ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দীর্ঘ কারাভোগের পর অবশেষে মুক্তি পেলেন হাসনাত করিম

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ১০ আগস্ট ২০১৮

দীর্ঘ কারাভোগের পর অবশেষে মুক্তি পেলেন হাসনাত করিম

শংকর কুমার দে ॥ গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার ঘটনায় গ্রেফতার হয়ে ২ বছর ১ মাস ৯ দিন কারাভোগের পর অবশেষে মুক্তি পেয়ে ঘরে ফিরলেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাবেক শিক্ষক হাসনাত রেজাউল করিম। মুক্ত জীবনের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে চারটার সময় গাজীপুরের কাশিমপুরের হাইসিকিউরিটি জেল থেকে মুক্তি পান ব্রিটেন ও বাংলাদেশের এই দ্বৈত নাগরিক হাসনাত। তিনি যখন জেল থেকে বেরিয়ে আসেন তখন কারা ফটকের সামনে উপস্থিত ছিলেন তার পরিবারের সদস্যসহ স্বজনরা। কারাবাসের দুঃসহ দিনগুলো পেছনে ফেলে মুক্ত জীবনের স্বাদ গ্রহণের জন্য হাসনাত করিম কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন তখন তার পরিবারের সদস্যরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে অশ্রু সিক্ত নয়নে জড়িয়ে ধরে তাকে আলিঙ্গন করেন। গাজীপুরের কাশিমপুরের হাইসিকিউরিটি জেলার বিকাশ রায়হান বলেন, হাসনাতকে অব্যাহতি দিয়ে আদালত থেকে যে নির্দেশনা এসেছে, তা যাচাই-বাছাই করার পর মুক্তি দেয়া হয়েছে তাকে। হাসনাত করিমের স্ত্রী শারমিনা করিম গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা খুশি। অবশেষে হাসনাত জেল থেকে মুক্তি পেয়েছে। আমাদের বিশ্বাস ছিল সে যেহেতু নির্দোষ, সেহেতু আজ হোক কাল হোক মুক্তি সে পাবেই। কিন্তু এই দুটি বছর দুঃসহ জীবন পার করতে হয়েছে হাসনাতকে। পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা বলেন, ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পরদিন ২ জুলাই থেকেই সন্দেহভাজন হিসেবে প্রথমে তাকে আটক করা হয়। পরবর্তীতে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে ছিলেন তিনি। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার দুই বছর পর গত ২৩ জুলাই হাসনাত করিমকে অব্যাহতি দিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় এই মামলার তদন্ত সংস্থা পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। গত ২৬ জুলাই চার্জশীটের নথিতে স্বাক্ষর করে সেটি চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠিয়ে দেন ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম নুরুন্নাহার ইয়াসমিন। এরপর সেখান থেকে চার্জশীট সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। গত বুধবার বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান চার্জশীট গ্রহণ করে হাসনাত করিমকে অব্যাহতির আদেশ এবং পলাতক দুই জঙ্গী মামুনুর রশিদ রিপন ও শরীফুল ইসলাম খালিদকে গ্রেফতারের জন্য পরোয়ানা জারি করেন। এর আগে ২০১৬ সালের ৫ অক্টোবর পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাসনাতকে ৫৪ ধারার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়েছিল আদালত। তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তাদের কাছে হাসনাত করিমের পরিবার বলেছেন, ২০১৬ সালের ১ জুলাই ছিল হাসনাত করিমের মেয়ে শেফা করিমের ১৩তম জন্মদিন। মেয়ের জন্মদিন উপলক্ষে স্ত্রী শারমিনা করিম ও দুই সন্তানকে নিয়ে হাসনাত গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে রাতের খাবারের জন্য গিয়েছিলেন। রাত সাড়ে আটটার দিকে তারা ওই রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করে খাবারের অর্ডার দিতে না দিতেই জঙ্গীরা সেখানে হামলা করে। রাতভর জঙ্গীদের হাতে জিম্মি ছিলেন তারা। পরদিন সকালে সেনা কমান্ডোদের অভিযান শুরুর আগ মুহূর্তে দেশী-বিদেশী আরও কয়েকজনের সঙ্গে বেরিয়ে আসেন হাসনাত করিম। এরপর প্রথমে পরিবারের অন্যান্য সদস্যসহ হাসনাতকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মিন্টো রোডের গোয়েন্দা কার্যালয়ে নেয়া হয়। হাসনাতের কারাবাসের নেপথ্যে ॥ গুলশান হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলার সময়ে এক কোরীয় নাগরিকের গোপনে ধারণ করা ভিডিও প্রকাশিত হওয়ার পর হাসনাত করিমের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে। জঙ্গী হামলার পরদিন ভোরে ধারণ করা ওই ভিডিওতে হাসনাত করিমকে জঙ্গীদের সঙ্গে আলাপ করতে দেখা গিয়েছিল। হলি আর্টিজানে কমান্ডো অভিযান শুরুর আগের এক ছবিতে ক্যাফের ছাদে দুই ব্যক্তির সঙ্গে হাসনাত রেজাউল করিমকে দেখা যায়। হলি আর্টিজানে কমান্ডো অভিযানে যে পাঁচ হামলাকারী নিহত হন, তাদের মধ্যে নিবরাজ ইসলাম নর্থ সাউথের শিক্ষার্থী ছিলেন, যেখানে হাসনাত এক সময় পড়াতেন। জঙ্গী রোহান ইমতিয়াজের সঙ্গে হাসনাত করিম ও অস্ত্র হাতে তাহমিদ (কালো টি-শার্ট পরা) কমান্ডো অভিযানের আগের এই ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোড়ন তোলে। হাসনাতের সঙ্গে উদ্ধার তাহমিদ হাসিব খানকে নিয়েও দেখা দিয়েছিল সন্দেহ; কারণ ভিডিওতে তাকে অস্ত্র হাতে দেখা গিয়েছিল। তবে পরে পুলিশ অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয় কানাডায় পড়াশোনারত তাহমিদকে। পরে তিনি মুক্তি পেলেও হাসনাত করিম আটক থাকেন। তবে হাসনাতের স্ত্রী জঙ্গী সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, জিম্মি অবস্থায় তাদের বিভিন্ন নির্দেশ মেনে কাজ করতে হয়েছিল। হলি আর্টিজান বেকারির ছাদে হামলাকারী জঙ্গীদের সঙ্গে তাকে আলাপ চারিতায় দেখা যায় তাকে। তখন জঙ্গীদের মোবাইল ফোন ব্যবহার, আগ্নেয়াস্ত্র নাড়াচাড়াসহ অনেক জঙ্গী সম্পৃক্ততা ধারণ করা দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ পেলে তা নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলতে থাকে। ঢাকার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষকের নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহ্রীরের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল বলেও অভিযোগ ওঠে। ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার পরদিন সকালে উদ্ধারকৃত জিম্মিদের মধ্যে রহস্যজনক আচরণের কারণে হাসনাত করিমকে গোয়েন্দা কার্যালয়ে নেয়া হয়। ঘটনার কয়েকদিন পর হাসনাতকে ছেড়ে দেয়ার কথা পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হলেও তাকে আর ছাড়া হয়নি। গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার ঘটনায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনের একটি মামলায় ওই বছরের ৩ আগস্ট তাকে ৫৪ ধারায় সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার করা হয়। ৪ আগস্ট প্রথম দফায় হাসনাত করিমের আটদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। ১৩ আগস্ট গুলশান হামলার মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। গত ২৪ আগস্ট গুলশান হামলা মামলায় গ্রেফতার হাসনাত করিমের জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত। সেই থেকে হাসনাত করিম বর্তমানে কাশিমপুর কারাগারে বন্দী হন। গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলায় অংশ নেয়া জঙ্গীদের সঙ্গে হাসনাত করিমের ছবি এবং তার বিরুদ্ধে হিযুবত তাহ্রীরের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগের কারণে তদন্ত করে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। তদন্ত শেষ করতে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার কারণে তার কারাবাসও দীর্ঘায়িত হয়। তদন্ত সংস্থা তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের সত্যতা পায়নি। হাসনাত নিজে এবং ঘটনার সময় জিম্মি হয়ে থাকা অন্যদের ভাষ্য ছিল, জঙ্গীদের অস্ত্রের মুখে ছাদে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন হাসনাত করিম। আর নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহ্রীরের সঙ্গে সম্পৃক্ততার যে অভিযোগ উঠেছিল, তারও কোন সত্যতা পায়নি পুলিশ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও কয়েকটি গণমাধ্যমে তার হিযবুত কানেকশন নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। এমনকি এ জন্য তাকে বেসরকারী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছিল বলে খবর প্রকাশিত হয়। তবে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নথিপত্র ঘেঁটে এ রকম কোন তথ্য পায়নি পুলিশের কর্মকর্তারা। গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার মতো স্পর্শকাতর ইস্যু হওয়ায় তারা হাসনাতের তদন্তের বিষয়ে কোন ঝুঁকি নিতে চাননি তদন্ত সংস্থা। তদন্ত সংস্থা তদন্তের বিষয়টি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করার পর মামলার চার্জশীট থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয় তাকে। চার্জশীট থেকে অব্যাহতি দেয়ার পর আদালতের নির্দেশের মাধ্যমে কারাগার থেকে মুক্তি পান নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাবেক শিক্ষক হাসনাত রেজাউল করিম ।
×