোত্থেকে যদি না ব্যাংকে আমানত বাড়ে। আমানত যদি নিরুৎসাহিত হয় তাহলে লোক সঞ্চয় করবে কেন? আর সঞ্চয় করে রাখবে কোথায়? তাহলে বিনিয়োগের টাকাই বা আসবে কোত্থেকে? বেসরকারী বিনিয়োগ স্থবির। একইভাবে সঞ্চয়ের গতিও স্থবির। আমার কাছে এটা বোধগম্য নয়, সঞ্চয়কে নিরুৎসাহিত করে বিনিয়োগ বাড়ানো হবে কিভাবে? সঞ্চয় না থাকলে ‘আমানত’ বাড়বে না। ‘আমানত’ বা ‘ডিপোজিট’ না বাড়লে ঋণও দেয়া যাবে না। তাহলে বিনিয়োগটা বাড়বে কিভাবে? দ্বিতীয় প্রশ্নÑ লাখ লাখ মানুষের যদি আয় অর্ধেকে হ্রাস পায় তাহলে বাজারে কে যাবে? মাছ-মাংস, তরিতরকারি ফলমূল, শাক-সবজি, ভোগ্যপণ্য কে কিনবে? কে কিনবে শিল্পজাত পণ্য? চাহিদা আসবে কোত্থেকে? বিরাট সংখ্যক লোক যদি ভোগ কমায় তাহলে বাজারে চাহিদা সৃষ্টি কিভাবে হবে? নিবন্ধের শুরুতে একটি পরিবারের কথা বলেছি। তারা মাসিক ১৫ কিলো দুধের স্থলে সাড়ে সাত কিলো দুধ খাবে স্থির করেছে। এভাবে যদি তেল, রসুন, পিঁয়াজ, চিনি, ডাল ইত্যাদির ভোগ মানুষ কমাতে বাধ্য হয় তাহলে অবস্থাটা কী দাঁড়াবে? কিছু কিছু খরচ মানুষ বাধ্য হয়ে করবে। কিন্তু বহু খরচ সে কমাতে বাধ্য হবে। এই জায়গাতেই প্রশ্ন, ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্য কোন বাজারে বিক্রি করবেন? বিদেশে রফতানি করবেন? অথবা বিক্রি করবেন রেমিটেন্স প্রাপকদের কাছে এবং সরকারী কর্মচারীদের কাছে, কারণ তাদের আয়, সুযোগ-সুবিধা বাড়ছে তো বাড়ছেই। কিন্তু প্রশ্ন এরা সংখ্যায় কত? এদের বাইরে যারা তারা সংখ্যায় অনেক, অনেক বেশি। সাম্প্রতিক ‘সুদহার’ কমানোর প্রেক্ষাপটে এসব প্রশ্নগুলো সামনে এসেছে। যা কিছু করতে হবে তা মানুষের আয়ের স্তর ঠিক রেখে করতে হবে। বাজার চড়া থাকবে, আর আয়ের স্তর নি¤œমুখী হবে, এটা হয় কিভাবে? একজনের উপকার করতে গিয়ে, দশজনের ক্ষতি করা কোন সরকারী নীতি হতে পারে না। এই ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে সরকার সঞ্চয়পত্রে তার নীতি ঠিক রেখেছে। হঠাৎ করে বলা হলো, সঞ্চয়পত্রের সুদও কমানো হবে। না, পরে দেখা গেল সরকার বলছে সঞ্চয়পত্রে ধরা হচ্ছে না। যা হবে নির্বাচনের পরে। প্রশ্ন, ব্যাংক আমানতের সুদ বিষয়টি কী নির্বাচনী বিবেচনায় পড়ে না? এখানে তো লাখ লাখ লোক জড়িত, অনেক বেশি লোক জড়িত। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
×