ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পায়রা বন্দর আরও এক দফা এগিয়ে

প্রকাশিত: ০৬:৪০, ৯ আগস্ট ২০১৮

পায়রা বন্দর আরও এক দফা এগিয়ে

মেজবাহউদ্দিন মাননু, কলাপাড়া ॥ দেশের তৃতীয় সমুদ্র বন্দর পায়রায় অপারেশনালসহ চলমান কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রশাসনিক কার্যক্রমের গতি বেড়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে ১০ আগস্ট, শুক্রবার পাঁচতলা প্রশাসনিক ভবনের উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে এ কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। ১১ কোটি এক লাখ ৮২ হাজার ২০৯ টাকা ব্যয় ভবনটি নির্মিত হয়েছে। এছাড়াও পায়রা বন্দর নির্মাণে অধিগ্রহণকৃত জমির ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে পুনর্বাসনের অংশ হিসেবে কর্মদক্ষতা বৃদ্ধিতে তিনটি কোর্সের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও আনুষ্ঠানিকভাবে একই দিন শুরু হচ্ছে। এসব উদ্বোধন করবেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের মেম্বার (প্রশাসন ও অর্থ) কমান্ডার এম রাফিউল হাসান জানান, অপারেশনাল কার্যক্রমে গতি আনতে প্রশাসনিক কর্মকা-ের পাশাপাশি মূলত জমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণের পরে তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে কর্মদক্ষতার উন্নয়নে প্রশিক্ষিত করা প্রয়োজন। সেই অভাব পূরণ করতে প্রথম পর্যায়ে দেড় শ’ পরিবারকে তিনটি কোর্সে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। এ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুক্রবার আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে। নির্মাণ শ্রমিক, ড্রাইভিং ও কম্পিউটারের বেসিক কোর্সের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম প্রথম পর্যায়ে চালু করা হবে। তিন মাসব্যাপী এই প্রশিক্ষণ কোর্স সম্পন্ন হবে। দুই বছরে অন্তত ৪২০০ মানুষকে ২৯টি কোর্সে এ প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। এমনকি প্রয়োজনে এ কোর্সের সংখ্য আরও বৃদ্ধি হবে বলে জানান। যুব উন্নয়ন অধিদফতরসহ সরকারের বিভিন্ন দফতর এসব কাজে সহায়তা করবে। তিনি আরও জানান, পর্যায়ক্রমে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের চাহিদার ওপরে ভিত্তি করে প্রশিক্ষণের কোর্সসংখ্যা বৃদ্ধি করা হবে। পায়রা বন্দরকে ঘিরে বিশাল কর্মযজ্ঞের একটি অংশ হিসেবে এসব কর্মকা- শুরু হচ্ছে। একইসূত্রে জানা গেছে, পায়রা বন্দরের মূল চ্যানেল রাবনাবাদ পাড়ের চারিপাড়ায় নির্মাণ করা হচ্ছে ৬০০ মিটার দীর্ঘ টার্মিনাল। এ বছরের শেষের দিকে টার্মিনাল নির্মাণ কাজ শুরু হবে। যদিও ২০২১ সালের মধ্যে টার্মিনাল নির্মাণ কাজ সম্পন্নের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে ২০১৯ সালের শেষের দিকে শেষ করার আশ^াস রয়েছে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের। টার্মিনালে সরাসরি দুইটি মাদার ভেসেল একই সময় ভিড়তে পারবে। পারবে পণ্য খালাশ করতে। টার্মিানাল নির্মাণে তিন হাজার ৯৮২ কোটি টাকা ব্যয়-বরাদ্দের কথা জানা গেছে। টার্মিনাল নির্মিত হলে পায়রা বন্দর থেকে বড় বড় জাহাজের পণ্য খালাসের মতো অবকাঠামো সুবিধা পাবেন আমদানিকারকরা। টার্মিনালটি নির্মিত হলে এ বন্দর থেকে রাজস্ব আয়ের মধ্য দিয়ে দেশ জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখবে বলে মনে করছেন অভিজ্ঞমহল। টার্মিনাল নির্মিত হলে ২০১৯ সালের মধ্যে নির্মাণ সামগ্রী ও অন্যান্য বাল্ক পণ্যবাহী জাহাজ থেকে পণ্য খালাশের প্রক্রিয়া শুরু হবে। বন্দরের প্রশাসনিক ভবন এবং জমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে তিনটি কোর্সের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পায়রা বন্দর নির্মাণ এবং এখানকার মানুষের পুনর্বাসনসহ কর্মসংস্থানের বিষয়টি বাস্তবায়নে গুরুত্বের সঙ্গে পদক্ষেপ নিয়েছেন বলে দাবি করেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী স্থানীয় সংসদ সদস্য আলহাজ মাহবুবুর রহমান। এই জনপদের অদক্ষ মানুষকে পায়রা বন্দরে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে দক্ষতার উন্নয়নে এ প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে বলেও তিনি বলেছেন। উল্লেখ্য ২০ কোটি ৯৭ লাখ ৮৯ হাজার ৭১৩ টাকা ব্যয় পায়রা বন্দরে ওয়ার হাউস নির্মাণ করা হয়েছে। নির্মিত ওয়ার হাউসের দৈর্ঘ্য ৪০০ ফুট, প্রস্থ ২৫০ ফুট, উচ্চতা ২০ ফুট। এক লাখ বর্গফুট আয়তন নিয়ে ওয়ার হাউসটি নির্মিত হলেও এর ডেলিভারি এলাকার আয়তন ৩২ হাজার ৮০০ বর্গফুট। এছাড়া ২১ কোটি ৩৮ লাখ ৮৫ হাজার ২৬৮ টাকা ৯১ পয়সা ব্যয় সার্ভিস জেটির নির্মাণ কাজ চলছে। ম্যাক ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এ কাজটি করছে। ৮০ মিটার দীর্ঘ ২৪ মিটার প্রস্থ এ জেটি দিয়ে মালামাল লোডিং আনলোডিং এর কাজ করা হবে। এ জেটিতে পাঁচ মিটার ড্রাফট জাহাজ সরাসরি পণ্য নিয়ে ভিড়তে পারবে। বর্তমানে একটি পন্টুন জেটি থাকলেও পণ্য খালাশের সুবিধার্থে এই সার্ভিস জেটি নির্মাণ করা হচ্ছে। ২০১৩ সালের ১৯ নবেম্বরে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতের ছোঁয়ায় শুরু হওয়া পায়রা বন্দরের এ কর্মযজ্ঞের ধারা চলবে ২০২৩ সাল পর্যন্ত। পুর্ণাঙ্গ গভীর বন্দরে উন্নীতের লক্ষ্যে এ সময়কাল নির্ধারণ করা হয়েছে। মাত্র পাঁচ বছর আগে সন্ধ্যায় ঘুটঘুটে অন্ধকারে নিমজ্জিত জনপদ, শিয়ালের ডাক ছাড়া কিছুই শোনা যেত না। রাতে তো দূরের কথা দিনেও পদচারণা ছিল না কোন মানুষের। ফেলনা নদীর পাশের বনজঙ্গলে ঘেরা কলাপাড়ার টিয়াখালীর এ জনপদ এখন পরিণত হয়েছে আলোকিত জনপদে। ফ্ল্যাড লাইটের আলোর ঝলকানিতে চোখ কুচকে যায়। চায়ের পিয়াস মেটানোর সুযোগ ছিল না, সেখানে এখন কফির তেষ্টা মেটায় মানুষ। নিত্য পদচারণা করছেন দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারী। ফেলনা, অনাবাদি জমি পরিণত হয়েছে সোনার খনিতে। আনুষ্ঠানিকভাবে পায়রা বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৬ সালের ১৩ আগস্ট। এরপর থেকে নৌপথে মূল চ্যানেলে পণ্যবাহী মাদার ভেসেল থেকে পণ্য খালাশ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। প্রাথমিকভাবে ১৬ একর জমিতে পায়রা বন্দর প্রকল্প এলাকা নির্মাণ করা হয়। সেখানে ইতোমধ্যে নির্মিত হয়েছে পানি শোধনাগার, যেখান থেকে দৈনিক দুই হাজার টন নিরাপদ পানি সরবরাহ করা যাবে। স্থাপিত হয়েছে লাইটার জাহাজ থেকে পণ্য খালাশের টার্মিনাল। বেইলি ব্রিজসহ সংযোগ সড়ক নির্মিত হয়েছে। সোলার বাতিসহ বিদ্যুত সরবরাহ চালু করা হয়েছে। সাবমেরিন কেবল লাইন টানা হয়েছে। সাগর মোহনা থেকে মূল চ্যানেলের নেভিগেশনাল বয়া স্থাপন করা হয়েছে। সিগন্যাল বাতি স্থাপিত হয়েছে। সাগর থেকে চ্যানেলের ইনার সাইটে ২৮টি বয়াবাতি সেট করা হয়েছে। রামনাবাদ থেকে তেতুলিয়া নদীতে বরিশাল হয়ে ঢাকার মেঘনা নদীর হিজলা পর্যন্ত ৭০ মাইল নদী খনন করা হয়েছে। যেখানে পাঁচ মিটার নাব্যতা বজায় রাখা হয়েছে। এ চ্যানেলেও ৪৬টি বয়াবাতি স্থাপন করা হয়েছে। গোটা চ্যানেলটিতে ১০ মিটার নাব্যতা নিশ্চিতের লক্ষ্যে খননের কাজ চলমান রয়েছে। চলমান রয়েছে ৪২ হাজার বর্গফুট কয়েল হাউস এর নির্মাণ কাজ। দ্রুতালয়ে চলছে পায়রা বন্দরের সঙ্গে মহাসড়কের সরাসরি যোগাযোগে পাঁচ দশমিক ৬০ কি.মি. দীর্ঘ ফোরলেন সড়কের নির্মাণ কাজ। ২৫৪ কোটি ৫১ লাখ টাকা ব্যয় নির্মিত হচ্ছে ফোরলেনের সড়কটি। বন্দর সংলগ্ন ট্রাক স্টান্ডের কাজ চলছে। সংক্ষিপ্ত পরিসরে চলছে সিএ্যান্ডএফ এজেন্ট ক্লিয়ারেন্স এবং ইমিগ্রেশনের কাজ। পায়রা বন্দর চালু হওয়ায় এখানকার মৌসুমী কৃষি শ্রমিকসহ জেলে পরিবারের অদক্ষ শ্রমিকরা পেয়েছেন কর্মসংস্থান। কেউ কেউ পেয়েছেন গাড়ি চালকসহ নিরাপত্তার চাকরি। বিকল্প জীবিকার পথ পেয়ে এ মানুষগুলো স্বস্তিতে রয়েছেন। আরও কর্মসংস্থানের সুযোগের খবরে তাদের মনে বেড়েছে উচ্চাকাঙ্খা।
×