ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

তিন আসনই মনোনয়ন প্রত্যাশীদের পদচারণায় মুখর ॥ লালমনিরহাট

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ১০ আগস্ট ২০১৮

তিন আসনই মনোনয়ন প্রত্যাশীদের পদচারণায় মুখর ॥ লালমনিরহাট

জাহাঙ্গীর আলম শাহীন, লালমনিরহাট ॥ উত্তরের জনপদ লালমনিরটহাট জেলায় বইতে শুরু করেছে নির্বাচনী হাওয়া। মনোনয়ন প্রত্যাশীদের পদচারণায় মুখরিত জেলার তিনটি আসনই। সম্ভাব্য প্রার্থীদের যেন কোন ফুসরত নেই। প্রতিনিয়ত ছুটে চলেছেন ভোটারদের দ্বারে দ্বারে, চাইছেন দলীয় মার্কায় ভোট। দীর্ঘদিন অবহেলিত দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদেরও কদর বেড়েছে বড় বড় রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের কাছে। সবাইকে আপন করে নিজ দলের বিজয় অর্জনে সবাই যেন মরিয়া। পাঁচটি উপজেলা মিলে লালমনিরহাট জেলার তিনটি সংসদীয় আসন। নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের মধ্যে চলছে ব্যাপক নির্বাচনী প্রস্তুতি। এ অঞ্চলে জনপ্রিয় জাতীয় পার্টি মহাজোটগতভাবেই নাকি এককভাবে নির্বাচন করবে এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে জল্পনা-কল্পনার অন্ত নেই। বর্তমানে জেলার তিনটি আসনই রয়েছে আওয়ামী লীগের দখলে। টানা দু’মেয়াদে ক্ষমতায় থেকে ব্যাপক উন্নয়নের মাধ্যমে তিনটি আসনেই ক্ষমতাসীন দলটি শক্ত ভিত গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। আগামী নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ তিনটি আসনই ধরে রাখতে মরিয়া। অন্যদিকে মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি চায় আওয়ামী লীগের আসনে ভাগ বসাতে। আর বিএনপি চায় হারানো আসন পুনরুদ্ধার করতে। এ নিয়ে তিনটি দলেরই মনোনয়ন প্রত্যাশীরা ছুটে বেড়াচ্ছেন নির্বাচনী এলাকায়। তবে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে দলীয় মনোনয়ন পেতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি তিনটি দলেই রয়েছে একাধিক প্রার্থী। লালমনিরহাট-১ (হাতীবান্ধা-পাটগ্রাম) ॥ জেলার পাটগ্রাম-হাতীবান্ধা দুইটি উপজেলার ১৯টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে লালমনিরাহাট-১ আসন গঠিত। এ আসনে দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বুড়িমারী এবং তিনবিঘা করিডর পেরিয়ে বিলুপ্ত ছিটমহল দহগ্রাম আঙ্গরপোতা রয়েছে, যা দহগ্রাম ইউনিয়ন নামে পরিচিত। এখানে মুক্তিযুদ্ধকালীন দেশের অভ্যন্তরে মুক্তাঞ্চলে ৬নং সেক্টর গঠন করা হয়েছিল। এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে বর্তমান প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেন এমপির মনোনয়ন অনেকটাই সুনিশ্চিত। বর্তমান সংসদ সদস্য মোতাহার হোসেন নির্বাচনী এলাকার জন্য ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। প্রতিনিয়তই তিনি দলীয় ও প্রশাসনিক সভায় উপস্থিত থাকছেন। তিনবারের সংসদ সদস্য হিসেবে এলাকার জনগণের কাছে তিনি এখনও জনপ্রিয় নেতা হিসেবে পরিচিত। এ আসন থেকে মোতাহার হোসেন ছাড়াও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন পাটগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান রুহুল আমিন বাবুল এবং প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা মেজর (অব.) মকবুল হোসেন। জাতীয় পার্টির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও উপজেলা জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক এমজি মোস্তফা ও অপরজন হলেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য মেজর (অব) খালিদ আক্তার। এদের মধ্যে এমজি মোস্তফা মনোনয়ন পেতে এলাকায় গণসংযোগ করে যাচ্ছেন। এ আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে কেন্দ্রীয় বিএনপির অন্যতম সদস্য ব্যারিস্টার হাসান রাজিব প্রধান, ছাত্র দলের কেন্দ্রীয় কমিটির শাহীন আকন্দের নাম শোনা যাচ্ছে। এছাড়াও জাসদ নেতা সাদেকুল ইসলাম নির্বাচন করতে চান। বিগত দিনে এই আসন হতে বিএনপি-জামায়াত জোটের প্রার্থী এরশাদ হোসেন সাজু ও হাবিবুর রহমান হাবিব ৭ম ও ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। এবার এই আসনে বিএনপির প্রার্থী ব্যারিস্টার হাসান রাজিব সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন। তরুণ নেতা হিসেবে ইতোমধ্যে এ আসনে ব্যারিস্টার হাসান রাজিব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন বলে বিএনপির নেতাকর্মীরা দাবি করেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মধ্যে মহাজোট হলে সেক্ষেত্রে মনোনয়নের ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকবেন বর্তমান এমপি মোতাহার হোসেন। কেননা জাতীয় পার্টিকে মনোনয়ন দিলে বেশি সুবিধা করতে পারবেন না। শুধু মোতাহার হোসেন মনোনয়ন পেলেই এই আসনটি নৌকার বিজয় সুনিশ্চিত বলেই দাবি দলটির স্থানীয় নেতাকর্মীদের। কেননা সাবেক প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেন বিশাল ভোটের ব্যবধানে পর পর ৩ বার এ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। লালমনিরহাট-২ (কালীগঞ্জ-আদিতমারী) ॥ জেলার কালীগঞ্জ-আদিতমারী দুইটি উপজেলার ১৬টি ইউনিয়ন নিয়ে লালমনিরহাট-২ আসন গঠিত। এ আসন জেলার ভৌগোলিকভাবে মধ্যবর্তী উপজেলা। এ আসনের নির্বাচিত সংসদ সদস্য হচ্ছেন সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহম্মেদ। আগামী নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ থেকে তার মনোনয়ন নিশ্চিত বলেই শোনা যাচ্ছে। তিনি ছাড়াও এ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী হলেন আদিতমারী উপজেলার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মোঃ সিরাজুল হক। দশম সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির সাতবারের এমপি মজিবর রহমান অংশগ্রহণ করেননি। ফলে বর্তমান এমপি নুরুজ্জামান আহম্মেদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হন। তিনি প্রথমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হয়েই প্রথমে খাদ্য প্রতিমন্ত্রী এবং বর্তমানে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমান সরকারের আমলে প্রতিমন্ত্রী নুরুজ্জামান এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। সংগঠনকে করেছেন শক্তিশালী। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তার রয়েছে পারিবারিক ঐতিহ্য। সার্বিক বিচারে আগামী নির্বাচনে তিনিই মনোনয়ন পাচ্ছেন এমনটা নিশ্চিত করেই বলছেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। এ আসনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ও সাবেক এমপি সালেহউদ্দিন আহম্মেদ হেলাল ও লালমনিরহাট জেলা বিএনপির সভাপতি, কেন্দ্রীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক উপমন্ত্রী অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলুর নাম শোনা যায়। ৭ম ও ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লালমনিরহাট সদর আসনের এমপি ছিলেন আসাদুল হাবিব দুলু। যার কারণে কালীগঞ্জ ও আদিতমারীর বিএনপির নেতারা দুলুকেই লালমনিরহাটের দুইটি আসনে এমপি প্রার্থী দেখতে চান। এই আসনে জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সমাজকল্যাণ সম্পাদক, রোকন উদ্দিন বাবুল। কয়েক মাস আগে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কালীগঞ্জ এক জনসভায় রোকন উদ্দিন বাবুলকে আগামী নির্বাচনে জাপার প্রার্থী হিসেবে জনসভায় পরিচয় করিয়ে দেন। মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে আ’লীগ ও জাপা এ আসনে সমান সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। তবে সাত বারের এমপি জাপা নেতা মোঃ মজিবর রহমান মারা যাওয়ায় এখানে জাতীয় পার্টি কিছুটা নাজুক অবস্থায় পড়েছে। লালমনিরহাট-৩ (সদর) ॥ লালমনিরহাট সদর উপজেলার একটি পৌরসভা ও ৯টি ইউনিয়ন নিয়ে লালমনিরহাট-৩ আসন গঠিত। এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের ইঞ্জিনিয়ার আবু সাঈদ দুলাল। গত সাড়ে চার বছরে এমপি হিসেবে তিনি এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। বিশেষ করে ধরলা দ্বিতীয় সেতু ও তিস্তা দ্বিতীয় সেতু নির্মাণ করায় আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই আওয়ামী লীগ চায় এ আসনটিতে পুনরায় বিজয়ী হতে। এ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন- বর্তমান সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার আবু সাঈদ দুলাল, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট মতিয়ার রহমান ও কুড়িগ্রাম-লালমনিরহাট সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য এ্যাডভোকেট সফুরা বেগম রুমী। বিএনপির একক প্রার্থী হচ্ছেন জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক উপমন্ত্রী অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলু। জাতীয় পার্টি থেকে সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ও জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের। জেলা জাতীয় পার্টি হতে সদ্য অপসারিত নেতা অধ্যক্ষ মাহবুবুল আলম মিঠুও জাপা হতে মনোনয়ন প্রত্যাশী। মহাজোটগতভাবে নির্বাচন হলে এ আসন থেকে প্রার্থী হতে চান এইচএম এরশাদের ছোট ভাই জিএম কাদের। এই আসনে জেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক উপমন্ত্রী অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলুর রয়েছে একক নেতৃত্ব। তিনি বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে এই আসনের এমপি ও সরকারের সাবেক খাদ্য উপমন্ত্রী ছিলেন। সেই সময় তিনি নানা সংগঠন তৈরি করে আলোচনায় ছিলেন। বিএনপি দাবি করে তার আমলে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। এলাকাবাসীর মতে, আগামী নির্বাচনে জিএম কাদেরকে আসনটি ছেড়ে দিলে আসনটি মহাজোটের হাত ছাড়া হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সেক্ষেত্রে বিএনপি আসনটিতে ভাল করতে পারে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, জিএম কাদের বাণিজ্য ও বিমানমন্ত্রী হয়েও এলাকার তেমন উন্নয়ন করতে পারেননি, লালমনিরহাট বিমানবন্দরটি পর্যন্ত চালু করতে পারেননি। আর স্থানীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গেও তার কোন সমন্বয় নেই। তাই জাতীয় পার্টিকে আসনটি ছেড়ে দিলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে। লালমনিরহাট- ৩ (সদর) আসনে আওয়ামী লীগের চার প্রার্থীর মধ্যে একজন মনোনয়ন পাবেন। সেদিক থেকে এগিয়ে রয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার আবু সাঈদ দুলাল। অত্যন্ত সজ্জন ও ক্লিন ইমেজের নেতা হিসেবে নির্বাচনী এলাকার মানুষের কাছে পরিচিত তিনি। জাতীয় ৪ নেতার এক নেতা মো. কামরুজ্জামানের জামাতা হলেন এমপি আবু সাঈদ দুলাল। এদিকে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট মোঃ মতিয়ার রহমান জেলায় একজন দক্ষ সংগঠক হিসেবে ইতোমধ্যে দক্ষতাও দেখিয়েছেন। তারও রয়েছে নির্বাচনী এলাকায় জনপ্রিয়তা। শেষ পর্যন্ত কার পক্ষে মনোনয়ন নামক সোনার হরিণটি ধরা দেয় তা দেখতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
×